আগুনের মত জ্বলতে থাকা চোখ দুটোতে ছিল কেবল অসম্ভব ঘৃণা !!

আগুনের মত জ্বলতে থাকা চোখ দুটোতে ছিল কেবল অসম্ভব ঘৃণা !! ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজের তুখোড় এক ছাত্র ছেলেটা। ম্যাট্রিকে ফার্স্ট ক্লাস এবং ইন্টারে সারা দেশের মধ্যে ফোর্থ হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর তার রূপ পাল্টে গেল, এবার সে এনএসএফের গ্যাংস্টার, সারাদিন লোডেড পিস্তল হাতে ক্যাম্পাস কাঁপানো, যার ভয়ে বাকি ছাত্রসংগঠনগুলো টিকতেই পারতো না!

করাচি ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর একাত্তরের মার্চে ঢাকায় ফিরে এল, তখন বাতাসে বারুদ আর রক্তের গন্ধ !! ২৬শে মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদানের কাগজ হাতে এলো ছেলেটার, ঘৃণায় ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছিল সে, তার বুকে তখন হাতুড়ি পিটছে, দামামা, যুদ্ধে যেতে হবে, ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলতে হবে পাকিস্তানী শুয়োরগুলোকে! তার চোখে তখন প্রতিশোধের আগুন!! বাবা আবদুল বারী টের পেলেন, ঠান্ডা কঠিন গলায় ছেলের মা রওশন আরাকে বললেন, “তোমার তো ছয় ছেলে, একজনকে না হয় দেশের জন্য দিয়েই দিলে!”

গ্যাংস্টার ছেলেটা তারপর রূপকথার জন্ম দিলো। ওর মতই কয়েকটা ক্র্যাক ছেলেপেলে জুটে গেল ওর সাথে| হাতে তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র , অগুন্তি পাকিস্তানী শুয়োরে গিজগিজ করতে থাকা আতংক মোরা শহরটাকে কোন এক জাদুবলে পাল্টে দিল এই ডেয়ারডেভিলগুলো ! চোখে সানগ্লাস, ঠোঁটে সিগারেট, হাতে স্টেনগান কেতাদুরস্থ   চেহারা আর স্টাইল দেখে বোঝার উপায় নাই কি ভয়ংকর তারছেঁড়া এরা !! পাকি শুওরদের জন্য ঢাকা শহরকে একেবারে নরক বানায়ে তুলছিল এই বাচ্চা ছেলেগুলো।  এদের অসামান্য দুঃসাহসী সব কর্মকাণ্ড দেখে দুই নম্বরের সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ বলেছিলেন: ‘দিজ আর অল ক্র্যাক পিপল।’ তখন থেকেই এই  দলটার নাম ক্র্যাক প্লাটুন !!

সেই তারছেঁড়া সাহসী ছেলেটা একের পর এক অপারেশনেনেমে পরলো, অপারেশন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল, অপারেশন এলিফ্যান্ট রোড পাওয়ার স্টেশন, অপারেশন যাত্রাবাড়ী পাওয়ার স্টেশন, অপারেশন সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন,অপারেশন ফার্মগেট চেক পয়েন্ট, অপারেশন ফ্লায়িং ফ্লাগস– পুরো ঢাকা শহরে হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে একের পর এক ভয়ংকর গেরিলা আক্রমন চালাতে লাগলো, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তখন এই ক্র্যাক প্লাটুনের নামে প্যান্টে হিসু হয়ে যাওয়ার উপক্রম! শহরের প্রতিটা জায়গায় প্রতিদিন  একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণে আর অ্যামবুশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হকচকিয়ে গেল, ইন্দুরের বাচ্চার মত সন্ধ্যা হলেই আতংকে গর্তের ভিতর গিয়ে লুকাতে লাগলো !!

ছেলেটা ধরা পড়ে ২৯শে আগস্ট, ১৯৭১। আলবদর কমান্ডার আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের দেওয়া খবরে ধরা পরলো ছেলেটা সহ ক্র্যাক প্লাটুনের নয় জন। অকল্পনীয় অত্যাচার চালানো হয়েছিল ওদের উপর, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং নেবার রুট আর অস্ত্রের চালানের রুটটা জানার জন্য ছেলেটার হাড়গুলো সব একটা একটা করে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, প্লায়ারস দিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল সবগুলো নখ, একটা শব্দও উচ্চারন করেনি ছেলেটা! শেষ পর্যন্ত যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সুইচবোর্ডের সকেটের ভেতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে শক খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল কিন্তু, পারেনি।

এক পাকিস্তানী হাবিলদার পেটাতে পেটাতে  ঝরঝর করে রক্ত ঝরতে থাকা মুখটা তুলে বলেছিল, পাশের সেলে ওর বন্ধুরা তথ্য দিচ্ছে, ওরা মুক্তি পেয়ে যাবে, সেও যদি তথ্যগুলো দেয়, তবে তাকেও ছেড়ে দেওয়া হবে । জ্বলন্ত চোখে কঠিন স্বরে উত্তর এলো: “আমি কিছুই বলব না, যা ইচ্ছা করতে পারো। ইউ ক্যান গো টু হেল !”

সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে ছেলেটাকে মেরে ফেলা হয়, বাকিদের সাথে, লাশটা খুজে পাওয়া যায়নি। একটা স্বাধীন দেশের লাল-সবুজ পতাকা হাসিল করতে অকাতরে প্রানটা উৎসর্গ করেছিল ছেলেটা ! কি ভুলেছেন তাকে? ছেলেটার নাম বদি, বদিউল আলম, বীর বিক্রম | মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ছেলেটা অসম্ভব শান্ত কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল পাকিস্তানী শুয়োরগুলোর দিকে, আগুনের মত জ্বলতে থাকা চোখ দুটোতে ছিল কেবল অসম্ভব ঘৃণা !!

আজ ৪৬ বছর পর ঘৃনা ভুলে পাকিস্তান এবং পাকিস্তানীদের প্রতি ভালোবাসার গোলাপ এগিয়ে দেওয়া এ প্রজন্মের শান্তির পায়রারা বদি কে ভুলে গেছেন?

অনুপ শাহা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কাশ্মীরে হিন্দু রাজার হাতে গজনীর অপমানজনক পরাজয়।

আমাদের সুপ্রাচীন সভ্যতার গৌরবময় মহান ঐতিহ্য জানতে হবে, সময় এসেছে ভুল…

করাচী শ্রীরামকৃষ্ণ মিশনে জেহাদী আক্রমণ, ৬০ হাজার দুঃপ্রাপ্য বই পুড়িয়ে দেওয়…

বাংলাদেশের প্রথম বীরশ্রেষ্ঠ জগৎজ্যোতিকে কেন বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব ঘোষনা দিয়েও প্রদান করা হলো না?