বাঙালির সমস্যাঃ সমাধান কোন পথে
সম্প্রীতি চলে গেল, সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে বলে হা হুতাশ করছেন করুন (বাংলায় ওয়াহাবি আসার পর থেকেই ঘোর মৌলবাদ, বিশেষ করে ইসলামিক মৌলবাদ ছিল, স্রেফ আপনি জানতে পারতেন না, এই যা), কিন্তু বাঙালির মেধার অবনমন নিয়ে আসল দুঃখটা করা উচিত। বাঙালির মধ্যে যারা সম্প্রীতিবাদী আর যারা সাম্প্রদায়িক, উভয়েই পাল্লা দিয়ে নিম্নমেধার গবেট ফোয়ারা ছোটাচ্ছেন, এটা প্রধান আশঙ্কার কারণ আমার মতে। কারও বিন্দুমাত্র পড়াশোনা নেই। একসময় বাঙালিদের মধ্যে বঙ্কিম ছিলেন সাম্প্রদায়িক। সম্প্রীতিবাদী বললে লোকের রামমোহন মনে পড়ত।
অবনমন ঘটেছে, মারাত্মক।
ভারত নিয়ে দুঃখ না করে, বাঙালিকে নিয়ে দুঃখ করুন। যে জাতি ভারতের স্বাধীনতার জন্য সবথেকে বেশি রক্ত দিয়েছে, স্বাধীন ভারতে তারাই সবথেকে কোনঠাসা আর বিধ্বস্ত হল। ভারতের গভীরতম অসুখ হল এই যে এখানে বাঙালির কোনও কণ্ঠস্বর নেই। ভারতকে সারিয়ে তুলতে গেলে বাঙালিকে আরেকবার ক্ষমতাকেন্দ্রে আসতে হবে। বাকিরা ভারতকে স্রেফ দুধেল গাই হিসেবে দেখছে। মনমোহনের সময় পাঞ্জাবী লবি ভারত চালাত, এখন মোদির গুজরাটি লবি চালায়। উত্তর প্রদেশও অনেকদিন ভারত চালিয়েছে, ফলে দেশটা আরও ছন্নছাড়া হয়েছে। এ দেশটা বাঙালির হাতে যাওয়ার কথা ছিল, এ দেশটাকে আধুনিক যুগে শাসনের একমাত্র উপযুক্ত ছিল বাঙালি। সেই জাতটাকে ধ্বংস করে দিয়ে ইংরেজ নিশ্চিত করে গেছে, যাতে ভারত চিরকাল গ্লোবাল ভিলেজের সিনেমা হলের সামনে লেংচে লেংচে আচ্ছে দিনের টিকিট ব্ল্যাক করে বেড়ায়। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী মারাত্মক মর্কট না হলে ব্রিকস সামিট এইভাবে গুবলেট হত না। জিও স্ট্র্যাটেজিক কারণে রাশিয়ার গুরুত্ব আছে ভারতের কাছে, সেটা নেহরুর দলে কমিউনিস্টরা ছিল বলে নেহরু বুঝেছিল, ইন্দিরাও। রাশিয়াকে সঙ্গে না নিয়ে অ্যামেরিকার মত খচ্চরের ওপরে বিশ্বাস রেখে ভারতের পক্ষে সুপারপাওয়ার হওয়ার চেষ্টা হল গুজরাটি বানিয়ার মোটাভাই মার্কা বুদ্ধি। ঐ বুদ্ধিতে আম্বানি আদানির বিজনেস এম্পায়ার চলতে পারে, অ্যামেরিকা ক্যানাডায় মোটেলও চলতে পারে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি চলে না। যাকগে, বাঙালি আজ আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবরে কাজ নেই। শক্তিকেন্দ্র তৈরি করা এই মুহূর্তে বাঙালির প্রধান কাজ।
বাইরের শত্রুদের সঙ্গে লড়ার সময় এটা নয়। উইকিপেডিয়ার উড়েদের সঙ্গে লড়তে গিয়ে সেদিন আমাদের একজন ব্লকড হলেন। আমি বাংলাদেশের ইসলামিস্টদের হাতে তিন বছর আগে ব্লকড হয়েছিলাম। আগের বছর আমরা নিজেদের বাঙালিউইকি বানিয়েছি, কারণ অন্যদের সঙ্গে এই দুর্বল অবস্থায় লড়তে যাওয়া অর্থহীন। উড়েদের আগ্রাসনের পেছনে ওদের পুরো রাজ্য সরকার আছে, প্রচুর রিসোর্স আছে, বহুদিনের অভ্যস্ত বাঙালি-দ্বেষ আছে, উড়ে সুপ্রিম্যাসির ধারণা আছে, একটা উড়ে জাতীয়তাবাদী দল আছে, বিজেডি, তারা ওদের সরকার চালায়। বাঙালির ভাঁড়ে মা ভবানী। নিজেদের শক্তি গড়ে না তুলে ইসলাম বা উড়ে, কারও সঙ্গে লড়তে যাওয়া নিরর্থক। গোর্খা আগ্রাসন আটকানো গেছে শিলিগুড়ির বাঙালিরা একসময় এককাট্টা হয়ে লড়েছেন বলে। কিন্তু আসামে বাঙালিকে আবার তাড়ানো শুরু হতে পারে। আমাদের পক্ষে সেটাকে আটকানো দূরে থাক, তা নিয়ে একটা ঐক্যবদ্ধ বিবৃতি দেওয়াই সম্ভব নয়। আমরা বাঙালি বলছে দেখলাম, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সকল বাংলাভাষীকে আসামে নাগরিকতার অধিকার দিতে হবে। তা বাংলাদেশ থেকে চলে আসা বাংলাভাষী হিন্দু তো উদ্বাস্তু, শরণার্থী। সে ইসলামিক বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছে প্রাণ ও মানসম্মান বাঁচাতে। বাংলাভাষী মুসলমান কি যুক্তিতে বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হল, সেটা যতক্ষণ না আমরা জানতে পারছি, কি বিবৃতি দেব বলুন তো? অ্যাজ ইফ সেই বিবৃতিতেও কোনও কাজ দেবে। ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, নিধিরাম সর্দার হয়ে যারা বসে আছে, তারা বিবৃতি দিলে সেগুলো ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটের শোভা বাড়ায় কেবল। আসামে বাঙালির গায়ে হাত পড়লে এখান থেকে আসামে ঢুকে আসামীদের প্যাঁদাবো, বিধান রায়রা বলেন নি। আজও কেউ কিছু বলবে না।
ফোঁস যে করতে পারে না, সে মার খাবেই। কে আটকাবে?
দরকার বাঙালির ক্ষমতা, দরকার বাঙালির অর্থবল।
যুক্তিবাদ দিয়ে যুদ্ধ জেতা যায় না, জেতা গেলে তারক বিশ্বাসকে আজও হাজতে থাকতে হত না। আইনি যুদ্ধ সততা দিয়ে নয়, অর্থ খরচ করে ভালো উকিল দিয়ে জিততে হয়। রাজনৈতিক যুদ্ধ মরালিটি দিয়ে জেতা যায় না। জনমতকে সুসংহত করার অ্যাপারেটাস যার হাতে আছে, সে রাজনীতির যুদ্ধ জিতে যায়।
বাঙালি তার ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার আদর্শ, বিশ্বমানবতার আদর্শ নিয়ে বসে থাকলে জাতি হিসেবে, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সম্প্রদায় হিসেবে নিশ্চিত ধ্বংস হবে।
ইসলামের আগ্রাসন নিয়ে বেশি ভাববেন না, বাঙালির পক্ষে একে আটকানো ছেড়ে দিন, আরএসএস-এর হাতেও এর কোনও সমাধান নেই। ওর সমাধান আন্তর্জাতিক স্তরে কনসেনসাস, মতৈক্য না তৈরি হলে আসবে না। রুশ, চীন, পশ্চিম ইউরোপ, অ্যামেরিকা। এরা ততদিন পর্যন্ত ইসলামকে সহ্য করে যাবে যতদিন আরব দেশের পেট্রল আছে। ততদিনে কয়েকটা অমুসলিম জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে আরব সাম্রাজ্যবাদের হাতে। বাঙালি সেই বিপদতালিকায় আছে। নিজেকে রক্ষার ব্যবস্থা করুন, সে রক্ষার উপায় শুধু বাঙালি জাতীয়তাবাদে আছে। হিন্দুত্ব অত্যন্ত অর্থহীন, কারণ বাকি ভারতের হিন্দুরা বাঙালিকে নিয়ে ভাবিত নয়। পাঞ্জাবের শিখ, আসামের শৈব, গুজরাটের বৈষ্ণব, মহারাষ্ট্রের গাণপত্য, কেউই বাঙালিকে নিয়ে ভাবিত নয়। বিশ্বহিন্দুত্ববাদ একটা অলীক ব্যাপার। বাঙালির এখন এই অলীক ব্যাপারে নিজের এনার্জি একফোঁটাও নষ্ট করা উচিত না।
বস্তুত বাকি ভারতে বাঙালির বাঁচামরা নিয়ে অনেকেই উদাসীন হলেও একটা বড় অংশ গোপন আনন্দে আছে। ইসলামের হাতে বাঙালি শেষ হয়ে গেলে একটা আপদ বরাবরের মত বিদায় হবে, কেউ কেউ সেই অপেক্ষায়।
বাঙালির আসল সমস্যা সে ইমিউনোডেফিসিয়েন্সিতে ভুগছে। ইসলাম আসল সমস্যা নয়। ইসলামের প্রতিক্রিয়ায় হনুমানত্ব বাড়ছে, সেটাও আসল সমস্যা নয়। এগুলো উপসর্গ। যার প্রতিরোধের ক্ষমতা নষ্ট, সে সামান্য সর্দিকাশিতেও মরে যেতে পারে। বাঙালি তো সেখানে রীতিমত মৃত্যুশয্যায়, এখন রোগের দাপাদাপি চলবেই।
একমাত্র ওষুধ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সেই আয়ুর্বেদের নির্মাণে সর্বশক্তি দিতে হবে আজ। এ ছাড়া বাঙালিকে বাঁচানোর রাস্তা নেই। তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, শেকড়, কৃষ্টি, মেধা, অধিকার বাঁচানোর আর রাস্তা নেই। নান্য পন্থা বিদ্যতে।