দ্বি-জাতি তত্ত্বের "মৃত্যু" পাকিস্তানে তা স্পষ্টতই ঘটে নি।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪০ সালে লাহোরে এক বক্তৃতায় ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগের আগে দেশটিতে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় একসঙ্গেই বসবাস করেছে। কিন্তু জিন্নাহ বলেছিলেন এই দুই সম্প্রদায় ভিন্ন।
“হিন্দু ও মুসলিমদের একই জাতীয় পরিচয়ে পরিচিত করা একটা স্বপ্নমাত্র,” তিনি বলেছিলেন।
“হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মীয় দর্শন আলাদা, তাদের সামাজিক আচার আচরণ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ভিন্ন। এই দুই ধর্মের মধ্যে বিয়ে হয় না, তারা একত্রে খায় না। তারা আলাদা সভ্যতার অংশ যে সভ্যতার মতাদর্শ ও ধ্যানধারণা ভিন্ন।”
এই ”দ্বি-জাতি তত্ত্বের” যে আদর্শ সেটাই পাকিস্তানের জন্ম লগ্ন থেকে এই রাষ্ট্রের সংজ্ঞা ও অস্তিত্বের মূল ভিত্তি হয়ে গেছে বলে বলছেন বিবিসির সংবাদদাতা সিকান্দার কিরমানি।
পাকিস্তানই প্রথম রাষ্ট্র যেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে -একই জাতিসত্ত্বা ও ভাষার ভিত্তিতে নয়। কিন্তু একইসঙ্গে এটি ধর্মতান্ত্রিক (থিওক্র্যাটিক) রাষ্ট্র নয়।
‘সবকিছুই যেখানে ভিন্ন’
ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগের আগে ব্রিটিশ ভারতে বসবাসরত মুসলমানদের মধ্যে আসলেই একটা শঙ্কা ছিল যে স্বাধীন ভারতে তারা হিন্দু-প্রধান রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। দেশটির প্রায় এক চতুর্থাংশ জনগোষ্ঠি ছিল মুসলমান।
কংগ্রেস পার্টি তার দলের ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ সম্পর্কে নিশ্চয়তা দিলেও বহু মুসলমান এ ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন, এবং তাদের আশঙ্কা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা তাদের একঘরে করে রাখবে। কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আস্থা হারানোর আগে পর্যন্ত জিন্নাহ নিজে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে বিশ্বাসী ছিলেন বলে তার বিশ্লেষণে লিখছেন বিবিসির সিকান্দার কিরমানি।
জিন্নাহ দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রথম প্রবক্তা শুধু ছিলেন না, পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তিনি ‌এই তত্ত্বকে রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপান্তরিত করেছিলেন।
এই তত্ত্ব এখন পাকিস্তানে প্রত্যেক স্কুল শিক্ষার্থীকে পড়ানো হয়। এ কারণেই পাকিস্তানের বহু মানুষ উপমহাদেশের স্বাধীনতাকে দেখেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে নয়, বরং ভারতের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন হিসাবে।
মি: কিরমানি বলছেন ইসলামাবাদে কিছু তরুণ শিক্ষার্থীকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম কেন হয়েছিল? কী তারা জানে?
“হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে কোন ব্যাপারেই মিল ছিল না- তারা শুধু থাকত একই দেশে,” বলছিল একজন শিক্ষার্থী।
“তাদের ধর্ম, তাদের মূল্যবোধ, তাদের সংস্কৃতি সব আলাদা। কাজেই মুসলিমদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্যই একটি পৃথক রাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল।”
তবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের যখন জন্ম হয়, তখন যেসব মুসলিম পাকিস্তানে চলে যান, তার থেকে বেশি মুসলিম ভারতে থেকে যান।
এরপর ১৯৭১-এ পাকিস্তান ভেঙে দু-টুকরো হয়ে যায়। জন্ম নেয় বাংলাদেশ।
“মুসলিমদের যদি ধর্মের ভিত্তিতে এক দেশের মানুষ হওয়া উচিত ছিল, তাহলে তারা তিনটি ভিন্ন দেশের নাগরিক কেন? ” প্রশ্ন ঐতিহাসিক ও লেখক আয়েষা জালালের।
তিনি বলছেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সরকারি কারণে ইতিহাসের চেয়ে বেশ জোর দেওয়া হয়েছে মতাদর্শের ওপর।
‘কিন্তু সেটা তো ভুল নয়’
পাকিস্তানের উচ্চ শিক্ষা কমিশনের সাবেক প্রধান আতা-উর-রহমান বলছেন ভারতে মুসলমানদের প্রতি অসহিষ্ণুতা ক্রমশ যে বাড়ছে তা কি প্রমাণ করে না যে দ্বি-জাতি তত্ত্বই সঠিক?
তার দাবি যেসব মুসলমান পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন তারা শিক্ষায় এবং অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধার বিচারে ভারতে যেসব মুসলিম থেকে গেছেন তাদের থেকে “অনেক অনেক ভাল করেছেন।”
অনেকের মতে বাংলাদেশে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের পর দেশটির স্বাধীনতা অর্জন প্রমাণ করে উপমহাদেশের সব মুসলমানই “এক জাতিসত্ত্বার” হতে পারে না। কিন্তু মি: রহমান এ যুক্তি মানেন না।
“এই বিভক্তির কারণ রাজনৈতিক স্বার্থ – এর অর্থ এই নয় যে দ্বি-জাতি তত্ত্ব ভুল,” তিনি বলেন।
পাকিস্তানের জাতীয় পরিচয়ের মূলে যে এই তত্ত্বই প্রধান তা স্পষ্ট। দেশটির বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের মধ্যে প্রধান বন্ধনের সূত্র ইসলাম ধর্ম। জাতীয় ভাষা ঊর্দু দেশের ছোট্ট একটা গোষ্ঠির মাতৃভাষা।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ
•যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ ছাড়া এটাই ছিল সম্ভবত ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের দেশত্যাগ
•দুটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম- ভারত ও পাকিস্তান
•এক কোটি বিশ লাখ মানুষ শরণার্থী হন। ধর্মীয় সহিংসতায় প্রাণ হারায় ৫ থেকে ১০ লাখ মানুষ
•হাজার হাজার নারী অপহৃত হন
তবে ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া পাকিস্তান কি একই সূত্রে দশকে বেঁধে রাখতে সক্ষম হয়েছে?
দেশটির ভেতরে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মাঝে মাঝেই অসন্তোষের বীজ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ছোট ছোট গোষ্ঠিগুলো বলেছে তাদের ভিন্ন চোখে দেখা হয়েছে। যেমন পশ্চিমাঞ্চলে বালুচিস্তান। সেখানে জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। তারা আরও স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়েছে। তারা বলেছে পাকিস্তানের উচিত ছিল দেশটির বিভিন্ন সম্প্রদায়কে স্বীকৃতি দিয়ে একটি ফেডারেশনের অধীনে “চার থেকে পাঁচটি বিভিন্ন দেশ” গঠন।
ইসলামিক রাষ্ট্র?
দ্বি-জাতি তত্ত্ব নিয়ে সবচেয়ে বড় বিতর্ক ছিল পাকিস্তান কি ভারতীয় উপমহাদেশের সব মুসলিমদের জন্য একটা নিরপেক্ষ আবাসভূমি হবে নাকি সেটা হবে একটা ইসলামী রাষ্ট্র, এবং সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভূমিকা কী হবে?
দেশভাগের সময় বেশিরভাগ হিন্দু পাকিস্তান ত্যাগ করেন। থেকে যান প্রায় বিশ লাখের মত হিন্দু।
পাকিস্তান সংসদের একজন হিন্দু সদস্য রমেশ ভাংকোয়ানি বলেন তিনি এই তত্ত্বে বিশ্বাসী। এরপরও তিনি মনে করেন পাকিস্তানের হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই “একই দেশের মানুষ- তারা পাকিস্তানি
তিনি বলেন দেশ ভাগের কয়েক দিন আগে জিন্নাহ তার বিবৃতিতে বলেছিলেন: “আপনি পাকিস্তানের ভেতর আপনার মন্দিরে যাবেন, মসজিদে যাবেন, যে কোন উপসনালয়ে যাবেন। আপনার জাত, ধর্ম যাই হোক না কেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে তা সাংঘর্ষিক নয়।”
তিনি মনে করেন জিন্নাহ শুধু মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান চান নি, তিনি পাকিস্তানে সবার জন্য সমান অধিকার
কিন্তু অন্যরা প্রশ্ন তোলেন পাকিস্তান যদি ইসলামী রাষ্ট্র নাই হবে তাহলে শুধু মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠেনের কী প্রয়োজন ছিল?
ঐতিহাসিক আয়েষা জালালের কোন সন্দেহ নেই যে জিন্নাহ চেয়েছিলেন “ভারতীয় মুসলিমদের জন্য আলাদা দেশ”, তিনি ইসলামী রাষ্ট্র চান নি।
তবে তিনি বলছেন ইসলামপন্থীরা তার তত্ত্বকে “আদর্শগত দৃষ্টিকোণ” থেকে ব্যাখ্যা করেন পাকিস্তানকে একটা ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে তুলে ধরার পেছনে যুক্তি হিসাবে।
মি: কিরমানি বলছেন এইসব সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ বোঝেন না। তারা মনে করেন ইসলাম ধর্মের অবমাননার শাস্তি মৃত্যু হওয়া উচিত।
শারাফাতউল্লাহ নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের বাবা যার ছেলে ইসলামের অবমাননার জন্য তার এক সহপাঠীকে পিটিয়ে মারতে জনতাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল তিনি প্রশ্ন তুলছেন, “আমাদের বলা হয়েছে পাকিস্তানের সৃষ্টি দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। এই দেশে কেউ যদি নাস্তিক হয় এবং নাস্তিকতা ছড়াতে চেষ্টা করে তাহলে পাকিস্তানের জন্মের কি দরকার ছিল?”
অথচ পাকিস্তানে ইসলামপন্থী দলগুলো কখনই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সমর্থন পায় না।
১৯৭১এ বাংলাদেশের জন্মের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন দ্বি-জাতি তত্ত্বের “মৃত্যু” হয়েছে।
পাকিস্তানে তা স্পষ্টতই ঘটে নি। দেশটির আত্মপরিচয় নিয়ে বিতর্ক যখনই ওঠে তখনই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আয়েষা জালাল বলছেন আর ভারত এই তত্ত্বের মৃত্যু হয়েছে একথা অনেকদিন আগে বললেও সেখানে যেভাবে হিন্দুত্বের উত্থান ঘটছে তা এই বক্তব্যকে কতটা সমর্থন করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। ।”