১৯৪৬ সালের নোয়াখালী দাঙ্গা এক বিস্মৃত ইতিহাস:

কলকাতায় যখন দাঙ্গা হয় তখন নোয়াখালীতে তখন কোন সহিংসতা হয়নি।যদিও তখন থেকেই আবহাওয়া গরম হতে শুরু করে। কলকাতা দাঙ্গার এক সপ্তাহের মধ্যে এবং নোয়াখালীতে দাঙ্গার ছয় সপ্তাহ আগে কলকাতায় অবস্থিত ইস্টার্ন কম্যান্ড হেডকোয়ার্টার এমন কিছু রিপোর্ট হাতে পায় যেখানে বলা হয়েছিল চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর গ্রাম এলাকায় মুসলিমরা উত্তেজিত এবং গ্রামের মুসলিমরা হিন্দু বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে|

ঈদের দিন:
১৯৪৬ সালের ২৯ আগস্ট ছিল ঈদ-উল-ফিতর| পরিকল্পিত ভাবে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হল যে,হিন্দু সম্প্রদায় অস্ত্র হাতে জড় হচ্ছে। ফেনী নদীতে মাছ ধরার সময় কিছু হিন্দু জেলেকে মুসলিম সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করলো। একজন মারা যায় আর আরও দুজন মারত্মক আহত হয়। রামগঞ্জ থানার আওতায় বাবুপুর গ্রামের কংগ্রেস নেতার ছেলে দেবীপ্রসন্ন গুহকে মুসলিমরা হত্যা করে। দেবীপ্রসন্নের আরেক ভাই এবং তাদের কর্মচারীকে মারাত্মক ভাবে আহত করে তারা। দেবীপ্রসন্নের বাড়ির সামনে থাকা কংগ্রেস অফিস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। মনপুরার চন্দ্রকুমার কর্মকারকে ও ঘোষবাগের হোটেল কর্মচারী যামিনী দে কে হত্যা করা হয়। কানু চরে ছয় থেকে সাতটি হিন্দু পরিবারের সকল সম্পত্তি লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়। করা পাড়ায় ভারী অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত মুসলিম সন্ত্রাসীদের দল যাদব মজুমদারের বাড়িতে হানা দেয় এবং তার সমস্ত সম্পদ লুট করে নিয়ে যায় যার আনুমানিক মুল্য ছিল তৎকালীন ১,৫০০ টাকা। রাইপুরের হরেন্দ্রনাথ ঘোষের পারিবারিক মন্দিরে হামলা করে উগ্র মুসলিমরা এবং একটি বাছুরের গলা কেটে মন্দিরটির ভিতর ছুড়ে ফেলা হয়|

সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো:
দিয়ারা শরীফ,শ্যামপুর। দাঙ্গার অন্যতম নায়ক গুলাম সরোয়ার হুসেনির বসত বাড়ি| তারা বংশানুক্রমিক ভাবে শ্যামপুরের দিয়ারা শরীফের খাদিম ছিল। দিয়ারা শরীফ ওই এলাকার হিন্দু-মুসলিম সবার কাছেই খুব পবিত্র স্থান হিসেবে গন্য হত। কলকাতা দাঙ্গার প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের পর থেকেই হুসেনি উস্কানি মুলক বক্তব্য দেয়া শুরু করে এবং মুসলিমদেরকে হিন্দু নিধনে উৎসাহিত করতে থাকে। কিছু এলাকায় মুসলিমরা হিন্দু দোকান-পাট থেকে দ্রব্যাদি কেনা থেকে বিরত থাকে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুসলিম সন্ত্রাসীরা সাহাপুরের হিন্দু দোকান-পাট লুট করে। কলকাতা থেকে যে সকল হিন্দু তাদের গ্রামে দুর্গা পূজার ছুটি কাটাতে এসেছিল তারা স্থানীয় মুসলিমদের হাতে হয়রানি,নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার হয়। অক্টোবরের ২ তারিখ থেকে সুযোগ পেলেই হিন্দুদের সম্পদ লুট,হিন্দুদেরকে হত্যা ও নির্যাতন শুরু হয়।

গণহত্যা:
১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসের ১০ তারিখ। লক্ষ্মী পূজার দিন। নোয়াখালীর হিন্দুরা বাড়িতে পূজার আয়োজনে ব্যস্ত। অন্যদিকে মুসলিম লীগ নেতারা তখন ব্যস্ত মিথ্যা সংবাদ আর গুজব রটাতে। তারা চারিদিকে গুজব ছড়িয়ে দেয় যে,শিখ সম্প্রদায় দিয়ারা শরীফ আক্রমন করেছে। ছড়িয়ে পড়া গুজবে আশে পাশের এলাকার মুসলিমরা দলে দলে দিয়ারা শরিফে জড় হতে শুরু করে। গোলাম সরোয়ার হুসেনি সমবেত মুসলিমদেরকে সাহাপুর বাজার আক্রমন করতে নির্দেশ দেয়।কাশেম নামের আরেকজন মুসলিম লীগ নেতাও তার নিজস্ব বাহিনী নিয়ে সাহাপুর বাজারে পোঁছায় যাদেরকে কাশেমের ফৌজ বলা হত। গুণ্ডারা সুরেন্দ্রনাথ বসুর ‘জামিনদার অফিস’ আক্রমন করে।সামান্য প্রতিরোধের পরই সুরেন্দ্রনাথ বসু ধারাল অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মক ভাবে আহত হন। মুসলিম সন্ত্রাসীরা হাত-পা বেধে তাকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। অক্টোবর মাসের ১১ তারিখে গোলাম সরোয়ারের ব্যক্তিগত বাহিনী যা ‘মিঞার ফৌজ’ নামে পরিচিত ছিল নোয়াখালী বার এ্যাসোসিয়েশন সভাপতি রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরীর বসতবাড়িতে আক্রমন করে। রাজেন্দ্রলাল পুরোটা দিন তাঁর বাড়ির ছাদ থেকে রাইফেল নিয়ে আক্রমন প্রতিহত করে। পরের দিন আবার মুসলিম দাঙ্গাকারীরা সংগঠিত হয়ে রাজেন্দ্রলালের বাড়িতে আক্রমণ করে। তারা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।রাজেন্দ্রলাল, চিন্তাচরন এবং সতীশ সহ পরিবারের ২২ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়। রাজেন্দলাল রায় চৌধুরীর শরীর থেকে মুন্ডু চ্ছিন্ন করে ফেলা হয় ও সেই ছিন্ন মুন্ডু একটি থালায় করে গোলাম সরোয়ার হুসেনির কাছে নিয়ে আসে তার বাহিনী। রাজেন্দ্রলালের বাড়ি থেকে তাঁর দুই মেয়েকে তুলে নিয়ে আসে হুসেনির বাহিনী যাদেরকে হুসেনি তার দুই বিশ্বস্ত অনুচরকে গনিমতের মাল হিসেবে দেয়। তিন মাস পরে নোয়াখালী পরিদর্শনের সময় মহত্মা গান্ধী লুটপাট আর ধ্বংসকৃত রাজেন্দ্রলালের বাড়িতে যান। ১৯৪৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাজেন্দ্রলালের গলিত দেহ আজিমপুরের জলা থেকে তুলে লামচর হাই স্কুলে গান্ধীজীর প্রার্থনা সভাতে নিয়ে আসা হয়।

রামগঞ্জ পুলিশের আওতায় সোমপাড়া বাজারের কাছে গোপাইরবাগে দাস পরিবারের উপর কাশেমের নিজস্ব বাহিনী আক্রমণ করে। দাস পরিবার ছিল কাশেমের প্রতিবেশী। আক্রমণকারী বাহিনী দাস পরিবারের ১৯ জনকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। নোয়াখোলা গ্রামের চৌধুরী পরিবারের উপর হামলা চালায় বর্বর দাঙ্গাকারীরা। হামলাকারীরা উন্মত্তের মত হত্যার তাণ্ডব চালায়, লুটপাট করে এবং আগুন লাগিয়ে দেয়। ওই বাড়ির মোট ৮ জন পুরুষদের সবাইকে হত্যা করা হয়। আরেকটি দল রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের গোবিন্দপুরের যশোদা পাল ও ভরত ভূঁইয়ার বাড়িতে আক্রমণ করে।তারা পরিবারের ১৬ জনকে দড়ি দিয়ে বেধে জীবন্ত আগুন লাগিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করে। আমিশাপাড়া এবং সাতঘরিয়ার মধ্যবর্তী এলাকার ভৌমিক এবং পাল পরিবারের সবাইকে আগুনে পুড়িয়ে ছাই বানানো হয়। এই দুই পরিবারের ১৯ জনকে হত্যা করা হয়। ১৩ অক্টোবর দুপুর ১২টার সময় মারাত্মক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত ২০০-২৫০ জনের একটি দল চাঙ্গিরগাঁও এর হিন্দুদের উপর হামলে পড়ে। তারা হিন্দুদের ১,৫০০ মণ ধান পুড়িয়ে দেয়। এলাকার সমস্ত মন্দির গুড়িয়ে দেয়া হয়। সকল হিন্দু মহিলাদের শাঁখা ভেঙ্গে ফেলে, সিঁথির সিঁদুর মুছে দেয় আর হিন্দু পুরুষদের নামাজ পড়তে বাধ্য করে। চাঁদপুর থেকে যোগেন্দ্র চন্দ্র দাস (এম.এল.এ. ) অক্টোবরের ১৪ তারিখে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলেকে চিঠিতে লেখেন,নোয়াখালীর রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় হাজার হাজার নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের উপর নির্যাতন করে মুসলিমরা। তাদের বাড়িঘর লুটপাট করে,আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় বসত ভিটা আর তাদেরকে জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরকরনের মত ঘৃণ্য কাজ করে তারা। সন্দীপে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী লালমোহন সেন হিন্দুদের রক্ষার চেষ্টা কালে তাঁকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়।

এই লেলিয়ে দেয়া নৃশংসতাকে বর্ণনা করা হয়, ‘( the organised fury of the Muslim mob)’ । গান্ধীবাদী অশোক গুপ্ত গান্ধীর সাথে গনহত্যা সংগঠনের এলাকা গুলো পরিদর্শন করে বলে: ‘কমপক্ষে ২,০০০ হিন্দুকে জোরপূর্বক মুসলমান করা হয়েছে।তিনি অন্তত ছয় জনকে দেখেছেন যাদের জোর করে বিয়ে করেছে মুসলিমরা এবং যাদের একজন খুন হয়েছে পাশবিক ভাবে।’

(চলবে)…………….

সুত্র:
১. https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%A8%E0%A7%8B%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6…
২.Time। ২৮ অক্টোবর ১৯৪৬।
৩.Khan, Yasmin (২০০৭)। The Great Partition: The Making of India and Pakistan। Yale University Press। পৃ: 68–69। আইএসবিএন 9780300120783।
৪.”Fatal flaw in communal violence bill”। Rediff.com। ২ জুলাই ২০১১। সংগৃহীত ২ আগস্ট ২০১১।
৫.Sinha, Dinesh Chandra; Dasgupta, Ashok (2011). 1946: The Great Calcutta Killings and Noakhali Genocide. Kolkata: Himangshu Maity. pp. 278–280. ISBN 9788192246406.