মধ্যরাতে চালানো এই অভিযানে ঘুমন্ত ঢাবাবাসীকে ঠান্ডা মাথায় হত্যার প্লাণ করেছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী।

বার্মিজ সেনাবাহিনী বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহত্যার আন্তর্জাতিক বিচারের সম্ভাবনা প্রচুর। ইতমধ্যে জাতিসংঘ বার্মিজ সেনাবাহিনীকে নিষেধাজ্ঞায় ফেলে রেখেছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের কোন দেশ বার্মিজ সেনাবাহিনীর বিচার করা যাবে না- এরকম বর্বর দাবীও করেনি। কিন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা ধর্ষণের বিচার করা যাবে না- এরকম কঠিন অবস্থান নিয়েছিলো ‘মুসলিম বিশ্ব’ তথা মুসলিম দেশগুলো।

বার্মাতে বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, মুসলমানরা বার্মিজদের রোহিঙ্গাদের উপর চালানো নিপীড়নকে ‘মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের নির্যাতন’ বলতে ভালোবাসে। জাপান, কোরিয়ার মত দেশগুলোও বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ। পৃথিবীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলো কেউ কি বার্মিজদের পক্ষ নিয়েছে? নেয়নি। কারণ ঐ দেশগুলো নামে মাত্র বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী নয়। তারা গণতান্ত্রিক সেক্যুলার। তাই বৌদ্ধ পরিচয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তারা কোন মেরুকরণ করেনি। কিন্ত মুসলমানদের ব্যাপার আলাদা। তারা ভারতবাসী হলেও কখনো তুরষ্কের খলিফার আনুগত্যা ঘোষণা করে বসে। কখনো সৌদি বাদশাহকে নিজেদের অভিভাবক কল্পনা করে অর্গাজম অনুভব করে। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম জঘন্ন গণহত্যা ধর্ষণ চালিয়েছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের উপর। সেই যুদ্ধাপরাধী সেনাদের বিচার করা যাবে না সেটা সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো মুসলিম দেশগুলো। বাংলাদেশ যাতে এই গণহত্যাকে বিশ্বে পরিচিত করে না তোলে, বেশি বাড়াবাড়ি না করে সেরকম হুমকিও ছিলো। ইসলাম মতে এক মুসলমান অপর মুসলমানদের দোষ গোপন করবে। পাকিস্তানের হত্যা ধর্ষণ গোপন করা ছিলো তখন সেই মোতাবেক মুসলিম বিশ্বের পবিত্র কর্তব্য।

এখন পর্যন্ত বিশ্ব ইতিহাসে মুসলিম সেনাবাহিনীর হাতে চালানো গণহত্যা, ধর্ষণের যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার বেশির ভাগই চাপা পড়ে গেছে মুসলিম বিশ্বের তোড়জোড়ে। তুরষ্কের চালানো আর্মেনিয়া গণহত্যাকে স্রেফ গণহত্যা বলে শেষ করলে সেটা বড় রকমের অবিচার হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এটি ছিলো একটি জাতিকে নিশ্চহৃ করে দেবার একটি প্রচেষ্টা। ১৯১৫ থেকে ১৯১৭- এই দুই বছরে ১৫ লক্ষ আর্মেনিয়ানকে তুরষ্ক হত্যা করেছে। আর্মেনিয়ানরা ছিলো ধর্মে খ্রিস্টান। এ কারণে অটোম্যান শাসকরা জিজিয়া কর হিসেবে তাদের কাছ থেকে মুসলিমদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি খাজনা ধার্য করেছিলো। একই সঙ্গে কাফের হওয়ার দরূণ তাদের ছিলো না রাষ্ট্রীয় কোন পদে বসার অধিকার। তবু এই জনগোষ্ঠি লেখাপড়া শিখে দ্রুত নিজেদের উন্নত করে ফেলছিলো। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের চেয়ে তারা শিক্ষায় অর্থে বড় হবার কারণে তাদের প্রতি ক্ষোভ ঈর্ষা জেগে উঠেছিলো। তুর্কি শাসকরা প্রথম যুদ্ধ চলাকালে সিদ্ধান্ত নেয় আর্মেনিয়াদের জাতিগতভাবে নিধন করে নিশ্চিহৃ করে ফেলা হবে। সেই মোতাবেক দুই বছরে ১৫ লক্ষ মানুষকে তারা হত্যা করে। বাকীরা প্রাণ হাতে নিয়ে জন্মভূমি ত্যাগ করে আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী দেশগুলোতে। ইতিহাসের এই ম্যাসাকারের প্রতি মুসলিম বিশ্ব ঢাল হয়ে তুরষ্ককে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছে। এমন কি এই সেদিন জার্মানীর পার্লামেন্ট যখন আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে তুরস্কের আগ্রাসনকে ‘গণহত্যা’ স্বীকৃতি দিয়ে বিল পাশ করে তখন তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগান রেগে আগুন হয়ে বলেন, তুরস্ক সেসময় যা করেছে সেটা সেই সময়কালের জন্য সঠিক ছিলো… জার্মানির কোন অধিকার নেই এই বিষয়ে কথা বলার…।

বার্মিজদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নিশ্চহৃ করে দেবার অভিযোগ করা হয়। সারা বিশ্ব এ জন্য সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের অন্তর্ভূক্ত কোন মুসলিম দেশের চালানো এরকম কোন আগ্রাসনকে প্রটেক্ট দিতে মুসলমানরা গঠন করেছে ওআইসি। এই সংগঠন মুসলিম দেশগুলো নিয়ে জাতিসংঘের অনুমোদিত একটি সংগঠন। যাদের কাজই হলো মুসলমানদের বৈশ্বিক অপকর্মকে ঢেকে রাখা, মিথ্যা নির্যাতন নিপীড়নের অভিযোগ তুলে বিশ্ব থেকে সহানুভূতি আদায় করা। এরা কিন্তু সৌদিদের চালানো ইয়েমেনের উপর নির্মম বিমান হামলা নিয়ে কোন শব্দ করে না। পাকিস্তানীদের বাংলাদেশের উপর চালানো বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম জঘন্ন ‘অপারেশন সার্চ লাইন’- যেদিন শুধুমাত্র ঢাকা শহরে লক্ষাধিক মানুষ মারা গিয়েছিলো- সে ব্যাপারে সেসময় তারা কিছু বলেনি। মধ্যরাতে চালানো এই অভিযানে ঘুমন্ত ঢাবাবাসীকে ঠান্ডা মাথায় হত্যার প্লাণ করেছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এতবড় হত্যাকান্ডের পক্ষে নিয়েছিলো ‘মুসলিম উম্মাহ’!

এসবের মূলে রয়েছে ইসলাম ধর্মের ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ নামের ফ্যাসিস্ট একটি অবস্থান। বার্মিজদের অন্যায়কে কেউ ধর্মীয় পরিচয়ে সাফাই গাইতে আসবে না। কারণ পৃথিবীতে ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদের’ মত আর কোন ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ নেই। বালি দ্বীপের হিন্দু আর ভারতবর্ষের হিন্দুদের মধ্যে হাজার চেষ্টা করলেও কোন মতে একটা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠানো সম্ভব নয়। আফগানিস্থানে বুদ্ধ মূর্তিগুলো তালেবানরা গুড়িয়ে দিলেও তাই জাপান কোরিয়াতে কোন মসজিদে আগুন লাগেনি। ঐসব দেশগুলো কোন উত্তেজনা দেখায়নি। অথচ কোথায় কে একটা মুহাম্মদের কার্টুন আঁকল আর বোমা ফুটল প্যারিসের একটা স্কুলবাসে! এটাই ফ্যাসিজম। ফাসিজম সংখ্যালঘু হলেও তার চরিত্র জানান দিয়ে যাবে ক্ষণে ক্ষণে…।