জিযিয়া বা কর প্রদানের শর্তে তাদের থাকতে দেয়া হয় খায়বারের নির্দিষ্ট একটি এলাকায়

দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় আবদুল্লাহ তামিম নামের একজন মুফতির লেখা প্রকাশ করেছে যিনি অভিযোগ করেছেন সৌদির বর্তমান তথাকথিত উদার প্রিন্সের ধর্মনিরপেক্ষ সৌদি আরব গড়ার অংশ হিসেবে ইহুদীদের মক্কাতে প্রবেশের সুযোগ দিয়েছেন। মুফতি সাহেব এটিকে কুরআন লঙ্ঘনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মুফতি সাহেব নিজে লিখেছেন, ৬২৯ খ্রিস্টাব্দের সপ্তম হিজরিতে খায়বারের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইহুদিদের শক্তি খর্ব করা হয়। জিযিয়া বা কর প্রদানের শর্তে তাদের থাকতে দেয়া হয় খায়বারের নির্দিষ্ট একটি এলাকায়। পরবর্তিতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করায় হযরত ওমর (রাঃ) ইহুদিদের মদিনা থেকে সম্পূর্ণ বিতাড়িত করেন। এই একই তথ্য আগে লিখে বহু বার ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ অভিযোগ শুনতে হয়েছে। নাস্তিকরা নাকি ইসলামের নামে মিথ্যাচার করে। মুফতি সাহেবদের ইসলাম জানার যে উৎস নাস্তিকদেরও একই উৎস থেকে জানতে হয়। সেই উৎস থেকে জানা যায় কতটা ভয়ংকর ছিলো মুফতি সাহেব কথিত ‘ইহুদীদের শক্তি খর্ব’ করা। ইবনে হিশাম জানাচ্ছেন, খয়বার আক্রমনের সময় নবীজি ‘আল্লাহ আকবর’ শ্লোগান দেয়া সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, আমরা যখন কোন সম্প্রদায়ের আঙিনায় অবতীর্ণ হই তখন তাদের আর্তনাদ হয়ে উঠে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী (সীরাতুন নবী, ইবনে হিশাম, ৩ খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৪৭)।

মুফতি সাহেব ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, পরবর্তিতে ইতিহাসে এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি যে, কোনো মুসলমান শাসক কোনো ইহুদিকে মসজিদে নববীতে দূরের কথা মদিনায় প্রবেশেরও সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান সৌদি ক্রাউন প্রিন্স ইহুদী ব্লগার রাব্বি বিন তিসইউনকে মদিনায় মাসজিদে নববীতে ঢোকার সুযোগ করে দিল।… এই অভিযোগ সত্যি কিনা জানি না। তবে মুফতি সাহেবে ক্ষোভ ঘৃণা হিংসাটা তো সত্যি। একইভাবে একটা জাতীয় দৈনিকে ইহুদী ঘৃণাকে প্রমোট করাও সত্যি। অথচ সামান্য ঢাকা ক্লাবে কাউকে ঢুকতে না দিলে তার প্রতিক্রিয়ায় আমরা ক্লাব কর্তৃপক্ষকে প্রতিক্রিয়াশীল, বর্ণবাদী, ঘৃণা-বিদ্বেষের অভিযোগে অভিযুক্ত করি। অথচ মক্কা-মদিনাতে কোন অমুসলমানের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এই ঘৃণার উৎস সরাসরি কুরআন শরীফে থেকে এসেছে। কুরআনে আছে, হে ঈমানদারগণ! মুশরিকরা তো অপবিত্র। সুতরাং এ বছরের পর তারা যেন মসজিদুল-হারামের নিকট না আসে। আর যদি তোমরা দারিদ্রের আশংকা কর, তবে আল্লাহ চাইলে নিজ করুনায় ভবিষ্যতে তোমাদের অভাবমুক্ত করে দেবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়(৯:২৮)।

কুরআনের এই ঘৃণাকে আড়াল করতে কেউ কেউ দাবী করেন, অপবিত্র বলতে এখানে ঘৃণা অর্থে বুঝানো হয়নি, মুশরিকরা পাকসাফ করে বাইতুল্লাহ’র সামনে আসত না বলেই তখন এই আদেশ দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু এটি ডাঁহা মিথ্যা একটি দাবী। কারণ ২৮ নাম্বার আয়াত দ্বারা তাফসিরকারকরা মত দিয়েছেন কাফির বা অমুসিলমদের সঙ্গে সামাজিকভাবে হাত মেলাতে হলে পরে হাতটি ধুয়ে ফেলতে হবে কারণ ২৮ নম্বার আয়াত বলছে কাফিররা অপবিত্র(দেখুন: ইবনে কাথিরের তাফসির, খন্ড-৮ম,৯ম,১০ম,১১শ পৃষ্ঠা নং-৬৭৪)।

কুরআনের এই আয়াত নাযিল হবার পর মুসলমানরা নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যে মার খাওয়ার আশংকা করেছিলো। কারণ হজের সময় আশেপাশের বহু মানুষ এখানে আসত কাবাঘর তাওহাফ করতে। কাবাঘর তো ছিলো আরব হিন্দুদের (পৌত্তলিক অর্থে) মন্দির। বছরে সবচেয়ে বড় তীর্থ (হজ) উপলক্ষে মক্কার বাইরে থেকে আগত অতিথিদের কাছে ভাল বিক্রি হতো। কিন্তু মক্কায় কাফিরদের প্রবেশ বন্ধ করে দিলে সেটা সম্ভব হবে না। মতলববাজ ইসলামপন্থিদের মিথ্যাচার ধরা পরে এরপরের আয়াতেই যেখানে আল্লাহ বলছেন, ‘তোমরা এ ব্যপারে কোনই ভয় করো না, আল্লাহ তোমাদের আরও বহু পন্থায় দান করবেন। আহলে কিতাবের থেকে তোমাদের জন্য জিজিয়া কর আদায় করে দেবেন ও তোমাদেরকে সম্পদশালী করবেন। তোমাদের জন্য কোনটা বেশী কল্যাণকর তা আল্লাহই ভাল জানেন। তার নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞা সবটাই নিপুণতাপূণ। এ ব্যবসা তোমাদের জন্য যতটা না লাভজনক, তার চেয়ে অনেক বেশী লাভজনক ঐ আহলে কিতাবীদের কাছ থেকে জিজিয়া আদায় করা যারা আল্লাহ ও তার রাসুলকে অস্বীকারকারী”।

আসল গোমড় পুরোটাই ফাঁস হলো এখানে। আল্লাহ মুসলমানদের বলছেন ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাওয়ার চাইতে জিজিয়া আর গণিমত মাল অনেক লাভজনক। ঠিকই তো, ডাকাতি করে রাতারাতি বড়লোক হওয়া যাবে- কিন্তু সৎ পথে ব্যবসা করে পেটে-ভাতে খেয়ে পরে বাঁচাই কঠিন। মুশরিকরা অপবিত্র বলতে আল্লাহ যে তাদের কি চোখে দেখেন তারপরও পরিস্কার করে বলার কিছু নেই। যে আল্লাহ অমুসলিম নিরহ নারীদের গণিমতের মাল করে মুসলমানদের যৌনদাসী করতে প্ররোচিত করছে, তাদের সম্পত্তি লুট করতে আশ্বাস দিচ্ছে তার তো পুরো অন্তর জুড়েই ঘৃণা! যে ঘৃণা আজ পর্যন্ত জারি রাখা হয়েছে এই একুশ শতক পর্যন্ত। আর এই ঘৃণা থেকে বেরিয়ে আসার সত্যই যদি কোন চেষ্টা হয়ে থাকে তার বিরোধীতা করে কোন লেখা কি করে একটি দেশের জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হতে পারে? অবশ্য ইহুদী ঘৃণা বাংলাদেশের পাসপোর্টে জ্বলজ্বল করে উল্লেখ করা আছে। বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলো ইজরাইল কিন্তু ‘মুসলিম বাংলা’ সেই স্বীকৃতি নিতে সেসময় অস্বীকার করে। মুসলমানদের কাছে অমুসলিমদের ঘৃণা করা তাদের ধর্মীয় অধিকার। আমরা ভারতে কিছু হিন্দু মন্দিরে নারী এবং তথাকথিত ছোটজাতের হিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেও কখনই সৌদির তথাকথিত দুই পবিত্র নগরীতে অমুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলি না। আমরা কুরআনে অমুসলমানদের সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া আয়াতকে হিংসামূলক বলাকে বিদ্বেষ নাম দিয়েছি। মক্কা-মদিনাতে কোন অমুসলমানের প্রবেশের বিরোধীতা করা কোন এক মুফতির লেখা গুরুত্ব দিয়ে ফেইসবুকে শেয়ার করি। অথচ সেই পত্রিকার সম্পাদক টকশোতে মানবাধিকারের জন্য রোজ চোখের জলে নাকের জলে এক করে ছাড়েন…। মুফতি সাহেব আর স্যুট পরিহত ক্লিন সেভড সম্পাদক তো আসলে একই ঘৃণার উৎস থেকে উৎপাদিত…।