আজ "নোয়াখালী দিবস" ……।।

বন্ধুরা ….

জানেন কি?? ….  আজ কোজাগরী পূর্ণীমার রাত, …  কিন্তু….  একটি বিশেষ রাত।
বিশেষতঃ পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা মানুষের কাছে। ……
আজকের দিনটিকে কি আপনাদের কারও মনে পড়ে? 
বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের বাঙ্গালীর কাছে? ….. মনে হয় না, তারা এই দিনটি সম্পর্কে কিচ্ছু জানে বলে।
আপনারও বা ক’জনই বা জানেন…..?? – বলা শক্ত !

– আজ “নোয়াখালী দিবস” ……।।

….. ঠিক ৭২ বছর আগে, ১৯৪৬’এর আজকের এই রাতেই চতুর্দিকে নদী ও সমুদ্র বিধৌত পূর্ববাংলার দুর্গম নোয়াখালীর হিন্দুদের উপর প্রথম নেমে এসেছিল ইসলামিক জেহাদের চরম বিভীষিকা ….
যা আজও একই ভাবে প্রবাহ মান …..

কিন্তু সেকুলারের দল … সেই নির্মম সত্যকে আজ … ইতিহাসের পাতা থেকেই মুছে ফেলে দিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে এই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে আবারও একবার নোয়াখালীর ছায়া ঘনাতে শুরু করেছে।…. যা আধুনিক প্রজন্মকে আজ না হয় কাল … পড়ে কিংবা জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতেই হবে। … কারও ছাড় নেই…..।। 

সেদিনের সেই অতৃপ্ত আত্মাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে …….আমার এই ক্ষুদ্র নিবেদন …

……….”শোকে স্মৃতিতে নোয়াখালী” ………

ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তথা … “নিঃশব্দ সন্ত্রাস, দ্বিখণ্ডিত মাতা ও ধর্ষিতা ভগিনী” সহ বেশ কয়েকখানি কালজয়ী পুস্তকের রচয়িতা শ্রদ্ধেয় শ্রী রবীন্দ্র নাথ দত্ত ….।।

**************************************************************************

১৯০ বছর ভারতে রাজত্ব করার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে অবস্থার চাপে ইংরেজরা যখন এদেশ ছেড়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন ঝোপ বুঝে কোপ মারার জন্য ভারতে বসবাসকারী মুসলমানেরা কাফের (ঘৃণিত) হিন্দুদের সাথে এক থাকলে ইসলাম বিপন্ন হবে ধুয়া তুলে, তাদের জন্য একটা আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের মহড়া হিসাবে ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগষ্ট ঢাকা শহরে যে প্রলয় কান্ড ঘটিয়েছে; তার বিস্তৃত বিবরন আমি আমার লিখিত বইগুলোতে উল্লেখ করেছি। ঢাকা শহরে ১৯৪৬ সালের ১৬ই অগাষ্টের নিহত হিন্দুদের মৃতদেহগুলি সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে ট্রাক বোঝাই করে আমাদের পাড়ায় পাঠিয়ে দেয়া হত।তাতে ছিল উলঙ্গ মহিলা এবং মস্তকহীন শিশুদের মৃতদেহ বাধ্য হয়ে ট্রাক থেকে হাত পা গুলি নামিয়ে গনসৎকার করাতাম।

ট্রাকের পাটাতনে ত্রিপল পেতে দেয়া হত যাতে রাস্তায় ঐরক্ত না পড়ে। আমাদের পা রক্তে ডুবে যেত। কলকাতা শহরের হত্যালীলায় প্রথম তিন দিনে ২০,০০০ লোক নিহত হল, এত লাশ গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়া হয়ে ছিল যে নৌকা চলাচল দুঃস্বাধ্য হয়ে গিয়েছিল।মানুষের মাংসে শকুন কুকুরেরও অরুচী ধরেছিল।এরপর যখন হিন্দু ও শিখরা রুখে দাঁড়াল তখন মুসলিম লীগ সরকার প্রমাদ গুনলো।এরপর মুসলীম লীগ বেছে বেছে বাংলার সবচেয়ে হিন্দু সংখ্যালঘু জেলা নোয়াখালী তাদের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গিনিপিগ হিসাবে ১০ই অক্টোবর ১৯৪৬ সেখানে হিন্দুনিধন আরম্ভ হলো। হত্যা লুঠপাঠ অগ্নিসংযোগ, নারীধর্ষন, বলপূর্বক বিবাহ, অপহরন, মহিলাদের মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে সিঁথির সিঁদুর মুছে দেয়া, গরু জবাই করা রক্তদিয়ে মূর্তীগুলিকে স্নানকরানো এবং তারপর সেগুলিকে টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে ফেলার মধ্যে দিয়ে পাকিস্তান আদায়ের জন্য হিন্দুদের মনে ভীতি সঞ্চার করার প্রয়াস হল। এই বর্বরোচিত ঘটনা প্রথম দশদিন লীগ সরকার গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছিল কারন সমস্ত টেলিগ্রাফের তার কেটে, রাস্তা কেটে নোয়াখালীকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছিল। এরপর অবস্থা একটুশান্ত হলে নোয়াখালীতে স্বয়ং সেবকরা যেতে আরম্ভ করলো। গান্ধীজী এই হত্যালীলা আরম্ভ হওয়ার ২৫দিন পরে গিয়ে গ্রাম পরিক্রমা আরম্ভ করলেন, ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে কিছু স্বেচ্ছা সেবক নোয়াখালী রওনা হলো। আমিও যাবো বলে মনস্থির করলাম ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী জ্ঞানাত্মানন্দের একজন অত্যন্ত প্রিয়পাত্র এবং মঠের একজন কর্মী হিসাবে যাত্রার আগের দিন বিকালে গিয়ে মহারাজের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন “তুই যখন যাচ্ছিস দেখত ঐ প্যাকেটে কিছু বইপত্র এসেছে মনে হয় নোয়াখালী সমন্ধে খবর আছে। ”তখন মঠের রান্নাঘর থেকে সবজি কাটার বঁটি এনে প্যাকেটের দড়ি কেটে এক কোনা থেকে ৭/৮ টা বই নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। রাত্রে বইগুলো চোখ বোলানোর সময় হয়নি। পরেরদিন ঢাকা থেকে রওনা হয়ে তারপর পরদিন সকালে চৌমুহানী স্টেশন থেকে প্রায় ৪মাইল পশ্চিমে আমাদের গ্রামের বাড়ি কালিকাপুরে পৌঁছালাম,ইতিমধ্যে অনেক স্বনামধন্য নেতানেত্রী চৌমুহানীতে ওখানকার ধনী ব্যবসায়ীদের আতিথ্য গ্রহন করে তারপর গ্রামগুলির দিকে রওনা হলেন।আর যারা অত্যন্ত সাধারন স্বেচ্ছাসেবক প্রানের টানে সেখানে গিয়েছেন তারাসব আমাদের বাড়িতে উঠেছে।আমিও তাদের সাথে উদ্ধার কাজে রওনা হলাম,তাদের অনেকের নাম আমার আর এখন মনে নেই তবে শ্রী অমর সরকার,রমেন চক্রবর্তী,যোগেশ চৌধুরীর নাম আমার বিশেষ করে মনে আছে।তারা কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টি করতো।

গ্রামগুলিতে গিয়ে দেখি হিন্দুরা সব মুসলমান হয়ে বসে আছে। পরনে লুঙ্গী,মাথায় সাদা টুপির ওপর ভারতের মানচিত্র তারমধ্যে যে অংশগুলি তারা পাকিস্তান বলে দাবী করছে তা সবুজ রংয়ে ছাপা,লেখা পাকিস্তান জিন্দাবাদ। মহিলাদের হাতে শাখা কপালে সিঁদুর নেই,চোখগুলি জবাফুলের মত লাল। মন্দিরগুলোর কোন চিহ্ন নেই। আমরা তাদেরকে বললাম আপনারা চলুন উদ্ধার করে অন্যত্র নিয়ে যাবো। তারা প্রশ্ন করলো …”বাবু আমরা কলমা পড়ে মুসলমান হয়েছি নামাজ পড়েছি। আমাদের মুখে গোমাংস দিয়েছে। বাড়ির মেয়েদের অপহরন করা হয়েছে। হিন্দুরা কি আমাদের আবার সমাজে নেবে? আমাদের হাতে কি জল খাবে”? আমরা বললাম আমাদের ধর্মগুরুরা এই নির্দেশ দিয়েছেন আপনারা বিনা দ্বিধায় স্বধর্মে ফিরতে পারবেন। তারা আমাদের মুখের কথা বিশ্বাস করলোনা। তখন ছাপার অক্ষরের বই পড়তে তারা বিশ্বাস করলো এবং দলে দলে বাড়ী ছেড়ে আমাদের সাথে বেরিয়ে এলো। এতে মুসলমানরা আপত্তি করলোনা। কারন হিন্দুরা চলে গেলে স্থাবর অস্থাবর জমিজমা পুকুর তাদের দখলে আসবে। ইতিমধ্যে এইমধ্যে এই বই এর সংবাদ দাবানলের মত স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো,প্রথম দিনের বইটা তারা টানাটানি করে ছিঁড়ে যে যা পেরেছে এক এক পৃষ্ঠা একেক জন নিয়ে গেছে। এই বইয়ের পৃষ্ঠা দেখিয়ে ধর্মান্তরিত হিন্দুদের বের করে আনতে আরম্ভ করলো। এই বইয়ের সংবাদ কোনক্রমে কংগ্রেস সভাপতি আচার্য কৃপালনীর স্ত্রী সুচেতা কৃপালনীর নিকটে গেল। রাত্রে বাড়ি ফিরে এলাম,পরদিন সকালে ৩/৪কপি সঙ্গে নিয়ে গেলাম এবং সুচেতা কৃপালনীর সাথে দেখা হলো।বইটায় চোখ বুলিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।বললেন তুই করেছিসটা কি রবি?এরপর তার সাথে আমার অনেকবার দেখা হয় আমি তাকে পিসিমা বলে ডাকতাম।আমার এক পিসিমা ঊষারাণী গুহরায় সুচেতা কৃপালনীর নারী উদ্ধারের স্বেচ্ছাসেবিকার কাজ করতেন।ঐসব কাজে আমার অনেক নেতানেত্রীর সঙ্গে দেখা হয় তার মধ্যে শ্রীমতী লীলা রায় এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।এখানে উল্লেখযোগ্য যে নোয়াখালি দাঙ্গার নায়ক গোলাম সারোয়ার ফতোয়া দিলেন সুচেতা কৃপালনীকে যে ধর্ষন করতে পারবে তাকে গাজী উপাধীতে ভূষিত করা হবে এবং বহুত টাকা ইনাম দেয়া হবে। তাই নিজের সন্মান রক্ষা কল্পে সবসময় পটাশিয়াম সাইনাইডের ক্যাপসুল গলায় ঝুলিয়ে রাখতেন। আমার সহৃদয় পাঠকপাঠিকারা একবার চিন্তা করুন। যেখানে কংগ্রেস সভাপতির স্ত্রীর এই অবস্থা সেখানে সাধারন হিন্দুনারীদের কি অবস্থা হয়েছিল!পররবর্তীকালে ১৯৫০ সালে ঢাকার তথা সমগ্র পূর্বপাকিস্তানের হিন্দু নিধনের শিকার হয়ে একবস্ত্রে যখন কলকাতা এলাম তারপর পিসিমা (ঊষারানীগুহরায়) আমাকে বলেন চল লক্ষ্ণৌ থেকে বেড়িয়ে আসি সুচেতাদির বাড়িতে উঠব।তোকে দেখলে খুব খুশি হবে।আমি বললাম তিনি এখন একটা প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তিনি কি আমাদের কে পাত্তা দেবেন?পিসিমা বললেন তুই চলনা।আমিতো বিনা নোটিশে বারকয়েক তার বাড়ী গিয়ে থেকে এসেছি।তবে খুবই ব্যস্ত রাত্রে ছাড়া কথা বলার সময় নাই।তোর সমন্ধে দু-তিনবার জিজ্ঞাসা করেছেন।আমার মনে হয় বইটার অপরিসীম গুরুত্ব অনুভব করে আমার হাত থেকে পেয়ে তিনি আমাকে মনে রেখেছেন।

১৯৫০সালে ঢাকা থেকে এসে একদিন বেলুড়মঠে গেলাম স্বামী মাধবানন্দের সঙ্গে দেখা করতে।৩/৪জন সাধুকে জিজ্ঞাসা করার পর ঐ যে স্বামীজী মন্দিরের নিকট পায়চারী করছেন তিনি।আমি সামনে গিয়ে হাঁটুগেড়ে আমার দুই হাত তার দুইপায়ে স্থাপন করে আমার মস্তক তাঁর শ্রীচরনযুগলের উপর রেখে চোখের জলে পা দুটি সিক্ত করে দিয়ে ২/৩ মিনিট পর উঠে দাঁড়ানোর পর তিনি দুহাত আমার মাথার উপর স্থাপন করে দাঁড়িয়ে রইলেন।২/৩ মিনিট আমি বাকরুদ্ধ হয়ে রইলাম।তারপর বললাম মহারাজ আমি ঢাকা থেকে এসেছি।স্বামী জ্ঞানত্মানন্দ,স্বামী সম্ভুদ্ধানন্দ, স্বামী ত্যাগীস্বরানন্দ, স্বামীসত্যকামানন্দ প্রভৃতি মহারাজদের স্নেহধন্য এবং ঢাকা মিশনের একজন স্বেচ্ছাসেবক। যে ব্যাপারে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি সেটা হল নোয়াখালীতে হিন্দু নিধনের পর “পূর্ববঙ্গ ও হিন্দুসমাজ” নামে বইটা যদি আপনারা না ছাপাতেন তবে অধিকাংশ হিন্দুরাই ধর্মে ফিরে আসতো পারতো না,তাদের মুসলমান হয়েই ওখানে থেকে যেতে হত।

স্বামীজীর থেকে জানা গেল এই কাজটা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মস্তিষ্কপ্রসূত।কি অক্লান্ত পরিশ্রম তাঁদের করতে হয়েছে,অতজন ধর্মগুরু এবং সমাজপতিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের লিখিত বিবৃতি এনে তা ছাপিয়ে সময়মত বিতরন করা এখন আমরা কল্পনাও করতে পারিনা।এখনকার মত তখন ফোন, ইন্টারনেট, মোবাইল ইত্যাদি ছিলনা। আমি আজও অবাক হয়ে পড়ি এই দুই দেশপ্রেমিক ধর্মপ্রান ব্যক্তির দূরদৃষ্টি দেখে।আর যেসব অকৃতজ্ঞ বাঙ্গালী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সাম্প্রদায়িক বলে গালি না দিয়ে জলগ্রহন করেননা তাদের মুখে থুতু ফেলতেও আমার ঘৃণা বোধ হয়।

( ইন্টারভিউটি শ্রী রবীন্দ্র নাথ দত্ত মহাশয়ের নিকট হইতে সংগৃহীত …. )

কৃতজ্ঞতাঃ শ্রী Rabindranath Dutta ….