অনেক আমাকে প্রশ্ন করছেন, ডাঃ মনীষাকে সমর্থন করলাম?

“অনেকে আমাকে ইনবক্স করে জানতে চেয়েছেন, আমি কেন নির্বাচনে সিপিবি’র প্রার্থী এ কে আজাদকে সমর্থন না দিয়ে বাসদের ডাঃ মনীষাকে সমর্থন করলাম? তাদের সেই প্রশ্নের একটি আলোচনা পয়েন্ট আকারে এখানে রাখলাম।

এ সময়কালে অনেকগুলো নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু সমসাময়িক কোন নির্বাচনে বামদের কোন প্রার্থীকে নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে এতটা আলোচনা হয়নি, যেটা বরিশালের মেয়র নির্বাচনে মনীষাকে ঘিরে হচ্ছে! কিন্তু বরিশালে মেয়র নির্বাচনে জোটের দুই প্রার্থীকে নিয়ে এক অস্বস্তিকর বিতর্কের চলছে। আর এই ঘটনাটা ঘটছে ঠিক বামদের নতুন জোট গঠনের পরপরই। এবং সিপিবি হচ্ছে এই জোট গঠনের প্রধান উদ্যেক্তা এবং বলা যায় এই জোট সিপিবি’র অনেক দিনের প্রচেষ্টার ফসল। ঐক্য প্রক্রিয়ার পর্যায়ে গতবছর জুলাই মাসে শহীদ মিনারের এক সমাবেশে সিপিবি নেতা সেলিম ভাই বলেছিলেন, নেতৃত্ব বুর্জোয়াদের হাতে থাকবে না, এবার নেতৃত্ব থাকবে বামপন্থিদের হাতে। কর্মীদের কাছে আহ্বান জানাব, ঐক্যের ক্ষেত্রকে চোখের মনির মতো রক্ষা করবেন। আমি নিজেও যদি এদিক-সেদিক করি, পেছন থেকে গরুকে যেমন রাখাল ঠিকপথে পরিচালনা করে, আপনারা নিজে থেকেও একটা ঐক্যের আবহ তৈরি করেন, তৃণমূল পর্যন্ত ঐক্যের ধারাকে প্রবাহিত করুন।”

জোটের আত্মপ্রকাশের পর এই নির্বাচনের মাধ্যমে জোটকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসার একটা সুযোগ ছিল, এবং মেয়র নির্বাচনের এই ইমেজ-আবহকে জাতীয় নির্বাচনে কাজে লাগানোর সুযোগ ছিল। আমার মনে হয় বামরা সেই সুযোগটি হাতছাড়া করল। এ বিষয়ে জোটভুক্ত অন্যান্য বামদলগুলোরও কোন উদ্বেগ বা দৌড়ঝাপ দেখলাম না! জোটকে ঘিরে সেলিম ভাইয়ের যে বক্তব্য তা অন্যদের মধ্যে লক্ষ্য করলাম না! যাইহোক বরিশালের নির্বাচনে বাম জোটের বড় দল হিসেবে সিপিবি’র ছাড়ের মাধ্যমে জোটে এক ধরণের অভিভাবকত্ত পেতো, কিন্তু সেটাও হলো না! সেটা না করার মাধ্যমে অন্যান্য দলগুলোর মতই এক ধরণের সীমাবদ্ধতার প্রকাশ ঘটল।  

১. মনীষা চক্রবর্তী প্রথম কোন মেয়ে যে বাসদ ও বামদের মধ্য থেকে প্রথম মেয়র নির্বাচনে অংশগ্রহন করছে, এক্ষেত্রে তাকে সবার সহযোগিতা করা উচিত বলে মনে করি। এতে করে বাংলাদেশে তরুণ নারীনেতৃত্ব উৎসাহী হবে। 

২. মনীষা বয়সে তরুণ, তারুণ্যের প্রতীক, ওর নির্বাচনের মাধ্যমে তরুণরা ইতিবাচক রাজনীতিতে, নির্বাচনে ও নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত হবে,

৩. মনীষা প্রগতিশীল রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে, তার দাদা মুক্তিযুদ্ধে নির্মম ভাবে নিহত হয়েছেন, তার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সে নিজেও ৩৪ তম বিসিএস’র সুযোগ-নিয়োগ গ্রহন করেনি। দেশের প্রতি তাদের পরিবারের অবদান–ভূমিকার কথা বরিশালের সবার জানা। পারিবারিক ভাবেই সে রাজনৈতিকভাবে পরীক্ষিত ও প্রমানিত।  

৪. মনীষা নিজে ক্যারিয়ার দিকে না যেয়ে সমাজবদলের রাজনীতি করছে। আজকের তরুণদের মধ্যে সেটা বিরল, সে কারণে তার সাফল্য ও অগ্রগতি অন্যান্য তরুণদের প্রগতিশীল রাজনীতিতে উৎসাহিত করবে

৫. মনীষা তার চিকিৎসা বিদ্যাকে পেশা হিসেবে গ্রহন না করে, সেবা হিসেবে নিয়েছেন, এই দূর্যোগে, এই সময়ে এই ঘটনা একটি অনন্য দৃষ্টান্ত! তার এই আত্মত্যাগের উদাহরণ অন্যদের অনুসরণ করতে ও ভাবতে অনুপ্রানিত করবে।

৬. মনীষা জনবান্ধব একটি মেয়ে, ইতোমধ্যে সে গরীবের ডাক্তার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এবং সে তার ব্যক্তি ইমেজ দিয়ে এই দুঃসময়ে সে অধিক ভোট টানার ক্ষমতা ও যোগ্যতা রাখে

৭. মনীষা বুদ্ধিদীপ্ত মেয়ে, তার বলা-বক্তব্য, স্মার্টনেস ঈর্ষনীয়, যে কারণে প্রচার মাধ্যমও তাকে সামনে নিয়ে আসছে। এমন তরুণ মেধাবী রাজনীতিককে এগিয়ে যেতে সবার সাহায্য করা সবার কর্তব্য মনে করি, এতে প্রগতিশীল রাজনীতি লাভবান হবে।

৮. বয়স কখনো যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না, তাহলে ধরে নিতে হবে যার যত বয়স তার ততো যোগ্যতা! কারো দীর্ঘ রাজনৈতিক বয়স এক ধরণের নিষ্ঠা প্রমান করে, কিন্তু সেটা নির্বাচনী যোগ্যতা প্রমান করে না। সেই যুক্তি মানলে বলতে হয়, সিপিবি বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল তারা কয়বার ক্ষমতায় গেছে?

৯. শারীরিক ও রাজনীতির বয়সের চেয়ে রাজনীতিতে কে বেশী আলোচিত ও আলোড়িত সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মনীষা অল্প বয়সেই সেটা করতে সক্ষম হয়েছে।

১০. সিপিবি’র বির্ষীয়ান নেতা আজাদ, মনীষার চেয়ে অনেক ভোট কম পেলে সেটা কি বড় দল হিসেবে সিপিবি’র রাজনীতির জন্য সম্মানের হবে? কর্মীদের মনোবল কি ক্ষতিগ্রস্থ হবে না, অটুট থাকবে?

১১. মনীষা সংখ্যালঘু (?) পরিবারের একটি মেয়ে সে হিসেবেও তাকে সমর্থন দান করা উচিত মনে করি। কারণ বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর যে জুলম-নির্যাতন চলছে, তাতে তার রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সংখালঘুদের আত্মবিশ্বাসী করবে। (যদিও বিষয়টি উল্লেখ করতে আমি অস্বস্তি ও বিব্রত বোধ করছি)

১২. মনীষা মূলধারার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজেকে রাখতে পারলে, বামরা ২০০-৪০০ ভোটের বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে আসবে! এতে বামদের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে এবং তার নির্বাচনের মাধ্যমে বাম-রাজনীতির ইমেজ উদ্ধারের একটা সুযোগ ছিল। নির্বাচন যদি ভোটের কারণে-হিসেবে হয় তাহলে যার ভোট অধিক পাবার সম্ভবনা তাকেই মনোনয়ন দেয়া উচিত। সেটা করতে না পারা দলীয় সংকীর্ণতার পরিচয়।

১৩. পরীক্ষিত নেতৃত্ব খুবই আপেক্ষিক বিষয়, মতিয়া আপা, মানিক-নাহিদ-দোহা ভায়েরা কি পরীক্ষিত ছিলেন না? এ কথা বলে কাউকে যোগ্য-অযোগ্য ভেবে গ্রহন-খারিজের কোন বিষয় এখানে নেই!

১৪. মনীষা বাম জোটের একক প্রার্থী হলে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উপস্থিতিতে বরিশালে সদ্য ঘোষিত জোটের বিশাল সমাবেশে তাকে পরিচয় করিয়ে দিলে বামজোটের ইমেজ অনেক ইতিবাচক হতো। শীর্ষনেতারা বরিশালে জনসংযোগ করলে বামজোট কিছুটা হলেও বিকল্প রাজনীতির একটা গুঞ্জন নিয়ে আসতে পারতে। কিন্তু তারা এই সুযোগটা হাতছাড়া করল।

১৫. একাধিক প্রার্থী দেয়ায় স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে বামদের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এ বছর ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সেখানে বামরা সমঝোতার প্রার্থী দিতে পারবে বা দিতে সক্ষম হবে এমন ভাবনা-সম্ভবনা প্রশ্নবিদ্ধ হলো।
প্রসঙ্গত:
“যখন টাইটানিক ডুবছিল তখন কাছাকাছি তিনটে জাহাজ ছিল।
একটির নাম ছিল “স্যাম্পসন”। মাত্র সাত মাইল দুরে ছিল সেই জাহাজ। ওরা দেখতে পেয়েছিল টাইটানিকের বিপদ সংকেত, কিন্তু বেআইনি সীল মাছ ধরছিল তারা। পাছে ধরা পড়ে যায় তাই তারা উল্টোদিকে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে বহুদুরে চলে যায়।
এই জাহাজটার কথা ভাবুন। দেখবেন আমাদের অনেকের সাথে মিল আছে এর। আমরা যাঁরা শুধু নিজেদের কথাই ভাবি। অন্যের জীবন কি এল কি গেল তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই আমাদের। তাঁরাই ছিলেন ঐ জাহাজটিতে।

দ্বিতীয় জাহাজটির নাম “ক্যালিফোর্নিয়ান”। মাত্র চোদ্দ মাইল দুরে ছিল টাইটানিকের থেকে সেই সময়। ঐ জাহাজের চারপাশে জমাট বরফ ছিল। ক্যাপ্টেন দেখেছিলেন টাইটানিকের বাঁচতে চাওয়ার আকুতি। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকুল ছিল না  এবং ঘন অন্ধকার ছিল চারপাশ তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন ঘুমোতে যাবেন। সকালে দেখবেন কিছু করা যায় কিনা। জাহাজটির অন্য সব ক্রিউএরা নিজেদের মনকে প্রবোধ দিয়েছিল এই বলে যে ব্যাপারটা এত গুরুতর নয়।
এই জাহাজটাও আমাদের অনেকের মনের কথা বলে। আমাদের মধ্যে যারা মনে করেন একটা ঘটনার পর, যে ঠিক সেই  মুহুর্তে আমাদের কিছুই করার নেই। পরিস্থিতি অনুকুল হলে ঝাঁপিয়ে পড়বো।

শেষ জাহাজটির নাম ছিল “কারপাথিয়ান্স”।
এই জাহাজটি আসলে যাচ্ছিল উল্টোদিকে। ছিল প্রায় আটান্ন মাইল দুরে যখন ওরা রেডিওতে শুনতে পায় টাইটানিকের যাত্রীদের আর্ত চিৎকার।
জাহাজের ক্যাপ্টেন হাঁটুমুড়ে বসে পড়েন ডেকের ওপর। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন যাতে তিনি সঠিক পথ দেখান তাঁদের। তারপর পুর্ণশক্তিতে বরফ ভেঙ্গে এগিয়ে চলেন টাইটানিকের দিকে।
ঠিক এই জাহাজটির এই সিদ্ধান্তের জন্যেই টাইটানিকের সাতশো পাঁচজন যাত্রী  প্রাণে বেঁচে যান।

মনে রাখা ভাল এক হাজার কারণ থাকবে আপনার কাছে দায়িত্ব এড়াবার কিন্তু তাঁরাই মানুষের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেবেন যাঁরা অন্যের বিপদের সময় কিছু না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়েবেন । ইতিহাস হয়তো মনে রাখবেনা তাঁদের  কিন্ত মানুষের মুখে মুখে গাওয়া “লোকগাথা”য়
বন্দিত হবেন  তাঁরাই যুগে যুগে।”