“পরিবর্তনের জন্য পরিবর্তন”

“পরিবর্তনের জন্য পরিবর্তন”
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ

২০১১ সালে আমি আন্দামানে বাস করতাম। বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছি ২০০৯ সালে। কিন্তু যে সি পি এম নেতার জন্য আমি দেশ ত্যাগ করেছিলাম, তার কাছে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম যে যতোদিন ওরা পশ্চিম বংগ শাসন করবে ততো দিন আমি পশ্চিম বংগে বাস করবো না। সি পি এম বিরোধী এর বেশী কিছু করার ক্ষমতা আমার ছিলো না, তাই এই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। ওটাই ছিলো আমার প্রতিবাদের ভাষা।

২০০৬ সালে আমি ওয়েষ্ট ইন্ডিজে ছিলাম। সিঙ্গুরের কথা জানতে পারলাম। সব জেনে বুঝলাম সি পি এমের শেষের শুরু হয়ে গেছে। যে কৃষকদের স্বার্থ নিয়ে আন্দোলন করে পশ্চিম বঙ্গে ওরা ক্ষমতা লাভ করেছিলো, সেই কৃষকের মাথায় বাড়ি দিয়ে ওরা আর বেশীদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। হলো ও তাই। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের হাত ধরে ক্ষমতায় এলেন বর্তমান শাসক দল।

সেই সময়, আমি ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’ এ একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। নাম দিয়েছিলাম “পরিবর্তনের জন্য পরিবর্তন”। লেখার মুল বক্তব্য ছিলো এটাই যে, “সি পি এমের ৩৪ বছরের অপশাসন দূর করে যে নতুন রাজনৈতিক শক্তি পশ্চিম বংগের শাসন ক্ষমতায় এলো, এদের কাছে পশ্চিম বঙ্গের মানুষের অনেক আশা। সেই ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় মারা যাবার পর, হতভাগ্য বাঙ্গালী একটু সুখের মুখ দেখলো না। ৩৪ বছরের জগদ্দল পাথর সরিয়ে যে রাজশক্তি ক্ষমতায় এলো এরা যদি সাধারন মানুষের কল্যানে ব্যর্থ হয়, তাহলে এই যে পরিবর্তন হলো , সেটা হবে শুধু “পরিবর্তনের জন্য পরিবর্তন” ,আর বিশেষ কিছু নয়”।

আমি নিজে, বর্তমান রাজশক্তির সমর্থনকারী না হলেও, খুবই খুশী হতাম যদি এই রাজ শক্তি বাঙ্গালীর কল্যানকারী হতো। আমি কোনদিন ভাবিনি, বাঙ্গালীর দুর্ভোগ এতোদিন পরেও মিটবে না। এতো এক অপশক্তির অশুভ ছায়া থেকে আরো বেশী ভয়ংকর এক অপশক্তির কালগ্রাসে চলে যাওয়া। চারিদিকে শুধু ভন্ডামি, মিথ্যে, ছলনা আর স্বার্থানেষী কাজকর্ম। এদের প্রশ্রয়ে যে কাল সাপ তার ফনা তুলে এগিয়ে আসছে, সেই কালসাপ অচিরেই সারা বাঙ্গালী জাতির সারা অঙ্গ তার বিষে জর্জরিত করে দেবে। ভাবতে অবাক লাগে, বর্তমান বাঙ্গালী সেই কাল সাপের পোষন কারীদের পিছনে মোহগ্রস্থ হয়ে ঘুরছে। একটি জাতি যদি মোহগ্রস্থ হয়ে পড়ে তাহলে সেই জাতির ধ্বংস কে আটকাবে। বাঙ্গালী তো এই পরিবর্তন চায় নি।

বাঙ্গালী জাতিটাই আজ এতোটাই হতভাগ্য যে এর থেকে ত্রান করার ও কেউ নেই। নেই অন্য কোনো রাজশক্তি। আমি অন্তত আমার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি না। বাঙ্গালী জাতীয় রাজনিতীর উলটো স্রোতে ভেসে যেতে অভ্যস্ত। দেশের মুল রাজনৈতিক শক্তির প্রতি তার চিরকাল ই অনীহা। দেশীয় রাজনীতি তাই এই আঞ্চলিক বিরোধী রাজনীতি কে চিরকাল সযত্নে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ফল যা হবার তাই হয়েছে। এক সময়ের সব চেয়ে উন্নত জাতি আজ এক অধঃপতিত আঞ্চলিক জাতি হিসাবে পরিগনিত হয়ে পড়েছে, আর অন্যরা অনেক এগিয়ে গেছে। 

পশ্চিম বঙ্গের বর্তমান রাজশক্তি সেই একই ভুল করে চলেছে। দেশের মুল রাজনৈতিক স্রোত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে উলটো রাস্তায় হাটছে। কারন? ব্যক্তিগত উচ্চাশা। নিজের দুর্বলতাকে অস্বীকার করে এক অসম যুদ্ধের হুংকার। সেই অসম যুদ্ধে পরাজয় অনিবার্য। সেই হারের মাশুল চোকাতে হবে সমস্ত বাঙ্গালী জাতি টাকেই।

পরিবর্তন করে বাঙ্গালীর লাভ কিছুই হয়নি। সেই পরিবর্তন করে বাঙ্গালীর সাময়িক “বিপ্লবী মানসিকতা” পুষ্ট হয়েছে ঠিকই কিন্তু জাতি হিসাবে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। নেহেরুর সময় থেকে শুরু করে আজ অবধি বাঙ্গালী সেই ব্রাত্যই রয়ে গেলো, তার কারন অসম যুদ্ধের প্রতি অনুরাগ।

বাঙ্গালী মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। বিরোধী স্রোতে ভেসে যাবার মানসিকতা থেকে দেশের মুলস্রোতে ফেরার মানসিকতা তৈরী করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত নাবিকের। সেই নাবিকের আজ বড়ো অভাব।    তাই একের পর এক পরিবর্তন শুধু “পরিবর্তনের জন্যই পরিবর্তন” হয়ে চলেছে। আসল পরিবর্তন হচ্ছে কই?????????