জন্মান্তর

জন্মান্তর: ভারতীয় দার্শনিকদের প্রকৃতিবাদী দর্শনের একটা ছবি

জন্মান্তর: ভারতীয় দার্শনিকদের প্রকৃতিবাদী দর্শনের একটা ছবি, আমার মনে হয় ‘জন্মান্তর’ বিষয়টি অতি উচ্চ মার্গ দর্শন থেকে এটি হিন্দু শাস্ত্রে রূপ পেয়েছিলো।

 

এক হিসেবে পৃথিবীতে সকল বস্তুর ‘জন্মান্তর’ ঘটে! ভারতের ঋষিরা (দার্শনিরকরা) ও গ্রীক ঋষিদেরা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন বস্তু যে ডটের সমষ্ঠি (অনু পরমাণু) তা প্রকৃতিতে মিশে গিয়ে ফের নতুন সৃষ্টিতে যুক্ত হয়।

তাই আমার মনে হয় জীবনানন্দ দাশের মত কবিকে আমরা আজো বুঝে উঠতে পারিনি। তার ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের অতি জনপ্রিয় ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতাটি যদি খেয়াল করি তাহলে গভীর অর্থ বুঝতে পারব।

কিন্তু এই কবিতাটিকে নেহায়ত বাংলা রূপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ কবির আবার জন্ম নেবার আশাবাদ হিসেবে আমরা ভুল করে বসে আছি। নিজের কবিতা নিয়ে কবি কোনদিনই কথা বলেননি। জীবিত থাকাকালীন কেউ তার ইন্টারভিউ নেননি।

তার সময়ে তাকে কেউ মূল্যায়ন করেননি। ফলে তার দর্শন নিয়ে আমরা কেউ তার মুখ থেকে কিছু শুনিনি। ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায় দেখুন জীবনানন্দ কি বলছেন-

আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে –এই বাংলায়

হয়ত মানুষ নয়,হয়তো শঙ্খচিল শালিকের বেশে,

হয়ত ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে…’

জীবনানন্দ দাশ বিলক্ষণ জানতেন মানুষসহ প্রকৃতির সমস্ত কিছু আসলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় সৃষ্টি। এই কণাগুলি এখন পর্যন্ত জানা গেছে সবচেয়ে বড় অনু, তারপর পরমাণু, পরমাণু ভাঙ্গলে ইলেকট্রন নিউট্রন, প্রোটোন।

ভবিষ্যতে হয়ত তারচেয়েও ক্ষুদ্র কনার কথা জানা যেতে পারে। মনে করুন একটা বাঁশের কঞ্চিকে আপনি ভাঙ্গছেন। ভাঙ্গতেই থাকুন। এভাবে টুকরো টুকরো করতে করতে শেষ পর্যন্ত এমন একটি কনায় এসে ঠেকবে যাকে আর ভাঙ্গা যায় না। এটাই মৌলিক কণা।

মানুষও বাঁশের কঞ্চির মত এরকম কণা দিয়ে তৈরি। একটা হাতি, বড় একটা দালান থেকে শুরু করে গাছপালা নদীনালা সবই কণার সৃষ্টি। কাজেই আমি আপনি যখন মরে যাবো তখন আমাদের লাশ মাটি দিক বা আগুনে পোড়াক তাতে কণাগুলি- মৌলিক কণাগুলির কোন পরিবর্তন হবে না। এগুলি হয়ত ধানসিঁড়ি নদীর ‘পার’ হিসেবে ফের জন্ম নিবে।

অথবা একটা শঙ্খচিল নয়ত একটা কাক হয়ে জন্ম নিবে। যেমন আপনি আমি আগে থেকেই পৃথিবীতে ছিলাম। আমরা স্পামের মধ্যে এসেছিলাম মানুষের জীবনযাপনের ব্যবহৃত হয়ে। আমাদের কোটি কোটি ভাইবোনদের হারিয়ে আমাদের জন্ম নিতে হয়েছিলো।

আমাদের প্রতিযোগীতায় হেরে যাওয়া মৃত সেই ভাইবোনরা তো প্রকৃতেই মিশে গেছে। হয়ত স্রেফ মাটি গেছে। আমরাও তাই ছিলাম হয়ত। অথবা একটা ময়ূরের রঙ্গিন পুচ্ছ হয়ে। কারোর পোষা কুকুরের লেজ হয়ে! মানুষ মরে গেলে তাই কোথাও চলে যায় না।

‘না ফেরার দেশে’ চলে যাওয়া শুধু কাব্য করে বলা চলে, এসবের কোন মূল্য নেই। ‘ওপাড়ে ভালো থাকবেন’ যারা এখনো বলেন তারা পরকাল বলতে আরেকটি জগতকে আজো বিশ্বাস করেন। তারা মনে করেন মানুষ মরে গিয়েও মানুষই থাকবে। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ তেমন মনে করতে না। তার ‘অন্ধকার’ কবিতায় বলা হয়েছে-

ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম- পউষের রাতে-
কোনদিন আর জাগবো না জেনে
কোনদিন জাগবো না আমি- কোনোদিন জাগবো না আর-
হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
তুমি দিনের আলো নও, উদম্য নও, স্বপ্ন নও,
হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে,
রয়েছে যে অগাধ ঘুম,
সে-আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই,
তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও–

জানো না কি চাঁদ,
নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
জানো না কি নিশীথ,
আমি অনেক দিন– অনেক অনেক দিন
অন্ধকারের সারাতসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে
হঠাত ভোরের আলোর মুর্খ উচ্ছাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব ব’লে
বুঝতে পেরেছি আবার,
ভয় পেয়েছি,
পেয়েছি অসীম দুনির্বার বেদনা;
দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে
মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য
আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;

আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়- বেদনায়- আক্রোশে ভরে গিয়েছে ;
সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে
উৎসব শুরু করেছে।
হায়, উৎসব!

হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে
আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি, অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর
মতো মিশে থাকতে চেয়েছি।

কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি।
হে নর, হে নারী ,
তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন ;
আমি অন্য কোন নক্ষত্রের জীব নই।

যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গীত, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ,
সেখানেই সূর্য , পৃথিবী, বৃহস্প্রতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,
শত শত শুকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর ;
এইসব ভয়াবহ আরতী!

গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;
আমাকে জাগাতে চাও কেন?
অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠবো না আর ;
তাকিয়ে দেখবো না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে
অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে
কীর্তিনাশার দিকে ।

ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো- ধীরে- পউষের রাতে
কোনোদিন জাগব না জেনে-
কোনদিন জাগব না আমি- কোনদিন আর।

 

কবিতাটি যদি পড়ে থাকেন তাহলে খেয়াল করবেন কবি এখানে বলছেন, তিনি জড় কণা হয়ে পৃথিবীতে ছিলেন, ‘অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব ব’লে বুঝতে’ পেরেছেন! জীবনানন্দ এই জীবনকে কোনদিন মেনে নিতে পারেননি।

 

তিনি পৃথিবীতে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি। পারেননি বলেই তিনি একটা ঘোরের জগতে নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন আজীবন। মানুষের এই জীবন, বেঁচে থাকার লড়াইকে তিনি বলছেন ‘যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ, সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,শত-শত শূকরের চিৎকার’।

 

তাই আবার পৌষের রাতে ধানসিঁড়ি নদীর তীরে তিনি শুয়ে থাকতে চেয়েছেন। কিভাবে? চেতনাহীন কণা হয়ে প্রকৃতিতে। এই যে ‘আমি’ আমাদের সত্তা, যাকে ধর্ম ‘আত্মা’ বলছে সেটা আসলে মস্তিষ্কের সচলতা ছাড়া আর কিছু না।

 

মৃত্যু সেই সচলতা নিভিয়ে দিলে ‘আমি’ বলতে আমাদের যে চেতনা তা লুপ্ত হয়ে যায়। তাই রবীন্দ্রনাথ শেক্সপিয়র সবাই প্রকৃতিতে মিশে গিয়ে তাদের ‘রবীন্দ্রনাথ’ ‘শেক্সপিয়র’ ‘ম্যারাডোনা’ ‘পেলে’ পরিচয় আর জানতে পারেন না।

 

তাই ম্যারাডোনা পেলেকে ওপারে অভ্যর্থনা জানাতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন গ্রাফিক্স ডিজাইনারের সুনিপুন কাজ প্রশংসার দাবী রাখলেও এসব কল্পনা মিথ ছাড়া আর কিছুই নয়। রবীন্দ্রনাথ বিলক্ষণ জানতেন তিনি মরার পর ঠিকই এইখানে থেকে যাবেন- কোথাও যাবে না। তার বিখ্যাত

‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এইখানে’ গানে তিনি বলেছেন-
তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।         

সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি– আহা,             

নতুন নামে ডাকবে মোরে,   বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে,         

আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।         

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,             

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে…

 

এটা জন্মান্তর নামের স্থূল শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস নয়। ভারতীয় দার্শনিকদের প্রকৃতিবাদী দর্শনের একটা ছবি। এ যেন আমি থেকেও নেই, আবার না থেকেও আছি! ভাবলে কী রকম উদাসিন হতে হয়…।

#সুষুপ্ত #পাঠক #Philosopher #Rishi #JibananandaDas #Rabindranath #Shakespeare #Maradona #Pele জন্মান্তর জন্মান্তর জন্মান্তর জন্মান্তর জন্মান্তর জন্মান্তর জন্মান্তর