সালাম

পৃথিবীতে কত উদার মনের ভাল মানুষ আছে। শুধুমাত্র ধর্ম বিশ্বাসের কারণে তারা মানুষকে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মঙ্গল কামনাও করতে পারে না। ‘জগতের সকল প্রাণী সুখি হোক’ বলে রাতদিন জপ করলেও জগতের সকল প্রাণী দূরে থাক সকল মানুষকেও সুখি রাখা সম্ভব হবে না। কিন্তু এই যে চাওয়াটা- এটিই বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ। এটিই মানবপ্রেম- মানবধর্ম…। ছোটবেলায় স্কুলের একটা ঘটনা ঘটেছিলো যেটি আমার মনে বেশ দাগ কেটেছিলো। আমাদের একজন শিক্ষক আমার বন্ধু সুরজিৎকে বলেছিলো, তোমরা আমাকে সালাম দিবে না, বলবে আদাব…। তখনো সাম্প্রদায়িকতা হিন্দু-মুসলমান প্রকটভাবে বুঝার বয়স হয়নি। শুধু এটুকু বুঝেছিলাম, আমি স্যারেক সালাম দিতে পারব কিন্তু সুরিজৎ দিবে আদাব। কেন?

পরবর্তীকালে ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান হবার পর বুঝেছিলাম স্যার আসলে সুরিজৎ হিন্দু হবার কারণে তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক চাইতে পারছিলেন না। ছাত্র হবার পরও একজন শিক্ষক তার ধর্মীয় নির্দেশনাকে বিশ্বাস করে তার মঙ্গল কামনা করতে পারছিলেন না। স্যার বেশ ভাল মানুষ- সুহৃদয়। তবু তাকে হীন করে তুলেছিলো তার বিশ্বাস। কারণ ইসলামে অমুসলিমদের সালাম বা সম্ভাষণ বিষয়ে পরিস্কার বিভাজন করে রেখেছে। হাদিসে পরিস্কার বলা আছে- আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইয়াহুদি-খ্রিষ্টানদেরকে প্রথমে সালাম দিয়ো না। যখন পথিমধ্যে তাদের কারো সাথে সাক্ষাৎ হবে, তখন তাকে পথের এক প্রান্ত দিয়ে যেতে বাধ্য করো। (মুসলিম ২১৬৭, তিরমিযি ২৭০০, আবু দাউদ ১৪৯, আহমদ ৭৫১৩,৭৫৬২, ৮৩৫৬, ৯৪৩৩, ৯৬০৩, ১০৪৪১৮)।

এই সালামের জবাবও ভিন্ন রকম। অমুসলিমদের সালামের জবাবে বলতে হবে ‘ওয়া‘আলাইকা’ অথবা ‘ওয়া‘আলাইকুম’ (বুখারী ‘কিতাবুল ইসতিযান’ হা/৬২৫৭, কিতাবুল ইসতিতাবাতুল মুরতাদ্দীন’ হা/৬৯২৮, মুসলিম হা/২১৬৪, সহীহ আবু দাউদ হা/৫২০৬, সহীহ ইবনু মাজাহ হা/৩৬৯৭)। ওয়া‘আলাইকুম শব্দ অর্থ ‘তোমাদের ওপরও তা-ই হোক যা তোমরা বলেছ’। এই হাদিসগুলোর ভিত্তিতে ফকীহদের মতামত হচ্ছে কোন অমুসলিমকে সালাম দেয়া যাবে না। সালাম অর্থ শান্তি। কোন অমুসলমানের শান্তি কামনা করা যাবে। তবে অন্য কোন শিষ্টাচারমূলক সম্ভাষণ তাদের করা যেতে পারে…।

মসজিদে ছোটবেলায় জুম্মা পড়তে গেলে খেয়াল করে দেখেছিলাম হুজুর কেবল মুসলমানদের জন্য দোয়া করেন। কিন্তু বিটিভিতে বিকেল ৫ টায় খোলার সময় গীতাপাঠ বা ত্রিপিটক পাঠের সময় দেখছি পুরোহিতরা বলছে, ‘জগতের সকল প্রাণী সুখি হোক’। …এই তফাত মনের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করলেও আর সব মুসলিম ঘরের সন্তানের মত সেই বয়স থেকে নিজেদের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বলে জানতাম। মুসলমানরা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। তাদের ধর্ম সর্বশ্রষ্ঠ।… অথচ ভেতর ভেতর কী সংকীর্ণমনা!…