কোরবাণীর ঈদ

সামনেই কোরবাণীর ঈদ। হাট থেকে গরু কিনে আল্লার নামে জবাই করে তার মাংস খাবেন। কম বেশি কোরবাণীর মাংস আমিও খাবো। আসুন মাংস খাবার আগে কিছু সত্যের মুখোমুখি হয়ে নেই-

(১) কুরআনের কোথাও বলা নেই ইব্রাহিম নবী তার পুত্র ইসলাইলকে কোরবাণী দিতে চেয়েছিলেন। বরং সুরা আস সাফাত পড়লে স্পষ্ট হয় ইব্রাহিম অন্য কাউকে কোরবাণী দিয়েছিলো।

(২) কারণ ইব্রাহিম তার পুত্র ইসমাইলকে দুগ্ধশিশু অবস্থায় তার মা সমেত মক্কাতে ফেলে আসেন। মক্কাতে ফেলে আসার দাবী কেবল মাত্র ইসলাম ধর্মের। ইহুদী খ্রিস্টান ধর্ম মতে ইব্রাহিম জেরুজালেমের পাশেপাশে কোন নির্জন স্থানে হাজেরা এবং সদ্য জন্মানো শিশু ইসমাইলকে ফেলে আসেন।

(৩) এদিকে কুরবানীর কাহিনী বলতে গিয়ে সুরা আস সাফাত বলছে ‘অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বলল, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখিছি, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বলল, পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন (সুরা আস সাফাত, ১০২)।

(৪) এখন জানা দরকার এই শিশুটি ইসমাইল কিনা? কারণ সুরাতে ইসমাইলের নাম বলা নেই। ইব্রাহিম কি স্বপ্নে কোরবাণীর আদেশ পাবার পর হাজেরার কাছে ফিরে গিয়েছিলেন? সেখানে গিয়ে ইসমাইলকে কোরবাণী দিতে চেয়েছিলেন? এরকম কোন স্পষ্ট দলিল ইসলামের কোথাও নেই। বরং এটা স্পষ্ট করে বলা যায় ইব্রাহিম যখন তার ফেলে আসা সন্তানকে দেখতে ইচ্ছা করেন তখন ইসমাইল একজন পরিপূর্ণ যুবক। সে বিয়ে করে ঘর সংসার করছে। ইসমাইলের স্ত্রী ইব্রাহিমকে চিনতে পারেনি। পুত্রের সঙ্গে যদি ইব্রাহিমের যোগাযোগ থাকত তাহলে তার পুত্রবধূকে না চেনার কথা নয়। ইবনে কাথির স্পষ্ট করে বলেছেন ইসমাইল বিয়ে করার পরই ইব্রাহিম তার পরিত্যাক্ত পরিবারকে দেখার ইচ্ছার কথা প্রথম প্রকাশ করেন (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাথির, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৫২)।

(৫) আমার কথা বিশ্বাস না হলে এবার সহি হাদিস থেকে দেখুন: ‘তারপর হাজেরার শিশুপূত্র প্রাপ্ত বয়স্ক হলো, তখন তিনি জুরহুম গোত্রেরই এক কন্যাকে বিয়ে করলেন। ইবনে আব্বাস বলেন, অত:পর নির্বাসিত পরিজনের কথা ইব্রাহীম এর মনে উদয় হলো। তিনি তার স্ত্রী সারাহকে বললেন, আমি আমার নির্বাসিত পরিজনের কথা জানিতে চাই। ইবনে আব্বাস বলেন, অত:পর ইব্রাহীম তাদের নিকট আসলেন এবং সালাম দিলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ইসমাইল কোথায়? ইসমাইলের স্ত্রী বলল- তিনি শিকারে গিয়েছেন (সহী বুখারী, বই-৫৫, হাদিস নং-৫৮৪)।

(৬) আর মনে আছে তো সুরা আস সাফাতে কি লেখা আছে? ‘অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল’ তখন ইব্রাহিম তাকে কোরবাণী দিতে নিয়ে গিয়েছিলো। তাহলে নিশ্চিত করেই সে শিশু ইসমাইল নয়! তাহলে কে?

(৭) ইহুদী খ্রিস্টান ইসলাম- এই তিন ধর্ম মতে ইব্রাহিমের দুই পুত্র ইসমাইল এবং ইসহাক। ইহুদী খ্রিস্টানদের কাছে ইসমাইল কখনই আলোচিত হয়নি তার কারণ ঈশ্বর ইব্রাহিমের পুত্র ইসহাককে আর্শিবাদ দিয়েছিলেন। কথা দিয়েছিলেন তার বংশে নবুয়াত দিবেন। কিতাব পাঠাবেন। স্বয়ং কুরআনের দুটি সুরাতে ইসহাকে বরকত এবং তার বংশে নবী পাঠানোর কথা বলা আছে। কোথাও ইসমাইলের নামগন্ধ পর্যন্ত নেই। যেমন সুরা আনকাবূতে বলা হয়েছে, ‘আমি ইব্রাহিমকে দান করলাম ইসহাক এবং ইয়াকুব; এবং বংশধরদের জন্য স্থীর করলাম নবুয়ত ও কিতাব এবং আমি তাকে দুনিয়াতে পুরস্কৃত করেছিলাম। আখিরাতেও সে নিশ্চয় সৎকর্ম পরায়নদের অন্যতম হবে’ (সুরা আনকাবূত ২৬-২৭)।

(৮) সুরা আম্বিয়াতেও ইসমাইলের বংশের কথা বলা নেই! ‘এবং আমি তাকে ও লুতকে উদ্ধার করে সেই দেশে নিয়ে গেলাম, যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি বিশ্ববাসীর জন্য এবং আমি ইব্রাহিমের জন্য দান করেছিলাম ইসহাক এবং পৌত্ররূপে ইয়াকুব, এবং প্রত্যেকেই করেছিলাম সৎপরায়ন, এবং তাদের করেছিলাম নেতা, তারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথপদর্শন করত, তাদের ওহি প্রদান করেছিলাম সৎকর্ম করতে, সালাত কায়েম করতে, যাকাত দান করতে, তারা আমারই ইবাদত করত (সুরা আম্বিয়া, ৭১-৭৩)।

(১০) এই যে ইব্রাহিমের বংশে নবুয়াতের আশ্বাস তা কিন্তু কোরবাণীর পরীক্ষায় ইব্রাহিমের উর্ত্তীণ হবার পুরষ্কার ছিলো। যদি ইসমাইলকে কোরবাণী দেয়ার কথা বলা হতো তাহলে স্পষ্ট করেই ইসমাইলের বংশে নবী পাঠানোর কথা লেখা হতো এবং ইসমাইলের নাম উল্লেখ করে তাকে বরকত দানের কথা থাকত। আনকাবুতম, আম্বিয়া কোথাও বলা নেই ইসমাইলের বংশে নবুয়াত এবং কিতাব পাঠানো হবে। স্পষ্ট করে ইসহাকের নাম এসেছে। কেন?

(১১) তাহলে কেন মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত ইসমাইলকেই কোরবাণী দেয়া হয়েছিলো? কারণ নবী মুহাম্মদ ইসমাইলের বংশধর বলে দাবী করতেন। ইব্রাহিমের বংশধর প্রমাণ করতে তাকে ইসমাইল ছাড়া ইসহাকের বংশধর বলার কোন সুযোগ ছিলো না। কারণ ইসহাক ইয়াকুবের বংশধররাই ইহুদী বলে পরিচিত। আর মুহাম্মদ ছিলেন আরব কুরাইশ জাতির সন্তান। ইসমাইলকে মক্কাতে ইব্রাহিম নির্বাসন দিয়েছে এবং তার বংশধররাই হচ্ছে কুরাইশ বংশ। আদম, নূহ, লুত, ইব্রাহিম, মুসা, যীশু… সেমিটিক এবং ইহুদী ধর্মের নবীত্বের এই ধারায় নিজেকে নবী বনাতে ইসমাইলই ছিলো একমাত্র পথ। অথচ কুরবানী দেয়ার ঘটনাটা এক্ষত্রে জটিল করে ফেলেছিলো। ইসমাইলের বংশধর বলে ধরা হলেও তিনি নবী হতে পারেন না তাত্ত্বিকভাবেই। এটি সম্ভব হতে হলে ইসমাইকে কোরবাণী দিতে হবে। এটি মূলত ধর্ম তাত্ত্বিকদের কাছে নবী মুহাম্মদের নিজেকে নবী প্রমাণের একাডেমিক লড়াই ছিলো।

(১২) তাওরাতে কিন্তু স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে ইব্রাহিম তার পুত্র ইসহাককে কোরবাণী দিতে মোরিয়া দেশে নিয়ে গিয়ে হোমবলি দিতে চেয়েছিলেন (আদি পুস্তক, ২১:২২-২২:১৩)। কুরআনে নাম উল্লেখ করেনি ইব্রাহিমের কোন পুত্রকে কোরবাণী করেছিলো। শুধু উল্লেখ করেছে ‘শিশুটি যখন হাঁটাচালায় উপণিত হয়েছিল’ তখন তাকে কোরবাণী দিতে ইব্রাহিম নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু হাদিস সিরাত সব খানেই বলছে ইব্রাহিম ইসমাইলকে ফেলে আসার পর দ্বিতীয় সাক্ষাতের সময় ইসমাইল যুবক বয়েসে উপণিত হয়েছে। তাছাড়া ইব্রাহিম কি জেরুজালেম থেকে ১৩০০ কিলোমিটার দূরের মক্কাতে ট্রেনে চড়ে বা উড়োজাহাজে করে চলে আসতেন? প্রায় দেড় হাজার বছর আগের কাহিনীতে এই সুদীর্ঘ পথের কথাটা পাঠক মাথায় রাখবেন। তাওরাত মতে ইব্রাহিম হাজেরা এবং শিশুপুত্র ইসমাইলকে জেরুজালেমের আশেপাশে কোথাও ফেলে এসেছিলেন।

(১৩) কুরআনে কেন ইসমাইলকে কোরবাণী দেয়ার কথা লিখল না? তাওরাতে যেখানে স্পষ্ট করে ইসহাকের নাম লেখা আছে। মুসলমানরাই বা কেন ইসমাইলকেই কোরবাণী দেয়া হয়েছিলো এই দাবী ছাড়ে না? কুরআন হাদিস ছাড়া মুসলমানরা কারোর মুখের কথাকে দলিল হিসেবে মানে না। এক্ষেত্রে কুরআন হাদিসে ইসমাইলের নাম না থাকার পরও কেন ইসমাইলকে কোরবাণী দেয়ার দাবীতে আঁকড়ে থাকে? কারণটি হচ্ছে ইসহাককে কোরবাণী দিতে নিয়ে গিয়েছিলো বিধায় তার বংশেই আরো নবুয়াত ও কিতাব পাঠানোর অঙ্গিকার করেছিলেন ইহুদী এবং খ্রিস্টানদের ঈশ্বর। ইসমাইলের মক্কাতে থাকার সম্ভাবনা যৌক্তিকভাবেই ছিলো অসম্ভব। তবু কুরাইশরা তার বংশধর ধরলেও সেই বংশ ঈশ্বরের আর্শিবাদ প্রাপ্ত হয় না কারণ ইসমাইলকে হোমবলি দিতে ইব্রাহিম মোরিয়া দেশে নিয়ে যাননি এটা সব রকম ধর্মীয় কাহিনী থেকেই পরিস্কার। গল্পের গলদটা হচ্ছে- হাজেরা এবং ইসমাইলকে ফেলে এসে ইব্রাহিম তাদের সঙ্গে ফের দেখার করার যে কাহিনী পাওয়া যায় তাতে ইব্রাহিমের হাঁটাচলা করতে শেখা শিশুপুত্র যে ইসমাইল নয় তা কিছু দিয়েই ঢেকে রাখা সম্ভব না। এ কারণেই কুরআনে স্পষ্ট করে কারোর নাম উল্লেখ করা হয়নি। অথচ কত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এটা চিন্তা করেন। আবু লাহাবের মত অগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম যে কুরআনে আছে সেখানে কাকে কুরবাণী দেয়া হলো তার নামটাই নেই! এখানেই ঘাপলাটা…।

… আর সাপ্তাহখানেক পর কুরবাণীর ঈদ। আসুন একটু ভাবি। কে কুরবাণী হয়েছিলো, ইসমাইল নাকি ইসহাক?