ভারত বিদ্বেষ

দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তিত ভূরাজনীতি ও অযৌক্তিক ভারত বিদ্বেষ – কৃত্তিবাস ওঝা

দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তিত ভূরাজনীতি ও অযৌক্তিক ভারত বিদ্বেষ। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এখনো শুরু না হওয়ায়, বাংলাদেশের উদ্বেগের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। যে কারণে অতিউৎসাহী মহল, বলতে শুরু করে দিয়েছে যে, এবার রোহিঙ্গা ইস‍্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলাদেশ-কে মদত দিতে চলেছে চীন।

কিন্তু ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা হচ্ছে, এই মুহূর্তে সোনার ডিম পাড়া হাঁস-মিয়ানমারের সঙ্গ ত্যাগ করা, চীনের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। হতে পারে, বাংলাদেশে বিনিয়োগকৃত বিশাল লগ্নির স্বার্থে চীন দু’-চারটা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে। ভুলে গেলে চলবে না- যে সমস্ত দেশ চীনের বিনিয়োগ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে একসময় নাচানাচি লাফালাফি করেছে, সেই সমস্ত দেশের এখন চড়া সুদের মাশুল দিতে দিতে ঘুম হারাম। চীনের ঋণের সুদ পরিশোধ করতে না পেরে, শ্রীলঙ্কা পাকিস্তান সহ বেশ কয়েকটি দেশ, নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দর বিমানবন্দর প্রভৃতি চীনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। তুর্কমেনিস্তান নিজেদের বিশাল ভূখণ্ড সুদের বিনিময়ে চীনকে দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। চীনের ঋণ নিয়ে কোন রাষ্ট্র লাভবান হয়েছে- এমন নজির নেই।

 

ভারত ও জাপান মিলিত ভাবে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা সহ বেশ কয়েকটি দেশকে প্রস্তাব দিয়েছে যে, উচ্চ সুদের চাইনিজ বিনিয়োগের বিকল্প হিসেবে, তারা স্বল্প সুদে অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তা করতে প্রস্তুত। ঐ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের একটি ইংরেজী দৈনিক পত্রিকায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট ব‍্যক্তিবর্গের প্রদত্ত অভিমত – “অর্থনৈতিক স্বার্থের চেয়েও বাংলাদেশের জন্য অধিক জরুরী- চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা। ভারত ও জাপানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে চীনকে চটানো উচিত হবে না।”যদিও জাপান ও ভারতের সহযোগিতার প্রস্তাব লুফে নিয়েছে মিয়ানমার। স্মরণ করা যেতে পারে, বি এন পি – জামায়াতের যোগাযোগ মন্ত্রী (২০০১-২০০৬) নাজমুল হুদা, এশিয়ান হাইওয়েতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব প্রত‍্যাখ‍্যান করে মিডিয়ায় বলেছিলেন, “বাংলাদেশের ক্ষতি হয় হোক, ভারতকে কিছুতেই লাভবান হতে দেব না।”  

 

সম্প্রতি বিশ্বের প্রভাবশালী ‘ইকোনমিস্ট’-পত্রিকায় একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে,যার শিরোনাম, ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দুর্বল হচ্ছে, চীনের সাথে জোরদার হচ্ছে।’ওই নিবন্ধটির মূল বক্তব্য- বাংলাদেশ সরকার, এশিয়ার প্রধান দুই পরাশক্তি চীন ও ভারত- উভয়ের সাথেই সুসম্পর্ক রেখে চলতে আগ্রহী। চীন ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতে চীন ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে, শীর্ষ বিনিয়োগকারী রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ চীন। তিস্তা নদীর জল ব্যবস্থাপনার জন্য চীনের কাছে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ।

 

বাংলাদেশ,পাকিস্তানকে টপকে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিনত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী বাংলাদেশ তৃতীয় শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর অধিকারী। বাংলাদেশের অর্থনীতি কোভিড ১৯-এর পর দ্রুত পুনরুদ্ধারের জন্য প্রস্তুত এবং বাংলাদেশ শাসন করছে এমন একটি স্মার্ট সরকার – যারা বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ দু’-দু’টি জাতীয় নির্বাচন উৎরে যাওয়া সত্ত্বেও, পাশ্চাত্যের সঙ্গে চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার, চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভারতের সাথে মিত্রতাকে খাটো করে দেখেনি কিংবা চীনকে পর্যাপ্ত মূল্যায়ন না করার মতো আনাড়িও তারা নয়। বাংলাদেশের এই ত্রিমুখী কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করতে পারার সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা এবং পরিবর্তিত ভূরাজনীতি।

 

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম স্থল সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশ কার্যত ভারতের দ্বারা পরিবেষ্টিত। আবার উত্তর-পূর্ব ভারতের ল‍্যান্ডলকড এলাকার সাথে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগের জন্য, বাংলাদেশের ভূমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ও বাংলাদেশ এমন দু’টি দেশ, তারা যদি পারস্পরিক বন্ধু হয়- উভয়েরই যথেষ্ট লাভ, শত্রু হলে অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু বাংলাদেশের সংখ‍্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর তীব্র ভারত-বিদ্বেষী মনোভাব, দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের প্রধান অন্তরায়।

 

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন ভৌগোলিক সীমানা নেই। কৌশলগত দিক দিয়ে বিবেচনা করলে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের এমন কোন বিশেষ ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য নেই – যার দ্বারা চীনকে প্রভাবিত করা সম্ভব। চীনের জন্য মিয়ানমারের সাহায্য একান্ত আবশ্যক। মিয়ানমারের ভূমি ব‍্যবহার করে, চীন ইতোমধ্যেই বঙ্গোপসাগরে নৌঘাঁটি স্থাপন করেছে এবং গ্যাসক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পেয়ে গেছে। তাছাড়া দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সঙ্কীর্ণ মালাক্কা প্রণালী এড়িয়ে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড কানেকশন’-এ মিয়ানমার প্রদত্ত করিডোর সহায়তা, চীনের একমাত্র অবলম্বন।

 

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের মোকাবেলায় চীনকে সবকিছু উজাড় করে দিয়েছে পাকিস্তান- নিজের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ উপেক্ষা করে। পাকিস্তান, আরব সাগরের কৌশলগত সুবিধা চীনকে নিঃশর্তে হস্তান্তর করেছে। অপরিণামদর্শী পাকিস্তান, চীনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে- চীনের জন্য অতিদীর্ঘ ইকোনমিক করিডর বানিয়ে দিতে গিয়ে, অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। ঋণের কিস্তি শোধ করতে না পেরে, পাকিস্তান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ গোয়াদার বন্দর চীনের হাতে তুলে দিয়েছে। তাতেও পাকিস্তানের নিস্তার নেই, সুদের বিনিময়ে সুন্দরী নারীদের তুলে দিতে হচ্ছে চীনের হাতে। পাকিস্তানের গণমাধ্যমে এমন সংবাদও প্রচারিত হয়েছে যে, সুদের টাকা না পেয়ে পাকিস্তানিদের কিডনি পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে চীন। মুসলিম বিশ্বের মাতব্বর হওয়ার স্বপ্নে, ধর্মীয় জঙ্গি উৎপাদনের ফ্যাক্টরি স্থাপন করার চাপ, পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতি সহ‍্য করতে পারছে না।

 

বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার, পাকিস্তান কিংবা পাকিস্তানপন্থী বি এন পি – জামায়াতের মতো, নিজের নাক কেটে ভারতের যাত্রা ভঙ্গ করে নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান সম্প্রতি চীনের বিরুদ্ধে সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট পুনর্গঠন করেছে। এই পরাশক্তির খেলায় একচ্ছত্রভাবে চীনের পক্ষ নিলে, বাংলাদেশের অনেক কিছু হারানোর ঝুঁকি আছে। চীন বিরোধী এই জোটের সাথে বৈরী আচরণ করলে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ, বাংলাদেশের বিলিয়ন-ডলারের তৈরী পোশাকের অন্যতম রফতানি গন্তব্য হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন, গ্রামীণ অবকাঠামো ও সামাজিক উন্নয়নে পাশ্চাত্য ও জাপান প্রধান সহায়ক।

 

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চীন, ভারত ও পাশ্চাত্যের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। অবশ্য, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বাস্তব উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে রোহিঙ্গা সঙ্কট। ১৭ লাখের অধিক রোহিঙ্গা উদ্বাস্ত, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে- আমেরিকা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার প্রস্তাব আনলে, চীন উপর্যুপরি তিনবার ভেটো দিয়ে মিয়ানমারকে রক্ষা করেছে। অন্ধ চীন-প্রেমে মোহগ্রস্ত বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়, মিয়ানমারের পক্ষে ভেটো দেওয়ায় চীনকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাততালি দিয়েছে। বাংলাদেশের উগ্র ভারতবিরোধী ধর্মান্ধ জনগণ মনে করেছিল- রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষে চীনের এই ভেটো প্রদানের ফলে, ভারতের বোধহয় ক্ষতি হয়েছে।

 

বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের বিভিন্ন রচনায়, সে দেশের গণ-আকাংখা প্রতিফলিত হয়েছে যে, ১৯৭১ সালে বাঙালি মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে ভারত যেভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, এবার রোহিঙ্গা মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে, চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে ভারতকে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত হবে, চীনের পক্ষ নিয়ে ভারতের ধ্বংস ত্বরান্বিত করা।

১৯৭১ সালের মতো ভারত এবার ভুল করেনি। তুরস্কের এরদোয়ান প্রশাসন রোহিঙ্গা ইস্যুতে যথেষ্ট উস্কানি দেওয়ার সত্বেও, চীনের ভয়ে সুযোগ বুঝে কেটে পড়েছে। ফলে বাংলাদেশের একার ঘাড়ে চেপে গেছে রোহিঙ্গাদের বিরাট বোঝা। রোহিঙ্গা সমস্যা, মধ্যপ্রাচ্যের কুর্দি সমস্যার চেয়েও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যায় পরিণত হতে চলেছে। চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে, তার ফলে রোহিঙ্গা ইস্যু দ্বিপাক্ষিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ঐ চুক্তির কারণে, রোহিঙ্গা সঙ্কটকে আর বহুজাতিক স্তরে বা জাতিসংঘে স্থানান্তরিত করা সম্ভব নয়। চীন মধ্যস্থতার নাম করে, মিয়ানমারের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশকে ঠাণ্ডা মার দিয়েছে; যদিও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সেটা বুঝতে পারছে না- তারা অণুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে, ভারতীয় ষড়যন্ত্র আবিষ্কারের প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

 

 

লেখক-কৃত্তিবাস ওঝা,ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক।

বাংলাদেশের প্রগতিশীলদের লুঙ্গি খুলে দিয়েছিলো।

আইএস জিহাদীরা কি সুরা নিসার ২৪ নং আয়াত বাস্তবায়ন করেছে?

‘হিন্দু’ নোবেল পেয়েছে এরকম লিস্ট করা হলে আমরা এই বঙ্গবাসীরাই নির্ঘাৎ তাকে সাম্প্রদায়িক বলব।

আরো একবার প্রমাণ হলো বাংলার নিজস্ব্ যা তার সবই ‘হিন্দুয়ানী’!

 

 

ভারত বিদ্বেষ ভারত বিদ্বেষ ভারত বিদ্বেষ ভারত বিদ্বেষ ভারত বিদ্বেষ ভারত বিদ্বেষ ভারত বিদ্বেষ ভারত বিদ্বেষ ভারত বিদ্বেষ ভারত বিদ্বেষ