উপমহাদেশের বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদের কথা! (পর্ব-১)

আমাদের উপমহাদেশের বিখ্যাত  পদার্থবিজ্ঞানীদের নিয়ে ধারাবাহিক এই সিরিজটি সম্পূর্ণভাবে মুক্তমনা বাংলা
বিজ্ঞান ব্লগ থেকে নেওয়া হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের নামকরা পদার্থবিজ্ঞানীদের
পাশাপাশি এই উপমহাদেশের পদার্থবিজ্ঞানীরাও এই দুনিয়াকে কম আলোড়িত করেন নি।
এ সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে হলে আপনাকে পড়তে হবে- তাদের নিয়ে প্রকাশিত এই
ধারাবাহিক পর্বগুগুলো।

প্রথম পর্বে থাকছে, নভোপদার্থবিজ্ঞানের নক্ষত্র খ্যাত সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর ভেস্কট রামন- কে নিয়ে………
famous scientist

বিগব্যাং থেকে বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি
হবার পর মহাবিশ্বে প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে অসংখ্য মহাজাগতিক

ঘটনা। লক্ষ
কোটি গ্যালাক্সির নক্ষত্রপুঞ্জ জ্বলতে জ্বলতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে- পাশাপাশি
সৃষ্টি হচ্ছে অসংখ্য ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ গহ্বর। এসব ঘটনা পৃথিবী থেকে এত
দূরে ঘটে যে ওখানকার আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে কখনো কখনো কোটি বছর লেগে
যায়। কিন্তু পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা হিসেব করে বের করে ফেলেছেন নক্ষত্রের
জন্ম-মৃত্যুর নাড়ি-নক্ষত্র। শুধু তাত্ত্বিক ভিত্তি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা
বিজ্ঞানের ধর্ম নয়। মহাকাশে ঠিক কী ঘটছে তা সরাসরি দেখার জন্য বিজ্ঞানীরা
প্রচন্ড শক্তিশালী যান্ত্রিক-চোখ – ‘অবজারভেটরি’ তৈরি করে নভোযানের মাধ্যমে
স্থাপন করেছেন মহাকাশে। তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের দৃশ্যমান তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কম বা
বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ঘটনা আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু মহাকাশের বেশির ভাগ
ঘটনাই ঘটে অদৃশ্য আলোক তরঙ্গে। তাই তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের দৃশ্যমান, গামা-রে,
এক্স-রে এবং ইনফ্রারেড-রে এই চার ধরনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য শনাক্ত করার জন্য
‘ন্যাশনাল এরোনটিক্‌স এণ্ড স্পেস এডমিনিস্ট্রেশান’ বা নাসা চারটি বড় বড়
অবজারভেটরি মহাকাশে স্থাপন করেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবজারভেটরি
যা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় এক লক্ষ চল্লিশ হাজার কিলোমিটার দূরে মহাকাশে
ভেসে ভেসে মহাজাগতিক ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করছে তার নাম ‘চন্দ্র এক্স-রে
অবজারভেটরি’। যাঁর নাম অনুসারে এই অবজারভেটরির নাম ‘চন্দ্র’ রাখা হয়েছে
তিনি নভোপদার্থবিজ্ঞানী সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর – বিজ্ঞানী মহলে যিনি
‘চন্দ্র’ নামে পরিচিত। ১৯৯৮ সালে নাসা নতুন এক্স-রে অবজারভেটরির জন্য নাম
আহ্বান করে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞান শিক্ষার্থী ও বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে। প্রায়
ছয় হাজার মানুষ চিঠি লিখে নাম পাঠান। এর মধ্যে বেশির ভাগই বিজ্ঞানী
চন্দ্রশেখরের নাম প্রস্তাব করেন। ১৯৯৮ সালের ২১ ডিসেম্বর নাসা’র সংবাদ
সম্মেলনে ঘোষণা করা হয় এক্স-রে অবজারভেটরির নাম ‘চন্দ্র’। অবজারভেটরি
সেন্টারের পরিচালক হার্ভি ট্যানানবাম বলেন, “বিশ্বব্রহ্মান্ডকে বোঝার জন্য
সারাজীবন নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন চন্দ্রশেখর” [1]। গ্রেট ব্রিটেনের
এস্ট্রোনোমার জেনারেল মার্টিন রীজের মতে – আইনস্টাইনের পর চন্দ্রই একমাত্র
ব্যক্তি যিনি মহাবিশ্ব নিয়ে এত দীর্ঘসময় ধরে এবং এত গভীরভাবে ভেবেছেন।
পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসনের মতে চন্দ্রশেখর মহাবিশ্বকে বুঝেছিলেন
আইনস্টাইনের চেয়েও সঠিকভাবে, কারণ আইনস্টাইন ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব স্বীকার
করেন নি। আর চন্দ্রশেখর ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন [2]।
নভোপদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৮৩ সালে। নক্ষত্রের ভরের সীমা
সংক্রান্ত যে গবেষণার জন্য চন্দ্রশেখর নোবেল পুরষ্কার পান সেই গবেষণার
সূত্রপাত হয়েছিল ভারতে – চন্দ্রশেখরের বয়স তখন মাত্র উনিশ বছর।

চন্দ্রশেখর নিজের জন্মতারিখ বলতেন
‘নাইন্টিন টেন নাইন্টিন টেন’ অর্থাৎ উনিশ দশ উনিশ শ’ দশ। ১৯১০ সালের ১৯
অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের লাহোরে (বর্তমানে পাকিস্তান) জন্ম চন্দ্রশেখরের।
তামিল রীতি অনুযায়ী বংশের বড় ছেলের নাম রাখা হয় পিতামহের নাম অনুসারে।
চন্দ্রশেখরের পিতামহ রামানাথন চন্দ্রশেখরন ছিলেন তামিলনাড়ুর বিশিষ্ট পন্ডিত
ও পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। তাঁর আট সন্তানের প্রথম সন্তান হলেন চন্দ্রশেখর
সুব্রাহ্মনিয়ান। (তামিল রীতি অনুসারে নামের আগে বাবার নাম বসে এবং কোন
পদবী থাকে না। যেমন চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়ান – অর্থাৎ চন্দ্রশেখরের পুত্র
সুব্রাহ্মনিয়ান।) সুব্রাহ্মনিয়ানের প্রথম পুত্রের নাম রাখা হয় চন্দ্রশেখর।
নামের আগে বাবার নাম যুক্ত হয়ে পুরো নাম হলো সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর।
চন্দ্রশেখরনের দ্বিতীয় পুত্র চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরামনই হলেন নোবেলবিজয়ী স্যার
সি ভি রামন।

চন্দ্রশেখরের বাবা সুব্রাহ্মনিয়ান ছিলেন
ব্রিটিশ সরকারের ফাইন্যান্সিয়াল সিভিল সার্ভিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। কাকা
ভেঙ্কটরামনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার আগপর্যন্ত ফাইন্যান্সিয়াল
সিভিল সার্ভিসে কাজ করতেন। ১৯১০ সালে চন্দ্রশেখরের জন্মের সময়
সুব্রাহ্মনিয়ান নর্থ ওয়েস্টার্ন রেলওয়ের ডেপুটি অডিটর জেনারেল হিসেবে
লাহোরে কর্মরত ছিলেন। সুব্রাহ্মনিয়ানের স্ত্রী সীতালক্ষ্মীর খুব কম বয়সে
বিয়ে হয়েছিল বলে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা খুব একটা হয়নি, কিন্তু শিক্ষিত
পরিবারের বউ হিসেবে শিক্ষার অনুকুল পরিবেশে এসে নিজে নিজেই পড়াশোনা চালিয়ে
গিয়েছেন। সুব্রাহ্মনিয়ান ও সীতালক্ষ্মীর মোট দশটি সন্তানের প্রথম দুইটি
কন্যাসন্তানের জন্মের পর প্রথম পুত্র চন্দ্রশেখরের জন্ম।

সুব্রাহ্মনিয়ানের বদলির চাকরির কারণে কয়েক
বছর পর পর তাঁদের বাসস্থান বদলে যেতো। ফলে চন্দ্রশেখরের প্রাথমিক পড়াশোনা
শুরু হয় বাড়িতেই। এগারো বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতে বাবা ও প্রাইভেট টিউটরের
কাছে পড়াশোনা করেছে চন্দ্রশেখর। ইচ্ছেমত গণিত ও ইংরেজির পাঠ নিয়েছে।
চন্দ্রশেখরের ১২ বছর বয়সের সময় তাঁর বাবা মাদ্রাজে স্থায়ীভাবে বাস করতে
শুরু করেন। মাদ্রাজের হিন্দু হাই স্কুলে চন্দ্রশেখরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
শুরু হলো বারো বছর বয়সে। কিন্তু স্কুলের বাধ্যতামূলক নীরস পড়াশোনা ভাল
লাগেনি চন্দ্রশেখরের [3]। ইতিহাস, ভূগোল, সামাজিক বিজ্ঞান ইত্যাদি নীরস
বিষয়ের সাথে সাথে ক’দিন পর পর ক্লাস টেস্ট, সেশনাল টেস্ট ইত্যাদি মোটেও ভাল
লাগেনি তার। কিন্তু এক বছর পরই স্কুলের সিস্টেম বুঝে ফেললো চন্দ্রশেখর।
স্কুলের সেরা ছাত্র হয়ে উঠতে মোটেও সময় লাগলো না। চৌদ্দ বছরে স্কুল
সার্টিফিকেট পাস করে চন্দ্রশেখর ভর্তি হলেন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে।

১৯২৪ সালে চন্দ্রশেখরের বাবা মাদ্রাজের
অভিজাত এলাকায় একটা বিরাট বাড়ি তৈরি করেন। বাড়িটার নাম রাখা হলো ‘চন্দ্র
ভিলা’। চন্দ্রশেখরের পনেরো বছর বয়সে চন্দ্রভিলায় উঠে আসেন পরিবারের সবাই।
রেলওয়ের চাকরির সুবাদে পরিবারের সবার জন্য ফ্রি রেল-পাস পেতেন
সুব্রাহ্মনিয়ান। তিনি প্রতিবছর নতুন নতুন জায়গায় বেড়াতে যেতেন সবাইকে নিয়ে।
এভাবে ভারতের প্রায় সব অঞ্চলেই যাওয়ার সুযোগ হয় চন্দ্রশেখরের। ইতোমধ্যে
মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিতে ডিস্টিংশান
সহ উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেন চন্দ্রশেখর। এবার গণিত বিষয়ে অনার্স পড়ার ইচ্ছে
তাঁর। ভারতীয় গণিতবিদ রামানুজনের গাণিতিক প্রতিভায় মুগ্ধ চন্দ্রশেখর। মনে
মনে রামানুজনকেই আদর্শ মানেন তিনি। বাবাকে বিশুদ্ধ গণিত নিয়ে পড়ার ইচ্ছের
কথা জানাতেই রেগে গেলেন বাবা সুব্রাহ্মনিয়ান। পড়াশোনা, চিন্তা ও সংস্কৃতিতে
অনেক উদারমনা হলেও পারিবারিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে খুবই কর্তৃত্বপরায়ন
ছিলেন সুব্রাহ্মনিয়ান। তিনি চান চন্দ্রশেখর আই-সি-এস পরীক্ষা পাস করে
ব্রিটিশ সরকারের আমলা হোক। কিন্তু চন্দ্রশেখর বাবার ইচ্ছের কাছে নতি
স্বীকার করার পাত্র নন। তাঁর বাড়িতেই তো উদাহরণ আছে। তাঁর কাকা ভেঙ্কটরামন
বিজ্ঞানের গবেষণা করার জন্য একাউন্ট্যান্ট জেনারেলের পদ ছেড়ে দিয়ে
অর্ধেকেরও কম বেতনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে যোগ দিয়েছেন।
সুব্রাহ্মনিয়ান ছেলের যুক্তিতে কিছুটা দমে গেলেন। বললেন পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে
পড়াশোনা করলে তবু কিছুটা ভবিষ্যৎ আছে, কিন্তু বিশুদ্ধ গণিতের কোন ভবিষ্যৎ
নেই ভারতবর্ষে। বাবার ইচ্ছেয় পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে বিএসসিতে ভর্তি
হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে।

১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় কাকার
কাছে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন চন্দ্রশেখর। কাল্টিভেশান সেন্টারের ল্যাবে যখন
রামন ইফেক্ট আবিষ্কারের পরীক্ষাগুলো করছিলেন কৃষ্ণান তখন চন্দ্রশেখর
প্রতিদিনই ল্যাবে যেতেন। কাকা রামনও খুব খুশি বিজ্ঞানের প্রতি চন্দ্রশেখরের
গভীর আগ্রহ দেখে। সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ চন্দ্রশেখরের সাথে গভীর বন্ধুত্ব হয়ে
গেলো বিজ্ঞানী কৃষ্ণানের। চন্দ্রশেখর চোখের সামনেই দেখলেন একটা নোবেল
বিজয়ী বিজ্ঞান-গবেষণা কীভাবে সম্পন্ন হয়। সেবছর অক্টোবর মাসে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সিরিজ বক্তৃতা দিয়ে মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে
বক্তৃতা দিতে এলেন আর্নল্ড সামারফেল্ড। কলকাতা থেকে এ ব্যাপারে
চন্দ্রশেখরকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন কৃষ্ণান। এত বড় একজন পদার্থবিজ্ঞানীর
লেকচার শুনতে পারবেন ভেবে চন্দ্রশেখর ভীষণ উত্তেজিত। তিনি ইতোমধ্যেই পড়ে
ফেলেছেন সামারফেল্ডের বিখ্যাত বই ‘এটমিক স্ট্রাকচার এন্ড স্পেকট্রা
লাইন্‌স’। শুধু পড়া নয় – বইতে বর্ণিত সমস্যাগুলোর সমাধানও করে ফেলেছেন নিজে
নিজে। সামারফেল্ডের বক্তৃতার পরের দিন আত্মবিশ্বাসী তরুণ চন্দ্রশেখর
হোটেলে গিয়ে দেখা করলেন সামারফেল্ডের সাথে। চন্দ্রশেখরের আগ্রহ আর এত কম
বয়সেই পরমাণুর গঠন সম্পর্কিত জটিল ধারণাগুলো আয়ত্ব করে ফেলার ক্ষমতা দেখে
মুগ্ধ হলেন সামারফেল্ড। কিন্তু তিনি যখন বললেন তাঁর ‘এটমিক স্ট্রাকচার’
বইতে বর্ণিত কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তত্ত্বগুলো ইতোমধ্যেই পুরনো হয়ে গেছে –
স্তম্ভিত হয়ে গেলেন চন্দ্রশেখর। সামারফেল্ড অনেকক্ষণ ধরে কোয়ান্টাম
মেকানিক্সের সাম্প্রতিক আবিষ্কারের কথা বললেন চন্দ্রশেখরকে। বললেন
শ্রোডিংগার, হাইজেনবার্গ, ডিরাক ও পাউলি’র নতুন কোয়ান্টাম তত্ত্বের কথা।
চন্দ্রশেখর ম্যাক্সওয়েল-বোল্টজম্যান এর ক্লাসিক্যাল স্ট্যাটিস্টিক্‌স
আত্মস্থ করেছেন ইতোমধ্যে। কিন্তু সামারফেল্ড জানালেন
ম্যাক্সওয়েল-বোল্টজম্যান তত্ত্বেও পরিবর্তন আসছে। সামারফেল্ড কোয়ান্টাম
মেকানিক্সের আলোকে ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিস্টিক্‌স সম্পর্কিত তাঁর
প্রকাশিতব্য একটা গবেষণাপত্রের প্রুফ পড়তে দিলেন চন্দ্রশেখরকে। কোয়ান্টাম
তত্ত্বের আলোকে পদার্থের ইলেকট্রন তত্ত্বের ওপর প্রথম পেপারটি পড়ে ফেললেন
চন্দ্রশেখর প্রকাশিত হবার আগেই।

সামারফেল্ডের সাথে সাক্ষাতের পর
পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় নিজেকে সঁপে দেয়ার ব্যাপারে আর কোন দ্বিধাবোধ
থাকলো না। কয়েক মাসের মধ্যেই ১৯২৮ সালে ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্সে
প্রকাশিত হলো চন্দ্রশেখরের প্রথম গবেষণাপত্র ‘থার্মোডায়নামিক্স অব দি
কম্পটন ইফেক্ট উইথ রেফারেন্স টু দি স্টার্‌স’ [4]। তারপর সামারফেল্ডের সাথে
আলোচনা ও তাঁর ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিস্টিক্‌স এর পেপারটির ওপর ভিত্তি করে
দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটি রচনা করেন চন্দ্রশেখর। ‘দি কম্পটন স্ক্যাটারিং এন্ড
দি নিউ স্ট্যাটিস্টিক্‌স’ শিরোনামের পেপারটির বিষয়বস্তুর নতুনত্ব ও
গুরুত্বের কথা চিন্তা করে চন্দ্রশেখর ভাবলেন পেপারটি রয়েল সোসাইটির
প্রসিডিংস এ প্রকাশ করবেন। কিন্তু রয়েল সোসাইটির কোন ফেলোর সুপারিশ ছাড়া
রয়েল সোসাইটিতে প্রকাশের জন্য কোন গবেষণাপত্র বিবেচিত হয় না। চন্দ্রশেখর
চাইলেই তাঁর কাকা ভেঙ্কটরামনের মাধ্যমে পেপারটি রয়েল সোসাইটিতে পাঠাতে
পারেন। কিন্তু তিনি চাননি ব্যক্তিগত পরিচিতি কাজে লাগাতে। মাদ্রাজ
ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে গিয়ে নতুন আসা সায়েন্টিফিক জার্নাল খুঁজে দেখলেন
রয়েল সোসাইটির ফেলো রাল্‌ফ ফাওলার ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিস্টিক্‌স কাজে
লাগিয়ে শ্বেত-বামনের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। চন্দ্রশেখর জার্নাল থেকে
ঠিকানা নিয়ে রাল্‌ফ ফাওলারের কাছে তাঁর পেপারটি পাঠিয়ে দিলেন। ফাওলার এত
উঁচুমানের পেপার পেয়ে খুশি হয়েই রয়েল সোসাইটিতে পাঠিয়ে দিলেন। ১৯২৯ সালে
রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস এ প্রকাশিত হলো চন্দ্রশেখরের দ্বিতীয় গবেষণাপত্র
[5]। ১৯৩০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স পাস করার আগেই চন্দ্রশেখরের আরো দুটো
পেপার প্রকাশিত হয় ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে।

এদিকে ১৯২৯ সালের অক্টোবর মাসে ভারত সফরে
আসেন পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটিতেও একটা
লেকচার দেবেন তিনি। কৃষ্ণানের সূত্রে মাদ্রাজে হাইজেনবার্গকে মাদ্রাজ
ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব পড়লো চন্দ্রশেখরের ওপর। উনিশ বছরের তরুণ
চন্দ্রশেখরের জ্ঞানের গভীরতা ও জ্ঞান-তৃষ্ণা দেখে হাইজেনবার্গও মুগ্ধ।

প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষক ও
শিক্ষার্থীদের সবাই মুগ্ধ চন্দ্রশেখরের প্রতিভা ও গবেষণাকাজে। সবাইকে
ছাড়িয়ে অন্যরকম মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে গেছে তখন আরো একজন – ললিতা। ললিতা
দোরাইস্বামী।। চন্দ্রশেখরদের বাড়ির কাছেই বাড়ি ললিতাদের। সেও পড়ে
প্রেসিডেন্সি কলেজে, চন্দ্রশেখরের এক ইয়ার জুনিয়র। তারও বিষয়
পদার্থবিজ্ঞান। চন্দ্রশেখরের তরুণ বৈজ্ঞানিক মস্তিষ্কেও ভালবাসা জন্মালো
ললিতার জন্যে।

১৯৩০ সালের জানুয়ারি মাসে এলাহাবাদে
ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস এসোসিয়েশানের কনফারেন্সে গেলেন চন্দ্রশেখর।
সেখানে তাঁর সাথে পরিচয় হয় প্রফেসর মেঘনাদ সাহার। রয়েল সোসাইটি থেকে
প্রকাশিত চন্দ্রশেখরের পেপারটি পড়ে মেঘনাদ সাহা খুব খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু
তিনি ভাবতেই পারেন নি যে এত গুরুত্বপূর্ণ পেপারটির লেখকটির বয়স এত কম।
চন্দ্রশেখরকে আন্তরিকভাবে নিজের গ্রুপের গবেষকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
কনফারেন্সে সারা ভারত থেকে আগত বড় বড় বিজ্ঞানীর সম্মানে নিজের বাড়িতে ডিনার
পার্টি দিয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা। চন্দ্রশেখরও সমান সম্মানে নিমন্ত্রিত হলেন
সেই পার্টিতে। সেদিন ভারতের প্রায় সব বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সভায় স্থান পাওয়া
১৯ বছর বয়সী চন্দ্রশেখরের জন্য একটা বিরাট অনুপ্রেরণা। আর এ অনুপ্রেরণায়
ইন্ধন জুগিয়েছিলেন অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা।

এলাহাবাদ থেকে ফেরার কয়েকদিন পর
প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রিন্সিপালের অফিসে ডাক পড়লো চন্দ্রশেখরের।
প্রিন্সিপাল ফিলিপ ফাইসন একটা গোপন খবর দিলেন চন্দ্রশেখরকে। তিনি জানালেন
ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করার জন্য গভমেন্ট অব ইন্ডিয়া চন্দ্রশেখরকে একটা বৃত্তি
দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একটা বিশেষ ধরনের বৃত্তি- যেন চন্দ্রশেখরের জন্যই
তৈরি করা হয়েছে। ১৯৩০ সালের ২২শে মে স্কলারশিপের অফিসিয়াল চিঠি হাতে এলো
চন্দ্রশেখরের। চন্দ্রশেখর সিদ্ধান্ত নিলেন কেমব্রিজে গিয়ে প্রফেসর রাল্‌ফ
ফাওলারের তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করবেন।

ইংল্যান্ডে গিয়ে পড়াশোনা করতে চাইলেই করা
যেতো না তখন। কত রকমের সরকারি অনুমতি নিতে হতো। আর খরচ তো আছেই। কিন্তু
চন্দ্রশেখরের বেলায় কিছুই করতে হলো না। মনে হচ্ছে ব্রিটিশ সরকারই যেন সব
করে দিলো তাঁর জন্য। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো অন্য জায়গায়। ১৯২৮ সাল থেকে
চন্দ্রশেখরের মায়ের শরীর ভালো যাচ্ছিলো না। দু’বছর ধরে সব রকমের চিকিৎসাই
চললো। কিন্তু অবস্থা কেবল খারাপের দিকেই যাচ্ছে। ডাক্তার যা বললেন তাতে
তিনি যে আর সুস্থ হয়ে উঠবেন তা মনে হয় না। মাকে এ অবস্থায় ফেলে বিদেশে
যাওয়া কোন মতেই সম্ভব নয়। আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব সবাই বলছেন ইংল্যান্ড
যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে। চন্দ্রশেখর বুঝতে পারছেন না কী করবেন। এ
অবস্থায় এগিয়ে এলেন চন্দ্রশেখরের মা নিজে। তিনি নিজের শরীরের অবস্থা জানেন।
কখন মারা যাবেন কোন ঠিক নেই – কিন্তু তার জন্য ছেলে এত বড় একটা সুযোগ
পেয়েও কাজে লাগাবে না? তিনি ছেলেকে বোঝালেন যে তাঁকে দেখার জন্য তাঁর আরো
তিনটা ছেলে আর ছয়টা মেয়ে আছে দেশে। অবশেষে ১৯৩০ সালের ৩১ জুলাই ইংল্যান্ডের
উদ্দ্যেশ্যে জাহাজে চড়ে বসলেন চন্দ্রশেখর। বাষ্পচালিত জাহাজটির নাম এস এস
পিল্‌সনা।

প্রফেসর ফাওলারের শ্বেতবামন তত্ত্ব
সংক্রান্ত যত পেপার প্রকাশিত হয়েছে তার সবগুলোই গভীর মনযোগ দিয়ে পড়েছেন
চন্দ্রশেখর কেমব্রিজে যাওয়ার আগেই। ফাওলারের তত্ত্ব সম্প্রসারণ করে নিজেই
একটা পেপার লিখে সাথে নিয়েছিলেন জাহাজে ওঠার আগে। আর জাহাজে বসে হাত দিলেন
নতুন আরেকটি পেপার লেখার কাজে। প্রফেসর রাল্‌ফ ফাওলার শ্বেত-বামন তারার
ধর্মাবলী ব্যাখ্যা করেছেন ফার্মি-ডিরাক সংখ্যায়ন ব্যবহার করে। যে সব তারা
জ্বলতে জ্বলতে তাদের নিউক্লিয়ার শক্তি নিঃশেষ করে ফেলেছে – সাধারণত সেই সব
তারাদের হোয়াইট ডোয়ার্ফ বা শ্বেত-বামন তারা বলা হয়। এই তারাগুলোর
মাধ্যাকর্ষণ-বল এত বেড়ে যায় যে তাদের ঘনত্ব সাধারণ পদার্থের চেয়ে প্রায়
হাজার হাজার গুণ বেশি হয়ে পড়ে। ঘনত্ব বেড়ে গিয়ে আয়তনে ছোট হয়ে যাবার পর
তারা তাপ বিকিরণ করে আস্তে আস্তে ঠান্ডা হতে শুরু করে। ফাওলার শ্বেত-বামনের
ভর ও ঘনত্বের মধ্যে গাণিতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন যা সেই
সময়ের পরীক্ষামূলক ফলাফলের সাথে মিলে যায়।

পিল্‌সনা জাহাজে বসে চন্দ্রশেখর নতুন করে
ভাবতে শুরু করলেন শ্বেত-বামনের ঘনত্ব ও ভর নিয়ে। চন্দ্রশেখর দেখলেন ফাওলার
ইলেকট্রনকে নন-রিলেটিভিস্টিক বা অনাপেক্ষিক কণা হিসেবে ধরে নিয়ে হিসেবের
মধ্যে নিউটনিয়ান মেকানিক্স প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু শ্বেত-বামনের কেন্দ্রে যে
ইলেকট্রনগুলো এত জোরে ছুটে বেড়াচ্ছে যে তারা কিছুতেই অনাপেক্ষিক থাকতে
পারে না। আইনেস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এখানে প্রয়োগ করতেই হবে। তারাদের
একটা নির্দিষ্ট রাসায়নিক গঠন ধরে নিয়ে ফাওলার হিসেব করে দেখিয়েছেন
শ্বেতবামনের ঘনত্ব হবে ভরের বর্গের সমানুপাতিক। একটু ভেবে দেখলেই এর সত্যতা
বোঝা যায়। তারার ভর যত বেশি হবে মাধ্যাকর্ষণ বল তত বেশি হবে ফলে তারার
ভেতরের পদার্থগুলো ঘন হয়ে নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে যাবে – আর ঘনত্ব বেড়ে যাবে।
ফলে তারার আয়তন খুব কমে যাবে। এত ছোট হয়ে যাবে যে তাদের আর দেখা যাবে না।
সে কারণেই সূর্যের চেয়ে বেশি ভরের কোন শ্বেত-বামন তারা দেখা যায় না।
চন্দ্রশেখর আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রয়োগ করে দেখলেন ভরের তুলনায়
শ্বেত-বামনের ঘনত্ব ফাওলারের হিসেবের তুলনায় আরো অনেক বেড়ে যায়। ভর বৃদ্ধির
সাথে ঘনত্বের দ্রুত বৃদ্ধিই শুধু হয় না, একটা নির্দিষ্ট ভরের বেশি হলে
ঘনত্বের পরিমাণ হয়ে যায় অসীম। ভরের এই নির্দিষ্ট সীমা-ই পরে ‘চন্দ্রশেখর
লিমিট’ হিসেবে গৃহীত হয়। ভরের এই সীমা তারার রাসায়নিক উপাদানের উপর নির্ভর
করে। চন্দ্রশেখর জাহাজে বসে ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর আগেই লিখে শেষ করলেন তাঁর
পেপার “দি ম্যাক্সিমাম মাস অব আইডিয়েল হোয়াইট ডোয়ার্ফ”। চন্দ্রশেখর হিসেব
করে দেখিয়েছিলেন যে কোন শ্বেত-বামনের ভর সূর্যের ভরের শতকরা ৯০ ভাগের বেশি
হলে তার ঘনত্ব অসীম হয়ে যাবে। পরে অবশ্য এই মান কিছুটা পরিবর্তিত হয়।
বর্তমানে চন্দ্রশেখর লিমিট হলো সূর্যের ভরের দেড়গুণ। ৫৩ বছর পর ১৯৮৩ সালে
চন্দ্রশেখর নোবেল পুরষ্কার পান এই কাজের জন্য যা তিনি করেছিলেন ১৯ বছর বয়সে
ভারত থেকে ইংল্যান্ড যাবার পথে জাহাজে বসে।

কেমব্রিজে গিয়ে প্রফেসর ফাওলারের সাথে
দেখা করলেন চন্দ্রশেখর। ফাওলার ছিলেন ডিরাকের সুপারভাইজার। চন্দ্রশেখরের
আগের বছর হোমি ভাবাও গবেষণা শুরু করেছেন ফাওলারের তত্ত্বাবধানে।
চন্দ্রশেখরের সাথে ভাবার বন্ধুত্ব হয়ে যায় কয়েকদিনের মধ্যেই। ফাওলারের সাথে
দেখা করেই চন্দ্রশেখর নতুন লেখা পেপারদুটো দেখালেন। প্রথম পেপার যেটাতে
ফাওলারের কাজকে বিস্তৃত করা হয়েছে তা খুশি মনে মেনে নিলেন ফাওলার এবং রয়েল
সোসাইটির প্রসিডিংস এ প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় পেপার
যেটাতে চন্দ্রশেখর ভরের সীমা হিসেব করেছেন – সেটা নিয়ে ফাওলার দ্বিধান্বিত
হয়ে পড়লেন। ফাওলার বললেন পেপারটা এডওয়ার্ড মিলনি’র কাছে পাঠিয়ে মতামত নিতে।
কিন্তু কয়েক মাস পরেও ফাওলার বা মিলনির কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেলো না
পেপারটির ব্যাপারে। চন্দ্রশেখর বুঝতে পারলেন যে ফাওলার হয়তো চাচ্ছেন না যে
পেপারটি এখন প্রকাশিত হোক। চন্দ্রশেখর আর অপেক্ষা করলেন না। পেপারটির ছোট
একটা সংস্করণ (মাত্র দুই পৃষ্ঠা) পাঠিয়ে দিলেন আমেরিকার এস্ট্রোফিজিক্যাল
জার্নালে। পরের বছর এস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হলো চন্দ্রশেখরের
বিখ্যাত গবেষণাপত্র [6]।

কেমব্রিজের প্রথম বর্ষে চন্দ্রশেখর পল
ডিরাকের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ক্লাসগুলো করলেন মনযোগ দিয়ে। পল ডিরাক
যন্ত্রের মত মানুষ। প্রয়োজনের বাইরে একটা বাক্যও ব্যয় করেন না। সেকেন্ড
সেমিস্টারে ফাওলার দীর্ঘ ছুটিতে গেলে পল ডিরাক হলেন চন্দ্রশেখরের
ভারপ্রাপ্ত সুপারভাইজার। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম জনকের কাছে
কোয়ান্টাম মেকানিক্স শিখতে পেরে খুবই খুশি হলেন চন্দ্রশেখর। চন্দ্রশেখরের
গবেষণা সম্পর্কে তেমন কোন আগ্রহ দেখাননি পল ডিরাক। তবে মাসে একবার নিয়ম করে
নিজের অফিসে চা খেতে ডাকতেন চন্দ্রশেখরকে। রিলেটিভিস্টিক আয়োনাইজেশান ও
মহাকাশ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাবার সময় চন্দ্রশেখরের সাথে পরিচয় হলো বিশিষ্ট
নভোপদার্থবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড মিল্‌নির সাথে। প্রফেসর মিলনি চন্দ্রশেখরের
গবেষণার সাথে ইতোমধ্যেই পরিচিত। দু’জনের মধ্যে গবেষণা সহযোগিতা গড়ে উঠলো।
চন্দ্রশেখরের গবেষণার স্বীকৃতি পেতে দেরি হলো না। ট্রিনিটি কলেজের একটা
সম্মানজনক পুরষ্কার পেলেন তিনি। পুরষ্কারের আর্থিক মূল্য চল্লিশ পাউন্ড।
পুরষ্কার পাবার পর চন্দ্রশেখরকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখলেন স্বয়ং আর্থার
এডিংটন- নভোপদার্থবিজ্ঞানে যাঁকে ‘গুরু’ মানা নয়। এডিংটন চন্দ্রশেখরকে ১৯৩১
সালের ২৩ মে তারিখে অফিসে এসে তাঁর দেখা করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।
চন্দ্রশেখর যেন চাঁদ হাতে পেলেন।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার আর্থার এডিংটন
ছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো অবজারভেটরির পরিচালক। সেই সময়ে
এস্ট্রোনমিতে স্যার এডিংটনের অবদান এবং অর্জন এমন ছিল যে এ বিষয়ে তাঁর কথাই
সবাই শেষ কথা হিসেবে মেনে নিতো সবাই। এমন এক ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে
নিমন্ত্রণ পেয়ে খুব খুশি চন্দ্রশেখর নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছিলেন এডিংটনের
সাথে কী নিয়ে আলোচনা করবেন ইত্যাদি। এমন সময় ২১ মে তারিখে চন্দ্রশেখরের
হাতে একটা টেলিগ্রাম এসে পৌঁছালো। চন্দ্রশেখরের মা মারা গেছেন। চন্দ্রশেখর
সপ্তাহে দুটো করে চিঠি লিখতেন তাঁর বাবার কাছে। কেমব্রিজে কী কী ঘটছে তার
সব খুঁটিনাটি বর্ণনা থাকতো তাতে। মায়ের কাছেও চিঠি লিখতেন তামিল ভাষায়।
মায়ের শরীর ক্রমশ খারাপ হচ্ছিলো তা জানতেন চন্দ্রশেখর। কিন্তু মায়ের
মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না একটুও। নিজে নিজেই সহ্য করলেন দুঃসহ কষ্ট।
নদীর তীরে বসে কাঁদলেন নীরবে [3]। তারপর যুক্তি দিয়ে নিজেকে বুঝিয়ে গবেষণায়
মন দেবার চেষ্টা করলেন। দু’দিন পরে নির্দিষ্ট সময়ে দেখা করলেন স্যার
এডিংটনের সাথে।

মায়ের মৃত্যুর পর কেমব্রিজে মন বসাতে কষ্ট
হচ্ছিলো চন্দ্রশেখরের। গ্রীষ্মে ছুটি নিয়ে ইউরোপে ঘুরে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত
নিলেন। কিন্তু ইউরোপে গিয়ে ঘুরে বেড়ানোর বদলে জার্মানির গটিনগেন
ইউনিভার্সিটিতে ম্যাক্স বর্নের সাথে গবেষণায় লেগে গেলেন। সেপ্টেম্বরে সেখান
থেকে ফিরে এসে আবার কাজে লেগে পড়লেন। এস্ট্রোফিজিক্সে তাঁর অনেকগুলো পেপার
প্রকাশিত হয়েছে ইতোমধ্যেই। কিন্তু মনে মনে তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। তিনি পড়তে
চেয়েছিলেন ভৌত গণিত। কিন্তু বাবার ইচ্ছেয় পদার্থবিজ্ঞান পড়তে এসে
ঘটনাচক্রে কাজ করছেন এস্ট্রোফিজিক্সে। কিন্তু তাঁর মূল ভালবাসা যে গণিত তা
প্রয়োগের সুযোগ এখানে সীমিত। তাঁর ইচ্ছে করছে বিষয় বদলে তত্ত্বীয়
পদার্থবিজ্ঞানের দিকে চলে যেতে যেখানে গণিতের ব্যাপক ব্যবহার আছে।
ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে মূলধারার পদার্থবিজ্ঞানীদের মেলা। সেখানে যোগ দিতে
ইচ্ছে করছে তাঁর। কিন্তু চন্দ্রশেখর কাউকে বলতে পারছেন না তাঁর মনের কথা।
কথাপ্রসঙ্গে একদিন ডিরাককে বললেন যে তাঁর একঘেয়ে লাগছে কেমব্রিজের জীবন।
ডিরাক তাঁকে পরামর্শ দিলেন কোপেনহেগেনে নিল্‌স বোরের ইনস্টিটিউটে গিয়ে
কিছুদিন কাজ করার জন্য। চন্দ্রশেখর ডিরাকের পরামর্শ মেনে চলে গেলেন
কোপেনহেগেনে। কেমব্রিজের ফর্মাল পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন নিল্‌স বোরের
ইনস্টিটিউট। এখানকার চমৎকার মানবিক ও উষ্ণ পরিবেশে এসে যেন প্রাণ ফিরে
পেলেন চন্দ্রশেখর।

ডিরাক ফার্মি-ডিরাক সংখ্যায়নের একটা
সমস্যার কথা বলেছিলেন চন্দ্রশেখরকে। কোপেনহেগেনে এসে চন্দ্রশেখর সমস্যাটির
সমাধান করতে বসলেন। দুইয়ের অধিক কণার ওপর প্রয়োগ করতে গেলে ফার্মি-ডিরাক
সংখ্যায়নের কী কী পরিবর্তন করতে হবে – সেটাই ছিল সমস্যা। বেশ কিছুদিন কাজ
করার পর চন্দ্রশেখর সমস্যাটির সমাধান করে ফেললেন। দ্রুত লিখে ফেললেন একটা
পেপার। নিল্‌স বোর পেপারটি পড়ার পর সন্তুষ্ট হয়ে রয়েল সোসাইটিতে প্রকাশের
জন্য পাঠিয়ে দিলেন। চন্দ্রশেখর ভাবলেন এস্ট্রোফিজিক্স থেকে থিওরেটিক্যাল
ফিজিক্সে চলে আসার এটাই সুযোগ। স্বয়ং ডিরাকের একটা সমস্যার সমাধান করে ফেলা
নিশ্চয় সহজ কথা নয়। কিন্তু তাঁর আশার গুড়ে বালি ঢেলে দিলেন ডিরাক।
চন্দ্রশেখরের সমাধানে একটা বিরাট ভুল বের করে ফেললেন ডিরাক। চন্দ্রশেখর
ব্যাপারটা বুঝতে পারার পর রয়েল সোসাইটি থেকে তাঁর পেপারটা প্রত্যাহার করে
নিলেন। ১৯৩৩ সালের আগস্টে তাঁর স্কলারশিপ শেষ হয়ে যাবে। তার আগেই পিএইচডি
থিসিস জমা দিতে হবে। নিজের প্রকাশিত পেপারগুলো নিয়ে বসলেন থিসিস রেডি করতে।

প্রফেসর ফাওলার জানতেন চন্দ্রশেখরের জন্য
পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়াটা শুধুমাত্র একটা আনুষ্ঠানিকতা। কারণ চন্দ্রশেখর
ছাত্রাবস্থায় যতগুলো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন কেমব্রিজের অনেক অধ্যাপকেরও
ততটা গবেষণাপত্র নেই। পিএইচডি’র ব্যবস্থা তো হলো। কিন্তু তারপর কী হবে?
চন্দ্রশেখর নিজের বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছেন। স্কলারশিপ শেষ হবার আগেই
একটা কাজের ব্যবস্থা করতে না পারলে ভারতে ফিরে যেতে হবে। বাবাও চাপ দিচ্ছেন
দেশে ফিরে যেতে। কিন্তু এখনি ভারতে ফিরতে চান না তিনি। বাবাকে লেখা চিঠিতে
সরাসরি জানিয়ে দিলেন, “যদি বিএসসি ক্লাসে গিয়ে হুইটস্টোন ব্রিজ পড়াতে হয়
আর প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করাতে হয়, তবে এসবের চেয়ে মেক্সিকোর ইতিহাস পড়ানোই
ভাল হবে” [7]। চন্দ্রশেখর ভাবছেন কীভাবে ইউরোপে থাকা যায়। কোপেনহেগেন ও
কেমব্রিজে তাঁর বৈজ্ঞানিক যোগাযোগ তৈরি হয়েছে অনেক। দরকার হলে কাজে
লাগাবেন। এর মধ্যে স্কলারশিপের টাকা থেকে যা জমেছে তাতে কোন উপার্জন ছাড়াই
আরো ছয় মাস থাকা যাবে ইউরোপে। দরকার হলে তাই করবেন। এর মধ্যে একদিন
ট্রিনিটি কলেজের ফেলোশিপের বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়লো। বিজ্ঞানের সব শাখার জন্যই
উন্মুক্ত এই ফেলোশিপ। এটা যদি হয়ে যায় তাহলে আরো চার বছর কেমব্রিজে থাকা
যাবে। বছরে তিন শ’ পাউন্ড বৃত্তি, ট্রিনিটি কলেজের হোস্টেলে ফ্রি থাকার
ব্যবস্থা, ডায়নিং হলের উঁচু-টেবিলে বসে খাওয়ার সুযোগ। কিন্তু প্রতিযোগিতা
এত তীব্র যে প্রফেসর ফাওলারও কোন আশা দেখতে পেলেন না চন্দ্রশেখরের
ব্যাপারে।

কিন্তু আশাতীত ভাবে ট্রিনিটি কলেজের
ফেলোশিপ পেয়ে গেলেন চন্দ্রশেখর। রামানুজনের পরে চন্দ্রশেখরই হলেন দ্বিতীয়
ভারতীয় যিনি এই ফেলোশিপ পেলেন। চন্দ্রশেখর বুঝতে পারলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানে
তাঁর গবেষণার স্বীকৃতি পাওয়া শুরু হয়েছে। এটাই হবে তাঁর গবেষণার
মূলক্ষেত্র, অন্তত পরবর্তী চার বছর। ট্রিনিটি ফেলো হিসেবে রয়েল
এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিরও ফেলোশিপ পেতে সময় লাগলো না। মাসের প্রতি দ্বিতীয়
শুক্রবার কেমব্রিজ থেকে ট্রেনে করে লন্ডনে গিয়ে রয়েল এস্ট্রোনমিক্যাল
সোসাইটির মিটিং এ যোগ দেয়া রুটিন হয়ে গেল ডক্টর চন্দ্রশেখরের। ১৯৩৪ সালে
রাশিয়া ভ্রমণের সুযোগ এলো। রাশিয়া গিয়ে শ্বেত-বামন সংক্রান্ত তাঁর পুরনো
গবেষণার ব্যাপারে আবার নতুন করে উৎসাহ জেগে উঠলো। রাশিয়ায় তিনি শ্বেত-বামন
তারাদের ভরের সীমা বিষয়ক বক্তৃতা দিলেন। রাশিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভিক্টর
এম্বার্টসুমিয়ান চন্দ্রশেখরের আবিষ্কারে খুব উৎসাহ দেখালেন এবং
চন্দ্রশেখরকে বললেন এ ব্যাপারে বিস্তারিত ফলাফল প্রকাশ করতে। উঠে পড়ে
লাগলেন চন্দ্রশেখর। ১৯৩৪ সালের মধ্যে দুটো পেপার তৈরি হয়ে গেলো।
রিলেটিভিস্টিক কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আলোকে শ্বেত-বামনের ভর ও ঘনত্বের সীমা
নিয়ে বিস্তারিত হিসেব সহ পেপারদুটো প্রকাশের জন্য রয়েল এস্ট্রোনমিক্যাল
সোসাইটিতে জমা দিলেন।

রয়েল এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির আমন্ত্রণে
১৯৩৫ সালের জানুয়ারি মাসে সোসাইটির মাসিক সভায় বক্তৃতা দেন চন্দ্রশেখর।
সভায় উপস্থিত ছিলেন স্যার এডিংটন। মহা উৎসাহে চন্দ্রশেখর ব্যাখ্যা করলেন
কীভাবে শ্বেতবামন তারাগুলোর ভর একটা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলেই তাদের
ঘনত্ব অসীম হয়ে যায়। চন্দ্রশেখর আশা করেছিলেন এরকম একটা আবিষ্কারের জন্য
স্যার এডিংটন তাঁর প্রশংসা করবেন। কিন্তু প্রশংসার বদলে প্রশ্নবাণে জর্জরিত
হলেন চন্দ্রশেখর। প্রশ্ন উঠলো তারার ভর ক্রিটিক্যাল মাস বা সংকট ভরের বেশি
হলে কী অবস্থা হবে? ঘনত্ব বাড়ার সাথে সাথে তারাগুলো যখন সংকুচিত হতে শুরু
করবে তখন কী হবে? শ্বেতবামন হওয়া ছাড়া আর কোন ভাবে কি তারাগুলোর মৃত্যু
ঘটে? সবার সামনে প্রায় অপমান করা হলো চন্দ্রশেখরকে। চন্দ্রশেখরের সবচেয়ে
কষ্ট লাগলো এডিংটন চন্দ্রশেখরকে এ ব্যাপারে আগে কিছুই বলেন নি। অথচ এ
সংক্রান্ত চন্দ্রশেখরের প্রথম পেপারটি প্রকাশিত হয়েছে চার বছর আগে, ১৯৩১
সালে। এডিংটনের মত বিরাট মাপের মানুষ যে ভাষায় চন্দ্রশেখরের সমালোচনা করলেন
তাতে খুব কষ্ট পেলেন চন্দ্রশেখর। এডিংটনের মতে যে কোন তারাই শক্তিক্ষয়ের
পর একসময় প্রাকৃতিক নিয়মেই মরে যাবে। সেখানে শ্বেতবামন বা ভরের সীমার কোন
শর্ত থাকতে পারে না। এডিংটন বললেন, “এই মিটিং থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবো
কি না আমি জানি না, কিন্তু আমি আমার পেপারে পরিষ্কার ভাবে দেখিয়ে দিয়েছি যে
আপেক্ষিক ক্ষয় (রিলেটিভিস্টিক ডিজেনারেসি) বলে কিছুই নেই। ডক্টর
চন্দ্রশেখরও এরকম ফল আগে পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সাম্প্রতিক পেপারে
ঘঁষেমেজে আপেক্ষিক ক্ষয়ের সূত্র ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সাথে আলোচনার পর আমি
এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছি যে এটা একটা অবাস্তব আপেক্ষিক ক্ষয়ের ফর্মূলা”
[8]।

ব্রিটিশ এস্ট্রোনমিতে এডিংটনের কথার ওপরে
কথা বলার সাহসে সেই সময়ে কারো ছিল না। এডিংটন যেহেতু চন্দ্রশেখরের ফর্মূলার
বিরোধিতা করলেন – কেউই সাহস পেলেন না চন্দ্রশেখরের পেপারকে সমর্থন করার।
১৯৩৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের মিটিং-এ এডিংটনের
মতবাদই প্রাধান্য পেলো। ১৯৩৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত শ্বেত-বামন তারা
সংক্রান্ত কনফারেন্সেও একই অবস্থা। ডিরাক সহ আরো অনেক তত্ত্বীয়
পদার্থবিজ্ঞানীর সাথে পরিচয় ছিলো চন্দ্রশেখরের। তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে
চন্দ্রশেখরের তত্ত্বের প্রতি সমর্থন জানালেও এডিংটনের সাথে প্রকাশ্যে
বিরোধে জড়াতে চাইলেন না। ডিরাক ১৯৪২ সালে রিলেটিভিস্টিক কোয়ান্টাম তত্ত্বের
প্রতি এডিংটনের তাচ্ছিল্যের সমালোচনা করে একটা পেপার লিখলেন, কিন্তু
পেপারের কোথাও চন্দ্রশেখরের ফর্মূলার কথা উল্লেখ করলেন না। চন্দ্রশেখর কারো
সাথেই কোন বিরোধে জড়াতে চাইলেন না। তিনি নীরবে সরে এলেন তাঁর ফর্মূলা
থেকে। এর প্রায় দুই যুগ পর ‘চন্দ্রশেখর লিমিট’ নিজের যোগ্যতাতেই প্রতিষ্ঠিত
হয় এবং বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় আবিষ্কারগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত
হয়। চন্দ্রশেখরের সীমার চেয়ে বেশি ভরের তারাগুলোর ভবিষ্যত কী? এ প্রশ্নের
উত্তর সেদিন পাওয়া না গেলেও আজ আমরা সবাই জানি যে এরা ‘নিউট্রন স্টার’
কিংবা ‘ব্ল্যাক হোল’এ রূপান্তরিত হয় [3]।

চন্দ্রশেখরের গবেষণার ব্যাপারে এডিংটনের
ঋণাত্মক মনোভাব প্রকাশিত হয়ে পড়ার পর কেমব্রিজে স্থায়ী কোন পদে নিয়োগ পাবার
সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ হয়ে পড়লো। ১৯৩৬ সালের পর তাঁর ট্রিনিটি ফেলোশিপ শেষ
হয়ে যাবে। এদিকে তাঁর বাবা চাচ্ছেন তিনি যেন দেশে ফিরে যান। বাড়ির বড় ছেলে
হিসেবে পারিবারিক দায়িত্বও তো আছে অনেক। এসময় কাকা রামন খবর পাঠালেন
ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দিতে
চাইলে তখুনি যোগ দিতে পারেন চন্দ্রশেখর। নোবেল পুরষ্কার পাবার পর ভারতীয়
পদার্থবিজ্ঞানের জগতে রামন তখন এক বিশাল মহীরুহ। চন্দ্রশেখর ভেবে দেখলেন
কাকার ছায়ায় বসে গবেষণা করলে নিজের মত করে বেড়ে ওঠা হবে না কখনো। কাকাকে
‘না’ বলে দিলেন। ভারতে যদি ফিরতেই হয় তবে অন্য কোথাও। লাহোর সরকারি কলেজে
গণিতের অধ্যাপক পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে দরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন
চন্দ্রশেখর। কিন্তু জানতে পারলেন সেই পদের জন্য ইতোমধ্যেই দরখাস্ত করেছেন
চন্দ্রশেখরের বন্ধু চাওলা। চাওলা খুব ভালো গণিতবিদ। চন্দ্রশেখর চাওলাকে
সুযোগ করে দেয়ার ইচ্ছেয় নিজের দরখাস্ত প্রত্যাহার করে নিলেন। কিন্তু পরে
জানতে পারেন যে সেখানে চাওলার বদলে অন্য কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

১৯৩৫ সালের সেপ্টেম্বরে হার্ভার্ড কলেজ
অবজার্ভেটরির পরিচালক হারলো শ্যাপলি তিন মাসের জন্য হার্ভার্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার পদে আমন্ত্রণ জানান চন্দ্রশেখরকে। চন্দ্রশেখর
আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। ১৯৩৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ১৯৩৬ সালের ২৫ মার্চ
পর্যন্ত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করলেন চন্দ্রশেখর। ওটাই ছিল তাঁর
প্রথম আমেরিকা ভ্রমণ। এই ভ্রমণ খুব ফলপ্রসূ হলো। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে
গিয়ে আমেরিকান এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির মিটিং এ যোগ দিলেন চন্দ্রশেখর।
সেখানকার অবজারভেটরির পরিচালকের আমন্ত্রণে দশটি বক্তৃতা দিলেন। উইসকনসিনে
উইলিয়াম্‌স বে’র ইয়ের্ক্‌স অবজারভেটরি পরিদর্শন করলেন। চন্দ্রশেখরের সাথে
কথা বলে পরিচালকদের সবাই খুব মুগ্ধ। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাদের
অবজারভেটরিতে যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান করলেন চন্দ্রশেখরকে। এদিকে শিকাগো
বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও অফার এলো ইয়ের্ক্‌স অবজারভেটরিতে রিসার্চ এসোসিয়েট
হিসেবে যোগ দেয়ার জন্য। চন্দ্রশেখর ভেবে দেখলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের
ইয়ের্ক্‌স অবজারভেটরিতে যাঁরা আছেন তাঁদের প্রায় সবাই চন্দ্রশেখরের মতই
বয়সে তরুণ। এই পরিবেশে চন্দ্রশেখর গবেষণা করতে পারবেন অনেক স্বাচ্ছন্দ্যে।
কেমব্রিজে রথি মহারথিদের ভিড়ে মাঝে মাঝে অস্বস্তি লাগতো তাঁর। শিকাগো
বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন চন্দ্রশেখর। কিন্তু যোগ দেয়ার
আগে একবার দেশে যাওয়া দরকার। সেখানে ললিতা অপেক্ষা করে আছেন চন্দ্রশেখরের
জন্য।

১৯৩৬ সালে কেমব্রিজ থেকে বাড়িতে ফিরলেন
চন্দ্রশেখর। ছয় বছর পরে মাদ্রাজে ফিরে সবকিছু কেমন যেন নতুন নতুন মনে হচ্ছে
চন্দ্রশেখরের। ললিতা পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি পাস করে ব্যাঙ্গালোরে রামনের
ইনস্টিটিউটে কাজ করছিলেন। ১৯৩৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ললিতার সাথে
চন্দ্রশেখরের বিয়ে হলো গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে নিজেদের পছন্দে।
চন্দ্রশেখরের বাবা ছেলের বিয়ের সিদ্ধান্ত খুশি মনেই মেনে নিয়েছেন, কিন্তু
ছেলের আমেরিকা যাবার সিদ্ধান্তে খুব একটা খুশি হতে পারেন নি। তাঁর মতে
বিদেশে যদি থাকতেই হয় তাহলে ইংল্যান্ডই তো ভালো। রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ
পাওয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকার চেয়ে বেশি কাজে আসবে ইংল্যান্ড। আত্মবিশ্বাসী
চন্দ্রশেখর বাবাকে বোঝালেন যে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ তিনি আমেরিকায় বসেও
পেতে পারেন। আর না পেলেও তার এমন কিছু ক্ষতি হবে না। আমেরিকায় বসেই রয়েল
সোসাইটির ফেলোশিপ পেয়েছিলেন চন্দ্রশেখর ১৯৪৪ সালে।

১৯৩৭ সালে আমেরিকায় আসেন চন্দ্রশেখর ও
ললিতা। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ের্ক্‌স অবজারভেটরিতে কাজ শুরু করলেন
চন্দ্রশেখর। কাজে যোগ দিয়েই শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিদ্যা ও
নভোপদার্থবিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম চালু করলেন চন্দ্রশেখর। তরুণ
অধ্যাপক চন্দ্রশেখরের ব্যক্তিত্ব, মেধা, প্রজ্ঞা, শিক্ষকতায় অসাধারণ
দক্ষতার কথা অচিরেই ছড়িয়ে গেলো আমেরিকার শিক্ষাজগতে। সারা দেশ থেকে প্রচুর
ছাত্রছাত্রী আসতে শুরু করলো চন্দ্রশেখরের ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হবার জন্য।
১৯৪২ সালে এসোসিয়েট প্রফেসর এবং ১৯৪৪ সালে ফুল প্রফেসর হন চন্দ্রশেখর। ১৯৫২
সালে ‘মরটন ডি হাল ডিস্টিংগুইস্‌ড সার্ভিস প্রফেসর’ হন চন্দ্রশেখর। ১৯৮৫
সালে অবসর গ্রহণের পরেও এমেরিটাস প্রফেসর হিসেবে আমৃত্যু শিকাগো
বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলেন চন্দ্রশেখর। ৪৮ বছরের শিক্ষকতা জীবনে একান্ন জন
গবেষক পিএইচডি ডিগ্রি পান চন্দ্রশেখরের তত্ত্বাবধানে।

হার্ভার্ড, কেমব্রিজ, এম-আই-টি, প্রিন্সটন
সহ পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় বড় অফার এলেও শিকাগো
বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আর কোথাও যান নি চন্দ্রশেখর। ১৯৪৪ সালে হোমি ভাবা যখন
টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ গড়ে তুলছেন – তখন চন্দ্রশেখরকে
আহ্বান জানিয়েছিলেন সেখানে যোগ দেয়ার জন্য। প্রাথমিক ভাবে রাজিও হয়েছিলেন
চন্দ্রশেখর। কিন্তু শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুল প্রফেসর হয়ে যাবার পর ফিরিয়ে
দিয়েছিলেন ভাবার অফার।

১৯৫৩ সালে ললিতা ও চন্দ্রশেখর সিদ্ধান্ত
নিলেন আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণের। ভারতে তখনো দ্বৈতনাগরিকত্ব গ্রহণযোগ্য
নয়। আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করার সাথে সাথে ললিতা ও চন্দ্রশেখরের ভারতীয়
নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়। চন্দ্রশেখরের বাবা তাঁদের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে
পারেন নি। বাবার সাথে আর দেখা হয়নি চন্দ্রশেখরের। ১৯৬০ সালে চন্দ্রশেখরের
বাবা মারা যান। ১৯৬১ সালে ভারতের জাতীয় অধ্যাপক পদে যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান
করা হয় চন্দ্রশেখরকে। কিন্তু তিনি ‘আমেরিকান নাগরিক’ এই অজুহাতে এড়িয়ে
গিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে বিমান দুর্ঘটনায় হোমি ভাবার মৃত্যুর পর ভারতের এটমিক
এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান পদে যোগ দেয়ার জন্যও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা
গান্ধীর পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয় চন্দ্রশেখরকে। এবারেও চন্দ্রশেখর
প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন। পরে তিনি নিজে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে
ব্যাখ্যা করেন তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারণ। ভারতের এটমিক এনার্জি
কমিশনের চেয়ারম্যান হতে গেলে ভারতের রাজনীতিকদের সাথে ভালো বোঝাপড়া থাকা
দরকার, এবং তার সাথে প্রশাসনিক কাজে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকা দরকার।
চন্দ্রশেখরের তা নেই। সর্বোপরি ওই পদ নিতে গেলে তাঁকে আমেরিকান নাগরিকত্ব
ত্যাগ করে আবার ভারতীয় নাগরিকত্ব নিতে হতো। আমেরিকান নাগরিক হবার কারণেই
চন্দ্রশেখর নোবেল পুরষ্কার পাবার পরও ভারত তা নিজেদের বলে দাবি করতে পারে
না।

চন্দ্রশেখরের গবেষণার ধরণ ছিলো ভীষণ
গোছানো। কোন একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে আগ্রহ জন্মানোর পর পাঁচ থেকে দশ বছর সেই
বিষয়ের ওপর গবেষণা করেন। তারপর প্রকাশিত গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে একটা বই
লেখেন। তারপর নতুন বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। এভাবে প্রধানত সাতটি বিষয়ে
গবেষণা করেছেন চন্দ্রশেখর। জ্যোতির্বিজ্ঞান দিয়ে শুরু করলেও কোয়ান্টাম
মেকানিক্স, রিলেটিভিটি সহ পদার্থবিজ্ঞানের মূল শাখায় চন্দ্রশেখরের অবদান
অনেক।

১৯৩৬ সালের মধ্যে ৪৩টি গবেষণাপত্র
প্রকাশিত হয় চন্দ্রশেখরের। কেমব্রিজে নক্ষত্রের গঠন ও ধর্মাবলী নিয়ে যে
গবেষণা করেছিলেন ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত, তাদের ভিত্তিতে চন্দ্রশেখর ১৯৩৭ সালে
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে লিখেন তাঁর প্রথম বই “এন ইন্ট্রোডাকশান টু দি
স্টাডি অব স্টেলার স্ট্রাকচার” [9]। শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বইটি
প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালে। তারপর ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত গবেষণা করেছেন
মহাকাশের গতিপ্রকৃতি নিয়ে। এই ছয় বছরে ৩৭টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন
চন্দ্রশেখর। বিশ্বব্রহ্মান্ড অসংখ্য গ্যালাক্সির সমন্বয়ে গঠিত। মহাকাশে
তাদের গতি বড় এলোমেলো – অনেকটা ব্রাউনিয়ান গতির মত। চন্দ্রশেখর
পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে হিসেব করে মহাকাশের আপাত বিশৃঙ্খল গতিকে গাণিতিক
শৃঙ্খলায় উপস্থাপন করেছেন। তাঁর গবেষণার ভিত্তিতে ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয়
দুটো বই ‘প্রিন্সিপলস অব স্টেলার ডায়নামিক্স’[10] ও ‘স্টকাস্টিক প্রবলেমস
ইন ফিজিক্স এন্ড এস্ট্রোনমি’ [11]।

১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত
চন্দ্রশেখর গবেষণা করেন মহাকাশের আবহাওয়া ও পরিবেশ নিয়ে। উত্তর শক্তির
বিকিরণ কীভাবে সঞ্চালিত হয় এক নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্রে কিংবা মহাকাশে –
তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন। এতে যুক্ত হয় মহাকাশের পরিবেশ, হাইড্রোজেনের
ঋণাত্মক আয়নের কোয়ান্টাম তত্ত্ব, সূর্যালোকের উপস্থিতিতে মহাকাশে আলোর
দীপ্তি ও মেরুকরণ। এই সাত বছরে ৬৪টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় তাঁর। এসবের
ভিত্তিতে ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয় চন্দ্রশেখরের চতুর্থ বই “রেডিয়েটিভ
ট্রান্সফার” [12]।

১৯৫০ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত গবেষণা করেন
হাইড্রোডায়নামিক ও হাইড্রোম্যাগনেটিক স্থায়ীত্ব বিষয়ে। মহাকাশে গ্রহাণু
থেকে শুরু করে গ্যালাক্সির গতিপ্রকৃতি কেমন হবে যদি সেখানে চৌম্বকক্ষেত্রের
উপস্থিতি থাকে। এই দশ বছরে তাঁর ৮৫টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। ১৯৬১ সালে
প্রকাশিত হয় এ সংক্রান্ত বই “হাইড্রোডায়নামিক এন্ড হাইড্রোম্যাগনেটিক
স্ট্যাবিলিটি” [13]। তারপর পরবর্তী সাত বছরে আরো ৬৪টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত
হয় চন্দ্রশেখরের। এগুলোর ভিত্তিতে ১৯৬৮ সালে ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে
প্রকাশিত হয় “এলিপসোইডাল ফিগার্‌স অব ইকুইলিব্রিয়াম” [14]। একাডেমিক জীবনের
শেষের দিকে এসে আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব ও আপেক্ষিক জ্যোতির্বিদ্যা
সংক্রান্ত গবেষণায় মন দেন। এর ভিত্তিতে ব্ল্যাক-হোলের গাণিতিক তত্ত্ব
প্রতিষ্ঠা করেন চন্দ্রশেখর। শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে যাবার পরেও ১৯৬৯ থেকে
১৯৮২ সালের মধ্যে আরো ৬৬টি গবেষণা পত্র রচনা করেন তিনি। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত
হয় তাঁর সপ্তম বই “দি ম্যাথমেটিক্যাল থিওরি অব ব্ল্যাক হোল্‌স” [15]। চার
শতাধিক গবেষণাপত্র রচনা করেন চন্দ্রশেখর তাঁর ৫৫ বছরের গবেষণা জীবনে।
জীবনের শেষের দিকে এসে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় গবেষণার বাইরে ভিন্ন বিষয়ের
বই ‘ট্রুথ এন্ড বিউটি’।

১৯৩০ সালে ইন্ডিয়া গভমেন্টের বিশেষ
স্কলারশিপের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল চন্দ্রশেখরের প্রতিভার স্বীকৃতি। তারপর
১৯৩৩ সালে ট্রিনিটি ফেলোশিপ, ১৯৪৪ সালে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ, ১৯৪৭ সালে
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডাম’স প্রাইজ, ১৯৫২ সালে এস্ট্রোনমিক্যাল
সোসাইটির ব্রুস গোল্ড মেডেল, ১৯৫৩ সালে রয়েল এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির
গোল্ড মেডেল, ১৯৫৫ সালে ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের মেম্বারশিপ, ১৯৫৭
সালে আমেরিকান একাডেমি অব আর্টস এন্ড সায়েন্সের রামফোর্ড মেডেল, ১৯৬২ সালে
রয়েল সোসাইটির রয়েল মেডেল এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমির
শ্রীনিবাস রামানুজন মেডেল, ১৯৬৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ন্যাশনাল
মেডেল অব সায়েন্স, ১৯৬৮ সালে ভারতের পদ্মবিভূষণ, ১৯৭১ সালে ন্যাশনাল
একাডেমি অব সায়েন্সের হেনরি ড্রেপার মেডেল, ১৯৭৩ সালে পোলিশ ফিজিক্যাল
সোসাইটির স্মোলুকাউস্কি মেডেল, ১৯৭৪ সালে আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির
ড্যানি হেইনম্যান প্রাইজ, ১৯৮৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার, ১৯৮৪
সালে রয়েল সোসাইটির কোপলে মেডেল, জুরিখের ডক্টর টোমালা প্রাইজ, ইন্ডিয়ান
ফিজিক্যাল এসোসিয়েশানের বিড়লা মেমোরিয়েল এওয়ার্ড।

প্রচন্ড রকমের নিয়মনিষ্ঠ ছিলেন
চন্দ্রশেখর। ভোর পাঁচটা থেকে দিন শুরু হতো তাঁর। দিনে তেরো ঘন্টা কাজ করতেন
নিয়মিত। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালের
সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে। এই সময় এই জার্নালকে সেরা
মানের জার্নালে রূপান্তরিত করেন তিনি। গবেষণাপত্রের মানের ব্যাপারে কখনো
আপোষ করেন নি তিনি। অনেক প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানীর লেখাও তিনি মানসম্মত না হওয়ায়
বাতিল করে দিয়েছেন। ফলে অনেকেই তাঁকে এড়িয়ে চলতেন। গবেষণার ক্ষেত্রেও কোন
ধরণের অবহেলা বা বিচ্যুতি সহ্য করতেন না তিনি। গবেষণার মানে ঘাটতি দেখলে
তিনি কঠোর ভাষায় সমালোচনা করতেন। ফলে সেমিনারে তাঁর উপস্থিতি অনেকের কাছেই
আরামদায়ক মনে হতো না। কিন্তু ভালো কাজের প্রশংসা করতে কার্পণ্য করতেন না
কখনো। পোশাকের ব্যাপারে চন্দ্রশেখর ছিলেন ভীষণ ফর্মাল। শীত-গ্রীষ্ম যে কোন
ঋতুতেই স্যুট-টাই। একবার লস আলামোসের প্রচন্ড গরমে সবাই মিলে পাহাড়ে ওঠার
প্রোগ্রামেও তিনি স্যুট-টাই পরে উপস্থিত হয়েছিলেন।
চন্দ্রশেখর ও ললিতা নিঃসন্তান ছিলেন। তাই
শিশুদের প্রতি তাঁদের প্রচন্ড স্নেহ ভালবাসা প্রকাশ পেতো। চন্দ্রশেখর তাঁর
সহকর্মীদের ছেলে-মেয়েদের সাথে শিশুর মত মিশতেন। এক্ষেত্রে তাঁর ফর্মালিটির
বিচ্যুতি ঘটতো।

বিজ্ঞানীদের মধ্যে স্যার আইজাক নিউটন
ছিলেন চন্দ্রশেখরের আদর্শ। অবসর নেয়ার পর নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া’ সাধারণ
পাঠকের উপযোগী করে সহজ ভাষায় লেখার কাজে হাত দেন চন্দ্রশেখর। তাঁর মতে
“ভৌতবিজ্ঞানের কোন শিক্ষার্থীর নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া’ সম্পর্কে না জানা
সাহিত্যের কোন শিক্ষার্থীর শেক্‌সপিয়ারকে না জানার সমান” [2]। ১৯৯৫ সালে
‘নিউটন’স প্রিন্সিপিয়া ফর দি কমন রিডার’ প্রকাশের পর চন্দ্রশেখর মন্তব্য
করেছিলেন – “আমার কাজ শেষ। অনেক দিন বাঁচা হলো। এবার মরে গেলেও কোন সমস্যা
নেই” [16]। এর কিছুদিন পরেই ২১ শে আগস্ট তারিখে চন্দ্রশেখর মারা যান।

তথ্যসূত্রঃ
1. Press Release: CXC PR:98-04. NASA Names Premier X-Ray Observatory and
Schedules Launch,
chandra.harvard.edu/press/98_releases/press_122198.html. 1998 [cited
11/12/2011].
2. Freeman Dyson, Chandrashekhar’s role in 20th-century science. Physics Today, 2010. 63(12): p. 44-48.
3. Kameshwar C. Wali, Chandra: A biographical portrait. Physics Today, 2010. 63(12): p. 38-43.
4. S Chandrashekhar, Thermodynamics of the Compton Effect with reference
to the interior of the stars. Indian Journal of Physics 1928. 3: p.
241-250.
5. S Chandrashekhar, The Compton scattering and the new statistics. Proc. Roy. Soc. Lond. , 1929. A125: p. 231-237.
6. S Chandrashekhar, The maximum mass of ideal white dwarfs. Astrophysical Journal, 1931. 74: p. 81-82.
7. শ্যামল চক্রবর্তী, বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী. ১৯৯৯, কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ
8. R. J. Tayler, Subrahmanyan
Chandrashekhar. Biographical memoirs of fellows of the royal society,
1996. 42(November ): p. 80-94.
9. S Chandrashekhar, An introduction to the study of stellar structure 1939, Chicago: University of Chicago Press.
10. S Chandrashekhar, Principles of stellar dynamics. 1943, Chicago: University of Chicago Press.
11. S Chandrashekhar, Stochastic problems in Physics and Astronomy. 1943, Chicago: University of Chicago Press.
12. S Chandrashekhar, Radiative Transfer. 1950, Oxford: Clarendon Press.
13. S Chandrashekhar, Hydrodynamic and Hydormagnetic stability. 1961, Oxford: Clarendon Press.
14. S Chandrashekhar, Elliopsoidal Figures of Equilibrium. 1968: Yale University Press.
15. S Chandrashekhar, The mathematical theory of black holes. 1983, Oxford: Clarendon Press.
16. Kameshwar C. Wali, Chandra A biography of S. Chandrashekhar. 1991, Chicago: The University of Chicago Press.