রাধা-কৃষ্ণ (ধর্ম, সাহিত্য ও দর্শন) : বিভ্রান্তি এবং সত্য।।

রাধা-কৃষ্ণ (ধর্ম, সাহিত্য ও দর্শন) : বিভ্রান্তি এবং সত্য
___________________________
শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে আমাদের হিন্দু জাতি ও এতদ্বঅঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে যত গল্প প্রচলিত আছে সেরকম কোনো চরিত্র নিয়ে তেমন গালগল্প প্রচলিত নেই। অন্য ভিন্ন চরিত্র ভগবান রামচন্দ্রকে নিয়েও দেশে বিদেশে বহু ভিন্ন ভিন্ন গল্প প্রচলিত আছে। কিন্তু কৃষ্ণ চরিত্র যেমন বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে তেমন রামচন্দ্র নিয়ে ছাড়ায়নি। তার কারণ রয়েছে বহুবিধ। হিন্দু দর্শন অনুযায়ী যেসকল মানুষ/দল/গোষ্ঠী ঈশ্বরকে বিষ্ণুরূপে উপাসনা করতেন তাদের বৈষ্ণব বলা হতো। ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপের অবতার পৃথিবীতে এসেছেন বহুবার। এমনই বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় শ্রীকৃষ্ণের জীবন, আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিক শক্তি হিন্দু সমাজে এমন প্রভাব ফেলেছে যে কৃষ্ণ ছাপিয়ে উঠেছেন স্বয়ং বিষ্ণু থেকেও। ফলে বর্তমানে বৈষ্ণব অর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃষ্ণের উপাসক। বৈষ্ণব তত্ত্ব মতে ঈশ্বর সাধনা রসতাত্ত্বিকভাবে পাঁচ রকম। যথা- শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। উক্ত পাঁচ পন্থার মধ্যে মধুর রস ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই রস সাধনার মূলকথা ঈশ্বর এক পরমপুরুষ আর সৃষ্টির সকল কিছুই নারী। সকল নারী প্রবল ভাবাবেগ ও ভালোবাসার টানে ধাবিত হচ্ছে পুরুষের দিকে। আর এই প্রকৃতিরূপ জীবাত্মারূপী নারীর প্রতীক হিসেবে বৈষ্ণব সাধকগণ রাধা চরিত্রটি কল্পনা করেছেন অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণকে সেই পরমপুরুষ বলেছেন। একজন পরমাত্মা (কৃষ্ণ) অন্যজন জীবাত্মা (রাধা)। সৃষ্টি ও স্রষ্টার মিলনই হলো এই তত্ত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়। নারী ও পুরুষের ভালোবাসার তীব্র ভাবাবেগ দিয়ে বৈষ্ণব সাধকগণ স্রষ্টার প্রতি অপরিসীম আকুতি প্রকাশ করেছেন। এই সাধনায় মধ্যযুগের কবি সাহিত্যিক তৈরি করেছেন শ্রেষ্ঠ সব সাধন গান ও কবিতা, যা বৈষ্ণব পদাবলি নামে পরিচিত। স্বভাবতই এতে নারী-পুরুষের মিলনকে রূপকার্থে জীবাত্মা ও পরামাত্মার মিলনকেই বোঝানো হয়েছে। এমনকি ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসায় কোনো লজ্জা ও পিছুটান যাতে না থাকা তা বোঝাতে প্রেমিক রাধাকে ব্যভিচারিণীরূপেও কবিগণ দেখিয়েছেন। বৈষ্ণব পদাবলির রাধা সমাজ চক্ষুকে উপেক্ষা করে কৃষ্ণের সাথে মিলিত হয়েছে। অর্থাৎ স্রষ্টার প্রতি অনন্য ভক্তি সম্পন্ন মানুষ সব মায়া, মোহ ও সমাজ বন্ধনকে পাশ কাটিয়ে স্রষ্টার প্রেমে মাতোয়ারা হয়েছে। কিন্তু এই উন্নত ও অধিক গভীর তত্ত্ব ধীরে ধীরে রক্ত-মাংসের চরিত্র রাধাতে রূপ নিয়েছে। পাশাপাশি বহু ভণ্ড সাধকদের হাতে পড়ে রাধা তত্ত্বটি হয়েছে কলঙ্কিত। এমনকি বৈষ্ণব পদাবলির কবি- চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, বিদ্যাপতি সকলে রাধার যে ছবিটি এঁকেছেন তা মূলত তাদের চারিপাশে ঘটে যাওয়া নারীর উন্মত্ত প্রেমিক রূপ। কখনো কখনো নিজের প্রেমিক রূপই এখানে ফুটে উঠেছে। একারণে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপযুক্ত প্রশ্নটি বৈষ্ণব কবিদের প্রতি করেছিলেন তাঁর ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের ‘বৈষ্ণব কবিতা’য়-

    সত্য করে কহ মোরে হে বৈষ্ণব কবি,
    কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি,
    কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান
    বিরহ-তাপিত। হেরি কাহার নয়ান,
    রাধিকার অশ্রু-আঁখি পড়েছিল মনে?
    বিজন বসন্তরাতে মিলনশয়নে
    কে তোমারে বেঁধেছিল দুটি বাহুডোরে,
    আপনার হৃদয়ের অগাধ সাগরে
    রেখেছিল মগ্ন করি! এত প্রেমকথা–
    রাধিকার চিত্তদীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতা
    চুরি করি লইয়াছ কার মুখ, কার
    আঁখি হতে! আজ তার নাহি অধিকার
    সে সংগীতে! তারি নারীহৃদয়-সঞ্চিত
    তার ভাষা হতে তারে করিবে বঞ্চিত
    চিরদিন!
কৃষ্ণ চরিত্র নিয়ে গালগল্প তৈরিতে যে দুটি গ্রন্থ অধিক ভূমিকা রেখেছে তা হলো- ১। ব্রহ্মবৈবর্ত্য পুরাণ ও ২। বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন)। বঙ্কিমচন্দ্রসহ অনেক সমালোচকওই ব্রহ্মবৈবর্ত্য পুরাণকে অর্বাচীন, আধুনিক ও জাল পুরাণ বলেছেন। আর এই পুরাণের বহু বিভ্রান্তিকর তথ্য বিদ্যমান। যেমন এই পুরাণ মতে রাধা ও কৃষ্ণ দুজন বিবাহিত দম্পতি। আরও অবাক করার মতো কথা হলো স্বয়ং ব্রহ্মা তাদের বিয়ে দিয়েছেন। ব্রহ্মবৈবর্ত্য পুরাণ মতে রাধার উৎপত্তি কৃষ্ণের বাহু থেকে, ভাগবত মতে রাধার মাতাপিতা যথাক্রমে বৃষভানু ও কমলাবতী আর বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য মতে পদ্মা ও সাগর। এইসব বিভ্রান্তিকর তথ্য চরিত্রটির বাস্তব অস্তিত নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করে। এখন অনেকেই প্রশ্ন করেন ও প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন বেচারা বড়ু চণ্ডীদাসের প্রতি তিনি রাধা চরিত্র দিয়ে কৃষ্ণকে কলঙ্কিত করেছেন। কিন্তু তারও বহু আগে থেকে রাধা চরিত্র সাহিত্যে পাকা স্থান করে নিয়েছিলো। সাতবাহন নরপতি হাল কর্তৃক ‘গাথাসপ্তশতী’ সঙ্কলনে রাধার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় । ধারণা করা হয় এই গ্রন্থ খ্রিস্টিয় ১ম শতক থেকে ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যে লেখা হয়েছে। ভারতের আরও বহু সাহিত্যে রাধা চরিত্রের উল্লেখ আছে। তাই এই রাধা চরিত্র যতখানি না ধর্মের সাথে জড়িত তার থেকেও বেশি সাহিত্যের সাথে জড়িয়ে আছে। এখন প্রশ্ন হলো কেন রাধাকে ভগবান কৃষ্ণের সাথে জুড়ে দেয়া হলো? কারণ লোক মুখে প্রচলিত রাধার ব্যাকুল প্রেম কাহিনি বৈষ্ণব মধুর রসকে কেন্দ্র করে জীবাত্মা-পরামাত্মার সম্পর্ক বুঝানো। দ্বিতীয়ত মধ্যযুগের সাহিত্য ছিলো ধর্ম নির্ভর। সাহিত্যের মধ্যে ধর্মের আচ না থাকলে তা সাহিত্য দরবারে অচল। তাই এর মধ্যে ধর্মীয় আবহ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে শাক্ত-শৈব দ্বন্দ্ব আমাদের কাছে অবিদিত নয়। বড়ু চণ্ডীদাস নামে চণ্ডীর দাস আর তিনি যদি বর্ণনা করেন কৃষ্ণ চরিত্র তবে তিনি মধ্যযুগের পারস্পারিক বিদ্বেষকে জিইয়ে রাখতে কৃষ্ণ চরিত্রকে বিকৃত করে উপস্থাপন করতেই পারেন। শাক্ত ও বৈষ্ণবের এই পারস্পারিক বিদ্বেষ আজও দেখা যায়।
বাংলা সাহিত্যের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হলো চণ্ডীদাস সমস্যা। বলে রাখা ভালো- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ এই বহুল প্রচলিত বাক্যটি বড়ু চণ্ডীদাসের নয় বরং চণ্ডীদাসের। এই দুজন এক ব্যক্তি নন। বাংলা সাহিত্যে মোটামুটি কয়েকজন চণ্ডীদাসের নাম পাওয়া যায় – বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস ও চণ্ডীদাস। যখন শ্রীচৈতন্য চণ্ডীদাসের পদ চর্চা করতেন আর ১৯১৬ সালে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্ববল্লভ যখন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ আবিষ্কার করলেন তখন গবেষকদের টনক নড়লো। চৈতন্যদেব এত বড়ো সাধক তিনি কি করে অশ্লীল ‌’শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য চর্চা করতে পারেন! তখন গবেষণায় দেখা গেলো চণ্ডীদাস যিনি পদাবলি সাহিত্য লিখেছেন তিনি বড়ু চণ্ডীদাস নন। বসন্তরঞ্জন যে গ্রন্থটি আবিষ্কার করেছিলেন তার সামনের ও পেছনের অনেক পাতা ছেড়া ছিলো তাই তিনি গ্রন্থের নাম খুজে পা্ননি। বইটি কৃষ্ণ ও রাধা নাম দেখে তিনি অনুমান নির্ভর হয়ে একে ধর্মগ্রন্থ ভেবে এমন নাম দিয়েছিলেন। মোদ্দা কথা হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের জীবনের তিনটি প্রামাণ্য গ্রন্থ- ভাগবত (বাল্যলীলা), মহাভারত (যৌবনকালের ইতিহাস), হরিবংশ (বৃদ্ধকালের ইতিহাস) এই তিন গ্রন্থের কোথাও রাধা নেই। রাধা একটি দার্শনিক তত্ত্ব। তাত্ত্বিক দিক থেকে তার গুরুত্ব অসাধারণ কিন্তু রাধার মানবীয় ইতিহাস যা আছে তা সাহিত্যে, রক্ত মাংসের মানুষে নয়। সাহিত্যের দৃষ্টিতে সেটির গুরুত্বও কিন্তু কম নয় যদিও সে আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।
এখন প্রশ্ন হলো তাহলে রাধা কি একেবারেই গুরুত্বহীন কিছু? মোটেই নয়। কেননা ‘রাধা’ তত্ত্বের যে প্রয়োজনীয়তা তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ব্যক্তিরূপের কোনো সত্যতা নেই। ঈশ্বর সম্পর্কে, সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে পারস্পারিক মিলন সম্পর্কে রাধা তত্ত্ব খুবই উচ্চ মার্গীয় দর্শনকে উপস্থাপন করে। আর একারণে বৈষ্ণব পদাবলির কবিতা আমাদের গভীর মগ্নতায় আচ্ছন্ন করে, ঈশ্বর প্রেমের এক স্বর্গীয় বার্তা নিয়ে আসে।
রূপলাগি আখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।
পরাণ পীরিতি লাগি স্খির নাহি বান্দে।। (জ্ঞানদাস)
তত্ত্ব, দর্শন ও সাহিত্য থেকে আমরা সাধনার রসটুকু নেবো আর শ্রীকৃষ্ণের জীবনের সঠিক ইতিহাস ঘেটে তাঁর সমৃদ্ধ জীবনের শিক্ষাকে গ্রহণ করবো। দুই মিলে আমাদের কৃষ্ণ অনুসরণ সার্থক হবে। রাধা প্রেমী বাঁশীকৃষ্ণকে তো আমরা বহু চিনেছি পাশাপাশি চিনতে হবে সুদর্শনধারী কৃষ্ণকে- অন্যায়, অবিচার ও অসুর ধ্বংসকারী কৃষ্ণকে; ধর্ম সমন্বয়ক কৃষ্ণকে, চিনতে হবে রাজনীতিবিদ কৃষ্ণকে, ধারণ করতে হবে পরমপুরুষ যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সত্য জীবনাদর্শনকে। শেষ করি কবি কাজী নজরুলের গানের সত্যভাষণ দিয়ে-
হে পার্থ সারথী বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ
চিত্তের অবসাদ দূর কর কর দূর
ভয়-ভীত জনে করও হে নিশঙ্ক।

জড়তা ও দৈন্য হানো হানো
গীতারও মন্ত্রে জীবনও দানও
ভোলাও ভোলাও মৃত্যু আতঙ্ক।

মৃত্যু জীবনের শেষ নহে নহে শোনাও শোনাও
অনন্তকাল ধরি অনন্ত জীবনও প্রবাহ বহে

দুর্মদ দুরন্ত যৌবন চঞ্চল
ছাড়িয়া আসুক মা’র স্নেহ অঞ্চল
বীর সন্তানদল
করুক সুশোভিত মাতৃ-অঙ্ক।।
।।সবার প্রতি রইলো জন্মাষ্টমীর শুভেচ্ছা।।