ইসলামী হিংসার নীরব সাক্ষী বাংলাদেশের খুলনা::

ইসলামী হিংসার নীরব সাক্ষী বাংলাদেশের খুলনা::
—————————————————–

খুলনা একসময় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হিন্দু অধ্যুসিত এলাকা ছিল । ১৯৬০ সালে আজকের বাংলাদেশ,অর্থাৎ তখনের পূর্ব পাকিস্থানের খুলনা জেলার আব্দুর সবুর খান রূপচাদ নামক একজন হিন্দুর জামি দখল করে তার উপরে ৫ তলা বাড়ি করেছিল। রুপচাদ কোর্টে মামলা করে আর সেই মামলায় জিতে যায়। এই পরাজয় আব্দুর সবুর খান মেনে নিতে পারেনি, সে জেদ পুষে রাখে। এরপর ১৯৬৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর কাষ্মীরের হজরত বাল মসজিদে রাখা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানব মহানবীর বাল-মুবারক বা চুল চুরি হয়ে গেছ বলে উপমহাদেশে গুজব ছড়ালো। পাকি শাসক আইয়ুব খান বিবৃতি দিল: “এর ফলাফল হিসাবে হিন্দুদের উপর কি হবে আমি জানিনা, আমি কোন দায় নিতে পারবোনা।” ম্যাজিকের মত আবার কয়েকদিনের মধ্যেই ,২ জানুয়ারীতে বাল-মুবারক উদ্ধার হলো ! বাল-মুবারক পাওয়া গেলে কি হবে? ১৯৬৪ সালের ৩ জানুয়ারী থেকে ৭ জানুয়ারী পর্যন্ত খুলনার হিন্দুদেরকে দেশ ত্যাগ করে চলে যেতে হলা হলো এবং লিফলেট বিতরণ করা হলো । দিকে দিকে স্লোগান উঠলো:’ একটা দুইটা হিন্দু ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর !’ রাগ পুষে রাখা আব্দুর সবুর ময়দানে নামল । আব্দুর সবুর খানের নেতৃত্বে খুলনার জায়গায় জায়গায় হিন্দুদের উপর আক্রমন নেমে এলো । রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হিন্দু হোস্টেলের উপর সারারাত ইট ছুড়ল জামাতি ইসলামীরা । আক্রমন কেবল খুলনাতেই সীমিত রইলো না ! ১৪ জানুয়ারী, ১৯৬৪, চট্টগ্রাম থেকে সিরাজগঞ্জগামী ট্রেন ঢাকার টঙ্গি এবং তেজগাও থামার পরে ট্রেন ঘিরে ফেলা হলো এবং হিন্দুদের ট্রেন থেকে নামতে বলা হলো । যারা নামল না, তাদেরকে লাগাতার খুন করা হলো !

ফেরত আসি খুলনার মূল ঘটনায় । মজিদ মিয়াঁ নামে সবুর খানের মনোনীত প্রার্থী জেলা পরিষদ নির্বাচনে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়। সবুর খান ও চামকুরি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সহ তাদের দলের অন্যান্য সদস্যরা এই পরাজয়ের কারণ হিসেবে হিন্দুদেরকে দায়ী করে এবং হিন্দুদের প্রতি হুমকি,ভয়-ভীতি প্রদর্শন করতে শুরু করে। এই সময়ের প্রেক্ষাপটেই কাষ্মীরের হজরত বাল মসজিদে রাখা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানব মহানবীর বাল-মুবারক বা চুল চুরি হয়ে গেছ বলে উপমহাদেশে গুজব ছড়ানো হয়েছিল । হিন্দু নিকেশের জন্য এই সুযোগ সবুর খান স্বাদরে গ্রহণ করেছিল । হজরতবাল ঘটনার জন্য ১৯৬৪ সালের ২ জানুয়ারি তারিখে, মুসলিমরা হিন্দুদেরকে পায়ে জুতো পরতে, মাথায় ছাতা ব্যবহার করতে কিংবা রিকশায় চড়তে বাধা দেয় । বিকাল চারটেতে খুলনায় হিন্দু নিধন শুরু হয়। টানা চার ঘণ্টা এই নারকীয় কর্মকান্ডের পর রাত আটটায় সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। প্রাদেশিক মুসলিমলীগ ৩ জানুয়ারিকে ‘কাশ্মীর দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করলো আর পরিস্থিতিকে আরও বিভীষিকাময় ও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। দৌলতপুর শিল্প এলাকায় এক বিশাল জনসভায় আব্দুস সবুর খান ভাষণ দিল। সবুর খান এই সুযোগে হিন্দু বিদ্বেষী এবং ভারত বিরোধী জ্বালাময়ী ভাষণ পেশ করলো । সঙ্গে সঙ্গে সমাবেশ থেকে প্রায় ২০,০০০ মুসলিম জনতা সেনহাটি (দিঘলিয়া উপজেলা), মহেশ্বরপাশা, পাবলা,চন্দনীমহল, দৌলতপুরসহ আশেপাশের হিন্দুপ্রধান জনবসতি গুলোর উপর তীব্র আক্রোশে আক্রমণ শুরু করে দিল । হিন্দুদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মস্থান লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হলো । নির্মমভাবে হত্যা হলো বহু হিন্দু, লুট করা হলো মা বোনের সম্ভ্রম ! পরবর্তী চার দিন খুলনার হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর লাগামহীন হত্যা,ধর্ষণ,অপহরণ, লুণ্ঠন, ধ্বংসের এক বন্য বীভৎসতা চলে।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার মুসলিম শ্রমিকরা হিন্দুদের উপর এই জঘন্য,অমানবিক জিঘাংসা চালায় আর লোপপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এদেরকে মারণাস্ত্র সরবারহ করে । খুলনা লঞ্চঘাটে কমপক্ষে ২০০-৩০০ হিন্দুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ! মোংলা বন্দরে ৩০০ হিন্দুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। লোপপুর বাজারে আব্দুস সবুর খান একটা জনসভায় বলেছিল, সে হিন্দুদের পিঠের চামড়া তুলে পায়ের জুতো তৈরি করবে। আব্দুল মোনায়েম খান, ভূতপূর্ব পূর্ব-পাকিস্তান আইনপরিষদের সদস্য এবং তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য কাজী আব্দুল কাদের এসব ঘটনায় স্পিকটি নট ! পাকিস্তানে গণমাধ্যমের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে সম্পূর্ণভাবে কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল। ফটো তোলাও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। দৈনিক ইত্তেফাক ও পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় কিছু সত্য ঘটনা প্রকাশের জন্য সেগুলোর উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।এর প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের পাঁচটি দৈনিক পত্রিকা তাদের ছাপানো বন্ধ করে দেয় !

খুলনাসহ সমগ্র আজকের বাংলাদেশে সেসময়ে দিন প্রতি ৫,০০০ থেকে ৬,০০০ হিন্দু সর্বস্ব ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচানোর জন্য ভারতীয় দূতাবাসের সামনে জড় হত আর মাত্র ৩০০-৪০০ ভাগ্যবান হিন্দুই ভারতে প্রবেশের অনুমতি পেত। সংখাতীত দেশান্তরের কারণে পূর্ব-পাকিস্তানের একমাত্র হিন্দু গরিষ্ঠ জেলা খুলনাও মুসলিম গরিষ্ঠ জেলাতে রূপান্তরিত হলো । আলটিমেটলি এটাই তো হওয়ার, কেননা -৯৮ নম্বর সুরার(সূরা আল বাইয়্যিনাহ) ৬ নাম্বার আয়াত:

” আহলে-কিতাব ও মুশরেকদের মধ্যে যারা কাফের, তারা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। তারাই সৃষ্টির অধম।”

রেফ: ১.Trivedi, Rabindranath (২৩ জুলাই ২০০৭)। “The Legacy of the plight of Hindus in Bangladesh – Part-VII: Bengali Muslims Fight Communalism in 1964”
২.Mukhopadhyay, Kali Prasad (2007). Partition, Bengal and After: The Great Tragedy of India. New Delhi: Reference Press. p. 48
৩.Bhattacharyya, S.K. (1987). Genocide in East Pakistan/Bangladesh. Houston: A. Ghosh (Publisher). p. 95.
৪.. Nevard, Jacques (২৪ জানুয়ারি ১৯৬৪)। “Riots Arouse Moslem Shame”।