জাকির তালুকদাররা সেই উত্তরাধিকার হয়েই হিন্দু নির্যাতনকে অস্বীকার করছে।

জাকির তালুকদার যদি নিজেকে ‘বাঙালী মুসলমান সাহিত্যিক’ মনে করেন তাহলে তার সাম্প্রদায়িক পক্ষালম্বণ খুব একটা অবাক বিষয় নয়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের ঠগ বাছতে গা উজার দশা হবে। জাকির তালুকদার গুরুতর অভিযোগ করেছেন, তিনি ফেইসবুকে লিখেছেন, বাংলাদেশে হিন্দুরা নির্যাতনের বানানো মিথ্যা গল্প ফেঁদে ভারতে চলে যায়। এটা তাদের অসৎ উদ্দেশ্য…।

জাকির তালুকদার একা নন, এদেশের সাহিত্যিকদের কখনই এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় নিয়ে লিখেননি। দেশভাগে চলে যাওয়া বিপুল জনগোষ্ঠিদের নিয়ে লিখেননি। আশ্চর্য যে পাহাড়ী আদিবাসীদের প্রতি চলা বছরের পর বছর নিপীড়ন, তাদের ভূমি দখল নিয়ে এইসব স্বঘোষিত মানবতাবাদীদের একটাও লেখা নেই! এটাও কি বানোয়াট মিথ্যা গল্প? পাহাড়ীরা কি বানিয়ে নিজেদের সেটেলার বাঙালীদের হাতে নির্যাতিত হবার গল্প ফেঁদেছে? এ থেকে বুঝা যায় তারা নিপীড়িতদের পক্ষে নয়, তারা স্বধর্মীয় নিপীড়িতদের পক্ষে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে জাকির তালুকদারদের অবস্থান যে সাম্প্রদায়িক নিরপেক্ষ ছিলো না সেটি বুঝা যাবে যখন তারা পাহাড়ী আদিবাসীদের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকে।

জাকির তালুকদারদের মত লেখরা যখন বলে ফেলেন হিন্দু নির্যাতনের বানোয়াট গল্প হিন্দুরা ফেঁদেছে অসৎ উদ্দেশ্য থেকে তখন তাদের মোটিভ বুঝাটা কঠিন কিছু নয়। কারণ এরকম মন্তব্য তিনি করেছেন কোন রকম তথ্যউপাত্তা ছাড়াই। ড. আবুল বারকাত তার গবেষণায় বলেছেন, অর্পিত সম্পত্তি আইন এখনো কার্যকর থাকায় হিন্দুরা তাদের সম্পত্তি নিয়ে শঙ্কায় থাকেন এবং অবস্থাপন্ন হিন্দুদের দেশান্তরিত হবার কারণ মূলত এটাই। দেশর আইনজীবী, বড় চাকুরে, নেতা, ডাক্তার এমনকি জাকির তালুকদারের মত বামাতীরাও সম্পত্তি হারানোর ভাবিকালের শঙ্কায় দেশান্তরিত করেন পরিবারকে। যে দেশের মানুষ ধর্মীয় পরিচয়ে সম্পত্তি বেদখলের শঙ্কায় ভারত পারি জমায় সেটাকে নির্যাতন হিসেবে দেখতে পায় না একমাত্র জানোয়ারের চামড়া গায়ে জড়ানো মানুষই! এদেশে জন্ম নিয়ে যদি আমি ভাবি আমার সম্পত্তি বেদখল হয়ে যেতে পারে অসৎ ইতর লোকের শত্রু সম্পত্তি আইনের ভেজালে- এবং এইসব কেসে অবশ্যাম্ভী মুসলিমরাই হয় সুফল ভোগী তাহলে ঠিক কোন মানসিকতা নিয়ে একজন হিন্দু বড় হয়ে উঠবে- এসব কি জাকির তালুকদারদের মত মুসলমানরা বিবেচনা করে দেখেছে? ড. বারকাত তার গবেষণায় বলেছেন, শত্রু সম্পত্তি আইনে হিন্দু সম্প্রদায়ের মূল মালিকানার ২৬ লাখ একর বেদখল বা ভূমিচ্যুত করা হয়েছে। এই ২৬ লাখ একরের মধ্যে প্রায় ৮২ শতাংশই কৃষি জমি, ২৯ শতাংশ বসতভিটা, ৪ শতাংশ বাগান, ৩ শতাংশ পতিত, ১ শতাংশ পুকুর ও ১৯ শতাংশ অন্যান্য জমি বেদখল হয়েছে। শত্রু অর্পিত সম্পত্তি আইনে ভূমি-জলা ও স্থানান্তরযোগ্য সম্পদ হারানোর আর্থিক ক্ষতি সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা (২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজার দর হিসাবে)।গত ৪০ বছরে (১৯৬৫-২০০৬) বিভিন্ন  সরকারের আমলে শত্রু ও অর্পিত সম্পত্তি আইনে হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষের ক্ষতির পরিমাণ ও মাত্রা ছিল বিভিন্ন ধরনের। এই আইনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ৬০ শতাংশ ও মোট ভূমিচ্যুতির ৭৫ শতাংশ হয়েছে ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। মোট ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ২০ দশমিক ৬ শতাংশ ও মোট ভূমিচ্যুতির ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ ঘটেছে ১৯৭৬ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, শত্রু ও অর্পিত সম্পত্তি আইনে যেসব হিন্দুধর্মাবলম্বী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের ৭২ শতাংশ এবং মোট ভূমিচ্যুতির ৮৮ শতাংশই ঘটেছে সেনাশাসন-স্বৈরশাসনামলের ২১ বছরে। অর্থাৎ ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ সাল  এবং ১৯৭৬ থেকে ১৯৯০ সাল।

জাকির তালুকদার কি বলবেন এসব বানোয়াট গল্প? ড. বারকাতকে এবার হিন্দুত্ববাদী বলে চালানো হবে? বাংলাদেশের গ্রামগুলো থেকে হিন্দু নিশ্চহৃ হবার কারণ এই নিরব জমি দখল। জমি দখল ও নারী দখলের ভয়ে ভীত হিন্দুরা দ্বিতীয়বার কোন রিস্ক নিতে চায় না বলেই ভারত পারি জমায়। অথচ নিজ দেশ ত্যাগের এই ভীতিটাকেই জাকির তালুকদার কতখানি নৃশংসভাবে দেখালো হিন্দুরা মিথ্যা গল্প ফেঁদে বাংলাদেশের টাকা পয়সা ভারতে পাচার করে। ইউরোপ আমেরিকায় বাঙালী মুসলমান যেমন জীবনের নিরাপত্তার জন্য পারি জমায় হিন্দুদের দেশত্যাগও সেরকমই একটি ‘অসাম্প্রদায়িক দেশত্যাগ’! অথচ মোটা দাগের হিন্দু পাড়ায় আক্রমন, ৯০ সালের বাবরী মসজিদ হামলার পর সাম্প্রদায়িক হামলাসহ ছোট বড় সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন ছাড়া এদেশের হিন্দুদের অস্তিত্ব বিপন্ন করার রাষ্ট্রীয় আয়োজন পাকিস্তান আমল থেকেই করা ছিলো। পাকিস্তানী পাঞ্জাবীরা চেয়েছিলো বাঙালী মুসলমানের সঙ্গে বাঙালী হিন্দুর মধ্যে বিভাজন করে দিতে না পারলে পাকিস্তানের মুসিলম জাতীয়তাবাদে বাঙালীরা বাঙালী জাতীয়তাবোধ ঢুকিয়ে দুর্বল করে দিবে। যে কারণ শত্রু সম্পত্তি আইনসহ ৬৫ সালের ‘ভারতের দালাল’ আটকের শাড়াশি অভিযানগুলি চালানো হয়েছিলো। বাংলা ক্যালেন্ডার পরিবর্তন করে বাঙালীদের অভিন্ন উৎসবে আগ পিছ করাও ছিলো সেই একই উদ্দেশ্য। পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলেও তার সব কিছুই বাংলাদেশ পেয়েছিলো উত্তরাধিকার সূত্রে। জাকির তালুকদাররা সেই উত্তরাধিকার হয়েই হিন্দু নির্যাতনকে অস্বীকার করছে।

দেশভাগ নিয়ে জাকির তালুকদার হাস্যকর তথ্য জুড়ে দিয়েছেন তার সাম্প্রদায়িক অবস্থানকে আড়াল করতে। ‘মুসলমানদের দেশ’ পাকিস্তানে ভারতের যে কোন মুসলমান যোগ দেয়াটা ছিলো আহ্বান। কিন্তু ভারত কিন্তু ‘হিন্দুদের দেশ’ হিসেবে স্বাধীন হয়নি। পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা হিন্দুদের জন্য পৃথক কোন দেশে যোগ দিতে ভারতে চলে যায়নি। পাকিস্তান স্বঘোষিত সাম্প্রদায়িক মুসলিম রাষ্ট্র। মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রে যোগ দিতেই এখানে মুসলমানরা এসেছিলো। হাসান আজিজুল হকের ‘উকি দিয়ে দিগন্ত’ আত্মজীবনীতে দেশভাগের সময় মানুষের সাম্প্রদায়িক মানসিকতা যেমন দেখিয়েছেন তেমনি মুসলমানদের দেশে যোগ দিতে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের স্বাভাবিক গমনটা জাকির তালুকদারদের চোখ এড়িয়েছে? কিংবা বদরুদ্দিন উমারদের পাকিস্তানে আগমনটাও দেখা যেতে পারে। রাষ্ট্রপতি এরশাদদের পরিবার কি সেখান থেকে জমিজমা হারিয়ে এসেছিলো? মোটেই না। নায়ক রাজ্জাক? তার গোটা চৌদ্দ গুষ্ঠিই ভারতের নাগরিক। টালিগঞ্জে উত্তম যুগে সুবিধা হবে না তাই তার গুরু পিজুষ রায়ের পরামর্শে ঢাকায় আগমন।… এসবই ব্যক্তি ধরে ধরে উদাহরণ। জাকির তালুকদার যেমন দিয়েছেন। যদিও এমন উদাহরণ কখনই সামগ্রিক চিত্র দেখায় না। যে কারণে আমি পরিসংখ্যান ও গবেষণা তথ্য থেকেই নির্যাস নিতে আগ্রহী। জাকির তালুকদার সেসবের বালাই নেই। ব্লগার কিলিং সময়ে এই লোকটা মুক্তচিন্তা নাস্তিকতার বিরুদ্ধে রাজাকারের ভূমিকায় অবর্তীন হয়ে ছিলো। লোকটি বাম ও একজন মুসলমান। মানুষ হতে তার এই জনমে আর সম্ভবনা আছে বলে মনে করি না। পাকিস্তানী হিন্দু মুসলমান বিভাজনকে আজতক এরা রিলে দৌড়ের মত স্টিক বদল করে চলেছে। এদের সাহিত্যও সাম্প্রদায়িক সাহিত্য। এদের গল্প উপন্যাসে কখনো পাহাড়ের কান্না থাকবে না। দেশত্যাগী হিন্দুদের অসৎ মিথ্যাবাদী বলবে। কারণ এরা ‘বাঙালী মুসলমান সাহিত্যিক’!

ইসলামিক ছাগুদের বরাবরই প্রচারণা ছিলো হিন্দুরা স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ ছাড়ে কারণ বাংলাদেশকে তারা নিজেদের দেশ মনে করে না। আজকাল ছাগু বলে আর আলাদা কোন টার্ম নেই। সবার মুখোশ খুলে পড়ছে। হিন্দুদের প্রতি বিরূপতা পূর্ববঙ্গের ঐতিহাসিকতার অঙ্গ। হিন্দুরা লেখাপড়ায় অর্থবিত্তে এগিয়ে তাই তাদের সঙ্গে বাঙালী মুসলমান প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকবে, তাদের উন্নতিতে তাদের জন্য আলাদা প্রদেশ করতে হবে সুষম বন্টনের জন্য- এটাই তো লাহোর প্রস্তাব ছিলো- তাই না? এই সাম্প্রদায়িক প্রদেশ চিন্তা পরবর্তীকালে দ্বিজাতিতত্ত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে যা ছিলো ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক একটি অবস্থান। এই অবস্থান শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে গভীরভাবে কাজ করেছে। এক পর্যায়ে ‘হিন্দুদের খেদাতে না পারলে পাকিস্তান করা যাবে না- পাকিস্তান করা না গেলে মুসলমানদের পথের ফকির হয়ে থাকতে হবে’ এই রকম একটা কঠিন অবস্থানে চলে যায়। স্বাভাবিকভাবে পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা পাকিস্তানের বিরোধীতা করেছিলো। এতে করে দুই সম্প্রদায়ের মানুষের সম্পর্ক চরম পর্যায়ে শীতল হয়ে উঠেছিলো। তারপর দাঙ্গা দেশভাগের মধ্য দিয়ে একটা বড় রকমের সম্পর্ক অবনতি ঘটে। এই অবনতিতে সবচেয়ে ভাল মুসলমান প্রতিবেশীটিও তার হিন্দু প্রতিবেশীর প্রতি চালানো দেশভাগের অন্যায় দেখেও না দেখার ভান করে ছিলো। এভাবেই মৌলবাদী মুসলমানের চালানো নিপীড়ন মডারেট মুসলমান নি:শব্দে দেখে চুপ থেকেছে। এখান থেকেই পরে অস্বীকার করা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। হিন্দু নির্যাতন নিপীড়নের ঘটনাকে অস্বীকার ও নানা রকম উদাহরণ দিয়ে লঘু করার প্রবণতা বহু প্রগতিশীল মুসলমানই অহরহ করে থাকে। জাকির তালুকদারের মত মুসলমান বামাতী সাহিত্যের কাছে এটা খুব একটা অভূতপূর্ব নয়…।