হুনজা উপজাতি

হুনজা উপজাতি : হুনজা উপত্যকা সম্পর্কে কিছু আকর্ষণীয় তথ্য কি?

হুনজা উপজাতি : হুনজা উপত্যকা সম্পর্কে কিছু আকর্ষণীয় তথ্য কি? পৃথিবীতে অনেক উপজাতি পাওয়া যায়। এমনই একটি উপজাতি, হুনজা, পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের গিলগিট-বালতিস্তানের পাহাড়ে অবস্থিত হুনজা উপত্যকায় বসবাস।

 

হুনজা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর পড়ে। এই গ্রামটি তারুণ্যের মরুদ্যান নামেও পরিচিত। 

হুনজা গ্রামের মানুষের গড় বয়স 110-120 বছর। এই উপজাতির বিশেষ বিষয় হল এখানকার মানুষ দেখতে খুব সুন্দর এবং তরুণ। বিশেষ করে নারী, যাদের বয়স ৬৫ বছর হলেও তারা এই বয়সেও সন্তান জন্ম দিতে পারে।

হুনজা গ্রামগুলি হিমালয় পর্বতমালার পাদুদেশে অবস্থিত। পামিরে মতন  এই স্থানটি বিশ্বের ছাদ নামেও পরিচিত। 

এটি ভারতের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত, যেখান থেকে ভারত, পাকিস্তান, চীন, আফগানিস্তানের সীমান্ত মিলিত হয়েছে।

হুনজা উপত্যকার প্রাচীনতম ইতিহাসটি প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতে পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতের মহাজনপদ যুগে এই অঞ্চলটি বেশ কয়েকটি প্রাচীন ভারতীয় রাজ্যগুলির প্রধানত কাপিসা, গন্ধার রাজ্য এবং মগধের রাজ্যের অধীনে এসেছিল।

বৌদ্ধধর্ম ৭ম শতাব্দীর শেষদিকে হুনজা উপত্যকায় এসেছিল। তাই কিছুটা হলেও বৌদ্ধ ধর্ম, হিন্দু এবং বন এই অঞ্চলের প্রধান ধর্ম ছিল।

এই অঞ্চলে হুঞ্জার স্যাক্রেড রক এর মতো বেশ কয়েকটি জীবিত বৌদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট রয়েছে। আশেপাশে বৌদ্ধ আশ্রয়ের পূর্ববর্তী সাইট রয়েছে।

হুনজা উপত্যকাটি মধ্য এশিয়া থেকে উপমহাদেশে বাণিজ্য পথ হিসাবে কেন্দ্রীয় ছিল। এটি উপমহাদেশে পরিদর্শন করা বৌদ্ধ মিশনারি ও সন্ন্যাসীদেরও আশ্রয় দিয়েছিল এবং এশিয়া জুড়ে এই অঞ্চল বৌদ্ধধর্মের প্রচারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল।

হুনজা উপজাতির
হুনজা উপজাতির

হুনজা উপজাতির জনসংখ্যা প্রায় 87 হাজার। এই উপজাতির জীবনধারা শত শত বছরের পুরনো। হুনজা উপজাতির লোকেরা বহু বছর ধরে এখানে বসবাস করছে।

হুনজা উপজাতির লোকদের মধ্যে অনেকে 165 বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার জানা যায়। হুনজা উপজাতির বিশেষ বিষয় হল এখানকার লোকেরা খুব কমই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এমনকি টিউমারের মতো রোগের কথা কখনো এখানে শোনা যায় নি।

হুনজা উপজাতি শিশু
হুনজা উপজাতি শিশু

এই লোকদের দেখে আপনি অনুমান করতে পারেন যে খাবার এবং ভাল জীবনধারা মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। 

হুনজার লোকেরা প্রচুর মধু খায়। কিছু লোক এই লোকদের ইউরোপীয় জাতির সাথে যুক্ত করে। প্রকৃতপক্ষে, এখানকার লোকেরা সাদা দাগযুক্ত, তরুণ, প্রফুল্ল এবং আশেপাশের জনসংখ্যা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

হুনজার মানুষ শূন্যের নিচের তাপমাত্রায় বরফের ঠান্ডা জলে স্নান করে থাকে। এই লোকেরা নিজেরাই যে খাবার জন্মায় তা খায়, যেমন এপ্রিকট, বাদাম, শাকসবজি এবং সিরিয়াল যেমন বার্লি, বাজরা এবং বার্লি।

 

তারা কম খায় এবং বেশি হাঁটে। প্রতিদিন 15 থেকে 20 কিলোমিটার হাঁটা তার জীবনধারার অন্তর্ভুক্ত। হাসিও তাদের জীবনযাত্রার একটি অংশ।

 

যেখানে সারা পাকিস্তানের গড় আয়ু ৬৭, সেখানে হুনজাদের গড়  আয়ু নাকি ১২০ বছর! হুনজা উপত্যকাতে এরচেয়েও অধিক আয়ুর মানুষের অবশ্য কমতি নেই।

বিশ্বে সর্বাধিক গড় আয়ু
বিশ্বে সর্বাধিক গড় আয়ু

বিশ্বে সর্বাধিক গড় আয়ু ধারী জাপান হলেও হুনজারা তাদের প্রতিনিয়তই লবডঙ্কা দেখিয়ে যাচ্ছেন বলা চলে। হুনজা উপত্যকাতে প্রায় সাতাষি হাজার মানুষের বসবাস। ধর্মীয় দিক হতে এরা ইসলাম ধর্মের শিয়া সম্প্রদায় ভুক্ত নিজামী ইসমাঈলী মতবাদে বিশ্বাসী জাতি। কথা বলেন বুরুশাসকি ভাষায়৷ 

 

হুনজারা এত বছর কিভাবে বাচে! এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা শুরু হয় মূলত ১৯৮৪ সাল হতে। ইংল্যান্ডের হিথরো বিমানবন্দরে পাকিস্তান হতে সৈয়দ আব্দুল মাবুদ নামক এক হুনজা আসেন। সেখানে পাসপোর্টে তার জন্ম তারিখ দেখে চমকে যান ইমিগ্রেশন অফিসাররা। 

 

পাসপোর্টে তার জন্ম সাল দেয়া ছিল ১৮৩২ সাল! সহজ হিসাব মিলিয়ে যখন তারা বুঝলো এ বৃদ্ধের বয়স ১৫২ বছর তখনই তাদের চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে গিয়েছিল। এরপর ক্রমেই মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্বব্যাপী এ বিষয়টি ছড়িয়ে যাওয়া শুরু করলে হুনজা উপত্যকায় দলে দলে গবেষকরা ভিড় জমাতে শুরু করে। 

 

এতকিছুর পরও সহজ যে প্রশ্নটি সবার মনে দাঁড়ায়, এতবছর আসলে বাঁচে কিভাবে এরা?  এর  বেশকিছু ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা দাড় করিয়েছেন, এ উপজাতি কোন কিছু নিয়েই দুঃশ্চিন্তা করে না।

 

ডিপ্রেশন, মানসিক অবসাদ, চাপ এগুলো তাদের সহজাত প্রবৃত্তিতে নেই বললেই চলে। সব বয়সের নারী-পুরুষ হুনজারাই সুর্যোদয় হতে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পরিশ্রম করে কাটান। একজন ৮০ বছরের হুনজা বৃদ্ধের নিকটেও দৈনিক ১০-১৫ কিলোমিটার পাহাড়ি পথে হাটা দুধভাত। ৪০ কেজি শস্য বোঝাই বস্তা অনায়াসেই তারা ক্ষেত থেকে নিয়ে ফেরেন৷

 

১০০ বছর বয়সেও যথেষ্ট শক্ত সামর্থ্য থাকা  হুনজা পুরুষ ও নারীদের এত বছর বাচার মূল কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা দেখেন তাদের খাদ্যাভ্যাস কে।

 

হুনজারা সারাদিনে মাত্র দু’বার খাবার খান। সূর্য উঠার পরে একটা ভারী ব্রেকফাস্ট ও সূর্যাস্তের পরে হালকা ডিনার। এই শেষ, এর মাঝে হুনজারা আর কোন খাবার খান না। 

 

 

তারা সবসময় প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে থাকেন। প্রয়োজনীয় খাদ্য ও সবজি নিজেরাই উৎপাদন করে থাকেন। হুনজারা মাংস একেবারেই খান না, খেলেও বছরে এক দু’বার ভেড়া বা মুরগির মাংস খান। তারা মূলত বাদাম, ভুট্রা, বার্লি এ জাতীয় খাবার খান।

 

তাদের অন্যতন প্রধান খাদ্য এপ্রিকট নামক এক ধরণের ফল, বিজ্ঞানীদের মতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি-১৭ সমৃদ্ধ এ ফলটি অধিক পরিমাণে খাওয়ার কারণেই বিশ্বের একমাত্র ক্যান্সার-টিউমার ফ্রি জাতি এই হুনজা উপজাতি।

 

দূর্গম এলাকায় বসবাসের কারণে প্রতিদিনই এদেরকে ১০-১৫ কিলোমিটার হাটতে হয়। হাসি, ঠাট্রা এ উপজাতির জীবনের অন্যতম সঙ্গী। একজন বৃদ্ধও এখানে শিশুদের মতই জীবন যাপন করেন, জীবনের প্রতিটা মূহুর্ত উপভোগ করেন তারা। 

তাদের এতবছর বাচার কারণ যাইহোক না কেন, পৃথিবী তাদের এতবছর বাচার কারণ কে আতস কাঁচ দিয়ে ঝাকার চেষ্টা করতে থাকলেও এ নিয়ে তাদের কোন উদ্বেগই নেই। সেখানে আপনি গেলেও মুখে হয়ত এক অনিন্দ্য হাসি নিয়েই অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত থাকবে নির্মল হৃদয়ের এ মানুষগুলো।