বাঙালির গৌরব মহারাজা প্রতাপাদিত্য
——————————————————-
।তৃতীয় পর্ব।
আব্দুল লতিফ নামক একজন পর্যটকের লিখিত বিবরন হতে জানা যায়, “যশোহর অধিপতি প্রতাপাদিত্য বঙ্গদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সর্বগুণে শ্রেষ্ঠ রাজা। তাঁর যুদ্ধসামগ্রীতে পূর্ণ সাতশত নৌকা, ২০ হাজার পদাতিক সৈন্য এবং রাজ্যের রাজস্ব আয় ১৫ লক্ষ টাকা।”
মহারাজা প্রতাপাদিত্যের সভাসদগণের মধ্যে সূর্যকান্ত ও শংকর অত্যন্ত প্রতিপত্তিশালী ছিলেন। সুপণ্ডিত, ধীরস্থির কর্তব্যপরায়ন এবং ব্রাহ্মনোচিত প্রতিভা সম্পন্ন শংকর চক্রবর্তী রাজস্ব ও রাজ্য শাসনের ব্যাপারে পরিদর্শন করতেন।
মহাযোদ্ধা, অসমসাহসী, সর্বশাস্ত্র বিশারদ এবং লোক পরিচালনায় অদ্বিতীয়, ক্ষমতাশালী সূর্যকান্ত রাজত্বের প্রথম ভাগে রাজ্যের প্রধান সেনাপতি ছিলেন। তিনি সৈন্য রক্ষণ, যুদ্ধব্যবস্থা ও বলসঞ্চয়ের দায়িত্ব পালন করতেন। শঙ্কর চক্রবর্তী দেওয়ান ও মন্ত্রণা বিভাগের কর্তা এবং সূর্যকান্ত সৈন্যবিভাগের অধ্যক্ষ। প্রতাপাদিত্য হিন্দুরাজা হলেও পাঠান ও পর্তুগীজদের সৈন্য-বাহিনীতে নিযুক্ত করতেন। প্রতাপাদিত্যের সেনাবাহিনীতে ন’টি ভাগ ছিল। প্রধান সেনাপতির অধীনস্থ পৃথক পৃথক কমান্ডে সৈন্যরা পরিচিত হতো।
সেনাবাহিনীতে ঢালি বা পদাতিক সৈন্য, অশ্বারোহী সৈন্য, তীরন্দাজ সৈন্য, গোলন্দাজ সৈন্য, নৌ সৈন্য, গুপ্ত সৈন্য, রক্ষী সৈন্য, হস্তী সৈন্য, পার্বত, কুকী সৈন্য, এই নয় বিভাগে বিভক্ত ছিল। যুদ্ধে ঢাল, তলোয়ার, শড়কী, বল্লম, লেজা, কামান, বন্দুক, বর্শা, তীর প্রভৃতি অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহৃত হতো। প্রতাপাদিত্যের ঢালী বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন মদন মল্ল। অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান অধ্যক্ষ ছিলেন প্রতাপ সিংহ দত্ত এবং সহকারী ছিলেন মাহিউদ্দীন, বৃদ্ধ নূরউল্লা প্রমূখ। তীরন্দাজ বাহিনীর প্রধান ছিলেন সুন্দর ও ধুলিয়ান বেগ। গোলন্দাজ বাহিনীর অধ্যক্ষ ছিলেন ফ্রান্সিসকো রডা। নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন পর্তুগীজ অগষ্টাস পেড্রো। সুখা নামক এক দুঃসাহসী বীর গুপ্ত বাহিনীর প্রধান ছিলেন। রক্ষীবাহিনীর প্রধান ছিলেন রত্নেশ্বর, বিজয়, রামভক্ত চৌধুরী প্রমুখ। হস্তী বাহিনীর প্রধান ছিলেন রঘুপতি।
বঙ্গদেশে আধিপত্য টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে প্রতাপাদিত্য তাঁর একমাত্র কন্যা বিন্দুমতীর বিবাহ দিলেন চন্দ্রদ্বীপ(বরিশাল)-রাজ কন্দর্পনারায়ণের মহাবীর পুত্র রামচন্দ্রের সঙ্গে। রামচন্দ্র পর্তুগীজ ও মগ জলদস্যুদের সঙ্গে বহু যুদ্ধ জেতেন, ভুলুয়ারাজ লক্ষণমানিক্যকে যুদ্ধে পরাজিত করে স্বীয় রাজধানীতে বন্দী করে নিয়ে এসেছিলেন। ভূভারতে বীরত্বের জন্য প্রশংসিত জামাতা রামচন্দ্র কিন্তু প্রতাপের বশ্যতা স্বীকার করেননি। জামাতা সঙ্গে আসা একজন ভাঁড়ের সামান্য বেয়াদবির মতো তুচ্ছ কারণে,প্রতাপাদিত্য ক্রুদ্ধ হয়ে রামচন্দ্রকে বন্দী করেন। স্ত্রী বিন্দুমতী এবং সম্বন্ধী উদয়াদিত্যের সহায়তায়, রামচন্দ্র শ্বশুর প্রতাপাদিত্যের চোখে ধূলো দিয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হন এবং যশোহর ছাড়ার পূর্বে তোপধ্বনি করে প্রতাপাদিত্যকে তাঁর প্রস্থানের ব্যাপারটি জানিয়ে দিয়ে যান সদর্পেই।
অপমানিত প্রতাপাদিত্য জামাতার পিছু ধাওয়া করলেও তাঁকে ধরতে পারেননি। প্রতাপাদিত্যের সমস্ত রাগ গিয়ে পুঞ্জীভূত হলো কাকা বসন্ত রায়ের ওপর ; কেননা কিছু কুচক্রী কাকা বসন্ত রায়ের বিরুদ্ধে প্রতাপাদিত্যের কান ভারী করে তুলেছিল। তাছাড়া বিভিন্ন সৎকর্মের কারণে প্রজাবৎসল মহারাজা বসন্ত রায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন – যে কারণে প্রতাপাদিত্য তাঁর কাকার উপর ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন।
সেই সন্ধিক্ষণে, বাৎসরিক পিতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে কাকা বসন্ত রায়ের কাছ থেকে নিমন্ত্রণ পেলেন প্রতাপাদিত্য – যা অগ্রাহ্য করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। নির্দিষ্ট দিনে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে কাকার বাড়ী পৌঁছলেন সন্দিগ্ধ প্রতাপাদিত্য। বসন্ত রায়ের ছেলে গোবিন্দ রায় সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে প্রতাপাদিত্যকে নিয়ে গেছেন পিতার কাছে। মহারাজা বসন্ত রায় ওই সময় সান্ধ্যকালীন পূজার আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি একজন পরিচালককে তখন নির্দেশ করছিলেন পূজার জন্য গঙ্গাজল আনতে। দুর্ভাগ্যক্রমে “গঙ্গাজল” ছিল বসন্ত রায়ের অত্যন্ত প্রিয় একটি অস্ত্রের নাম এবং এ তথ্য কাকার কোলেপিঠে চড়ে বড় হওয়া প্রতাপাদিত্যের অজানা ছিল না।
সুতরাং প্রতাপ কাকার এই আদেশ শুনতে পেয়ে মনে করলেন,তাঁকে খুন করার জন্যই বুঝি কাকা ওই পরিচারককে উপরোক্ত অস্ত্র আনতে আদেশ দিয়েছেন । তৎক্ষনাৎ নিজের তরবারি বের করে বৃদ্ধ কাকাকে আক্রমণ করে বসেন প্রতাপাদিত্য। গোবিন্দ রায় যে মুহুর্তে দেখলেন পিতা বসন্ত রায় আক্রান্ত হয়েছেন; বাবাকে বাঁচানোর জন্য তিনি নিজের অস্ত্র ছুঁড়ে মারলেন প্রতাপাদিত্যের দিকে ; কিন্তু সেই অস্ত্র লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। স্বভাবতই আতঙ্কিত এবং ক্রুদ্ধ প্রতাপাদিত্য গোবিন্দ রায়কে তড়িৎ গতিতে আক্রমণ করলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই নিহত হলেন গোবিন্দ রায়। এক বিশ্রী পরিস্থিতির সৃষ্টি হল মুহুর্তের মধ্যে। দু’পক্ষের লোকজনই সশস্ত্র হয়ে পরস্পরকে আক্রমণ শুরু করল। প্রতাপাদিত্যের তরবারির কঠিন আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল মহারাজা বসন্ত রায়ের ছিন্ন মস্তক – যে বসন্ত রায় তাঁকে পুত্রের অধিক স্নেহে মানুষ করেছেন।
দেবতুল্য পিতৃব্য এবং ভ্রাতৃরক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল প্রতাপাদিত্যের হাত। বসন্ত রায়ের অন্য পুত্রেরা পিতৃ ও ভ্রাতৃশোকে পাগলের মতো হয়ে প্রতাপাদিত্যকে আক্রমণ করলেন। অস্ত্রচালনায় পটু প্রতাপাদিত্য ও তাঁর রণদুর্মদ সঙ্গীদের সাহায্যে তাঁদের অতি সহজেই পরাজিত এবং একে একে হত্যা করলেন খুড়তুতো ভাইদের। বসন্ত রায়ের স্ত্রী নাবালক কনিষ্ঠপুত্র রাঘব রায়কে কচুবনে লুকিয়ে রেখেছিলেন। কচুবনে লুকিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছিলেন বলে রাঘব রায় পরবর্তী সময়ে কচু রায় নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। প্রতাপাদিত্য কচু রায়কে খুঁজে বের করে নিজের স্ত্রীর কাছে দেন, বড় করে তোলার জন্য। বসন্তে রায়ের স্ত্রী, যিনি জন্মের পরে মাতৃহীন প্রতাপাদিত্যকে কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেন নি – তিনি সহমৃতা হলেন।
বসন্ত রায়ের শোকসন্তপ্ত জামাতা রূপরাম বসু, বালক কচু রায়কে প্রতাপাদিত্যের কবল থেকে উদ্ধার করার জন্য বসন্ত রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিজলী–কাঁথি রাজ ঈশা খাঁ মশোন্দরীর শরণাপন্ন হলেন। হিজলী-কাঁথি রাজ্যের সেনাপতি বলবন্ত সিং কচু রায়কে উদ্ধার করার গুরুদায়িত্ব নিলেন। ঈশা খাঁ মশোন্দরীর তরফ থেকে প্রচুর উপহার সামগ্রী নিয়ে প্রতাপাদিত্যের কাছে পৌঁছলেন বলবন্ত সিং। ধূর্ত বলবন্ত সিং জানতেন, বলপ্রয়োগ করে কিছুই হবে না; অতএব তিনি ছলনার আশ্রয় নিয়ে প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে প্রতারণা করে কচু রায়কে উদ্ধার করে হিজলী নিয়ে এলেন। রূপরাম বসু শ্যালক কচু রায়কে পেয়ে অত্যন্ত খুশি হলেন; খুশি হওয়ার পালা ঈশা খাঁ মশোন্দরীরও – কেননা তিনি উদ্ধার করে দিতে পেরেছেন বন্ধুপুত্র-কে।
কিন্তু ঈশা খাঁ মশোন্দরী এবং বলবন্ত সিং এ-ও বুঝলেন, প্রতারিত প্রতাপাদিত্য এত সহজে তাঁদের ছেড়ে দেবেন না; প্রতিশোধ তিনি নেবেনই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা যুদ্ধপ্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেন। এবং বাস্তবে ঘটলও তাই। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জল এবং স্থল দু’দিক থেকে হিজলী আক্রান্ত হল। বিশাল নৌবহরের সাহায্যে জলপথে হিজলীর ওপর আক্রমণের ছক সাজালেন নৌসেনাধ্যক্ষ পর্তুগীজ ফ্রান্সিসকো রডা। আর ডাঙায় আক্রমণের নেতৃত্ব দিলেন বিচক্ষণ শঙ্কর চক্রবর্তী , সূর্যকান্ত, মদন মল্ল ও রঘুপতি। স্বয়ং প্রতাপাদিত্য থাকলেন আক্রমণের পুরোভাগে। এ আক্রমণ সহ্য করার ক্ষমতা ঈশা খাঁ মশোন্দরীর ছিল না। তবুও তিনি লড়লেন সাধ্যমত। আঠের দিনের মাথায় প্রতিপক্ষের একটি গোলার আঘাতে তিনি প্রাণ হারালেন। সমগ্র হিজলী তখন অবরুদ্ধ ; ফ্রান্সিসকো রডার ক্রমাগত গোলার আঘাতে হিজলী দুর্গ বিদ্ধস্ত। ভয়ঙ্কর যুদ্ধের পর সেনাপতি বলবন্ত সিং প্রাণ হারালেন।
ভেঙে পড়ল সমস্ত অবরোধ। নির্মম ভাবে লুণ্ঠন করা হল হিজলী। কিন্তু হায়! যে কচু রায়কে পুনরুদ্ধার করার জন্য প্রতাপাদিত্য এই ভয়ঙ্কর এই যুদ্ধ লড়লেন, সেই কচু রায়কে কিন্তু তিনি উদ্ধার করতে পারলেন না। দুরদর্শী রূপরাম বসু, প্রতাপাদিত্যের আক্রমণের শুরুতেই শ্যালক কচু রায়কে নিয়ে দিল্লীর দিকে রওয়ানা হয়ে যান। আসলে তিনি আগেই অনুমান করেছিলেন যে, এই যুদ্ধের কি পরিণাম হতে চলেছে। হতাশ প্রতাপাদিত্য অগত্যা দু’জন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর হাতে হিজলী – কাঁথি রাজ্যের শাসন ও রাজস্ব আদায়ের ভার অর্পণ করে, সসৈন্যে যশোহর ফিরে এলেন। এই যুদ্ধে দক্ষিণবঙ্গের একটি বড় অংশ চলে এল যশোহর রাজ্যের অধীনে।
সম্পাদনা
কৃত্তিবাস ওঝা