মানবতাবাদী সেকুলাঙ্গা।

মানবতাবাদী সেকুলাঙ্গার :
——————————–
একদম চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে, যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগের প্ল্যানিং চলছে, কমিউনিস্ট পার্টি মুসলিম লিগের দেশভাগের দাবিকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল। এইসময়ই কমিউনিস্ট পার্টির গঙ্গাধর অধিকারী তখন ‘অধিকারী থিসিস’ বাজারে ছাড়ে, : “ভারতীয় কোনাে জাতি নয়, ভারত আঠারােটি জাতিগােষ্ঠীর সমষ্টি।”

দেশভাগ প্রসঙ্গে কমিউনিস্টদের স্লোগান ছিল ‘পাকিস্তান মানতে হবে, তবেই ভারত স্বাধীন হবে।’ এর উদ্দেশ্য কি ? উদ্দেশ্য ভেরি সিম্পল। বর্তমানের পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নামে ভূখণ্ডে সেই সময় মুসলমানরা হিন্দুদের তুলনায় সবদিক থেকেই পিছিয়ে ছিল, একমাত্র জনসখ্যা বাদে। পাকিস্তান সমর্থন করলে সেই পশ্চাদপদ মুসলমানদের সমর্থন পাওয়া যাবে এবং সেই সমর্থনের সাহায্যে রাজত্ব কায়েম করা যাবে। উপমহাদেশের কম্যুনিস্টরা যেটা তখন বুঝতে পারেনি, সেটা হলো ইসলাম মার্কসবাদের তােয়াক্কা করে না ! ফল বুমেরাং। যতজন পূর্ববঙ্গীয় হিন্দু কমিউনিস্ট ছিলেন (যেমন প্রমােদ দাশগুপ্ত, প্রশান্ত শুর ইত্যাদি) সবাই পূর্ব-পাকিস্তানি মুসলমানদের অত্যাচারে ঘরবাড়ি ফেলে এই পশ্চিমবঙ্গে এসে জুটলো । লম্পট নেহেরু ও পুনর্বাসন মন্ত্রী মেহেরাদ খান্নার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তর নানাভাবে পূর্ববঙ্গাগত হিন্দু উদ্বাস্তুদের জঘন্য বঞ্চনা করেছিল, যার প্রতিবাদে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। এই সেকুলাঙ্গার কম্যুনিস্টরা তখন এই বঞ্চনার গান উদ্বাস্তুদের সামনে গেয়েছিল প্রমোদ দাসগুপ্তের মত ধূর্ত নেতার নেতৃত্বে আর তাদের সেন্টিমেন্ট জিতেছিল। পশ্চিমবঙ্গে রাজত্ব করা ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের গােড়াপত্তন হয় সেই সময়ের উদ্বাস্তু ক্যাম্প ও কলােনিগুলিতে। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ুর সঙ্গে পূর্ববঙ্গের জলবায়ুর প্রচুর মিল থাকায়, চেষ্টা করেছিলেন পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পুনর্বাসন করতে, কিন্তু বামপন্থীরা বাদ সাধল এবং বিরাট বিক্ষোভ চালু করে দিল এই দাবি নিয়ে, যে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের পশ্চিমবঙ্গেই পুনর্বাসন দিতে হবে, আন্দামানে পুনর্বাসন মাথায় উঠলো !
উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গে নানা ক্যাম্পে অত্যন্ত দীনভাবে, ক্যাশ ডােল’ নামক সরকারি ভিক্ষার ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করতে বাধ্য হলেন। এই সেকুলাঙ্গার কমিউনিস্টদের দল সুকৌশলে অস্বীকার করে যে, ইন্দোনেশিয়ায়, মােল্লাদের নেতৃত্বে এক বিদ্রোহে ইন্দোনেশিয়ার তাবৎ কমিউনিস্টকে রাতারাতি হত্যা করা হয়েছিল; আফগানিস্তানে, কমিউনিস্ট শাসক নাজিবুল্লাকে তিনদিন প্রকাশ্যে ফাসিতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, আর তাই তারা পূর্ববঙ্গীয় সংখ্যালঘু হিন্দুর ওপর সংখ্যাগুরু মুসলমানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দও করেনি ! জ্যোতি বসুর সরকার, পুলিশ এবং পার্টির ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী তাবৎ উদ্বাস্তুকে মরিচঝাঁপি থেকে উৎখাত করেছিল। উদ্বাস্তুদের কিছু গুলি খেয়ে মরেছিল, কিছু জলে পড়ে কুমিরের পেটে গিয়েছিল, আর বাকিরা সর্বসান্ত হয়ে আবার ট্রেন বােঝাই করে দন্ডাকারণ্যে ফেরত গিয়েছিল। মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুরা কিন্তু কিছু চায়নি, না ঘরবাড়ি, না ক্যাশ ডােল, শুধু পশ্চিমবঙ্গে একটু থাকবার জায়গা চেয়েছিল, তাও পায়নি ! কাদের সক্রিয়তায় ? এই সেকুলাঙ্গারের দলের সক্রিয়তায়। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে যখন পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দু বিতাড়ণ হয়েছিল তখন কিন্তু মুসলমান জমিদার ও মুসলমান চাষি দুদল মিলে হিন্দু জমিদার ও হিন্দু চাষিকে ঘরছাড়া করেছিল। এখনও যে বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের ওপর অত্যাচার হয় তাতে সমতল থেকে আসা গরিব মুসলমান চাষি পর্বতের গরিব বৌদ্ধ চাকমা চাষিকে উৎখাত করে। এই সেকুলাঙ্গার, মাকুর দলের মত যদি বলা হয় যে ইংরাজ, বা বাংলাদেশের মুসলিম জমিদার শ্রেণী গরিব মুসলিমকে প্ররােচিত করেছে গরিব হিন্দুকে হত্যা এবং উৎখাত করার জন্য, তা হলে জিজ্ঞাসা করতে হয়, সেইসব গরিব মুসলিমের ভুল এত বছরেও কেন ভাঙল না ?
বলি হে সেকুলাঙ্গার, মাকুর দল চীনের মুক্তিযুদ্ধ, মহান রাশিয়ান বিপ্লব নিয়ে না কচলিয়ে, উপমহাদেশের শিকড় উপড়ানো মানুষগুলোর জন্য কোনোদিন কি একটুও সহানুভূতি আপনাদের জাগেনি ? সংখ্যালঘু তোষণ করে ক্ষমতা দখলের দিন শেষ কিন্তু………….