ধর্ষিতার আবার বয়স ! ছি ! /দেবাশিস লাহা

ধর্ষিতার আবার বয়স ! ছি ! /দেবাশিস লাহা 

ভালবাসাই হোক অথবা বিশ্বাসযোগ্যতা, অনেক পাঠক/ বন্ধু/ শুভাকাঙ্ক্ষী বিভিন্ন বিষয়ের উপর আমার মতামত জানতে চান।আবদার এবং অনুরোধে ইনবক্স ভরে যায়। বিশেষ করা সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের বিভিন্ন দিক নিয়েই পোষ্ট লেখার আবেদন থাকে। কিন্তু সবার অনুরোধ রাখতে পারিনা। তাই মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি। এই মুহূর্তে আমি আমার প্রথম উপন্যাসটি নিয়ে ব্যস্ত আছি।  লেখার পাশাপাশি পড়াশোনা তো আছেই। যাক আজ একটি বিশেষ বিষয় যা এরররই মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় করে ফেলছে, হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, ধর্ষণ সংক্রান্ত নতুন অর্ডিন্যান্সটি নিয়ে কিছু আলোচনা করতে চাইছি। এটি অত্যন্ত জরুরী কারণ অজ্ঞতার [অসাধু উদ্দেশ্যের কথাটি নাই বা বললাম] কারণে এ নিয়ে বিভিন্ন ভুল বার্তা ছড়াচ্ছে, যা নাগরিক চেতনায় বিভ্রান্তি আনতে বাধ্য। ধর্ষিতার বয়স বারো বছর বা তার কম হলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে—এই ধারাটি নিয়েই সবচেয়ে বেশি খিল্লি ছড়ানো হচ্ছে। এই যেমন ধরুন বারো বছর এক মাস হলে কি মহামানবী হয়ে যাবে ? সেক্ষেত্রে কি ধর্ষকের শাস্তি হবে না ?অথবা বারো বছরের বেশি হলে ধর্ষণটা আরামদায়ক হবে ? কেউ কেউ বলছেন যে বয়সেই হোক ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই হওয়া উচিত  ইত্যাদি ইত্যাদি !এইসব পোষ্ট তথা পর্যবেক্ষণ আমাকে মোটেই বিস্মিত করেনি। কারণ আমি খুব ভাল করেই জানি ১৪০ কোটির এই দেশটির অলি গলি বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, কবি, খেলোয়াড় এবং অবশ্যই আইনঙ্গ দিয়ে টইটুম্বুর আর তাই মাঝেমধ্যেই উপচে পড়ার অবস্থা হয়। ফলশ্রুতি হিসেবে এই সব পোষ্ট, মতামত এবং পর্যবেক্ষণ। যাক আসুন এবার এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক, নতুন আইনটিতে কি বলা হয়েছে। 
ধর্ষণ একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ [ ধর্ষিতা যে বয়সেরই হোক] এই পর্যবেক্ষণটির একচুলও নড়চড় হয়নি। কেবল কোয়ান্টাম অফ পানিশমেন্ট অর্থাৎ শাস্তির মেয়াদ এবং তীব্রতা ক্ষেত্র বিশেষে বাড়ানো হয়েছে।
১] বারো বছর পর্যন্ত শিশুদের ক্ষেত্রে ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এই মর্মে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
২] ধর্ষিতা নারীদের ক্ষেত্রে [ ১৬ বছরের উর্ধ্বে] ধর্ষকের শাস্তির মেয়াদ সশ্রম কারাদণ্ডের মেয়াদ সাত বছর থেকে বাড়িয়ে দশ বছর করা হয়েছে,  আজীবন কারাবাসও হতে পারে। 
৩] ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত ধর্ষিতার ক্ষেত্রে শাস্তির মেয়াদ আগে দশ বছর ছিল, তাকে কুড়ি বছর অবধি বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রেও আজীবন কারাবাস হতে পারে।
৪] শুধু তাই নয়, ১৬ বছরের নিচে [ধর্ষিতার বয়স] হলে আগাম জামিন অর্থাৎ ancipatory bail পাওয়া যাবেনা।
৫] দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি–

এই গেল আইনটির সারমর্ম। মৃত্যুদণ্ড কতটা অমানবিক অথবা সেটি আরও ক্ষতি করবে কিনা, সেই আলোচনা এখানে করছি না। উপরিউল্লিখিত প্রশ্নগুলির বিশেষ করে ধর্ষিতার বয়সের উল্লেখ কতটা অবৈজ্ঞানিক এবং হাস্যকর তার উত্তর খোঁজাই এ পোষ্টের উদ্দেশ্য। প্রথমেই বলে রাখা ভাল আমি আইনজ্ঞ নই। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞও নই। যেহেতু কিঞ্চিৎ লেখালেখি করি, একটু আধটু পড়াশোনা করতেই হয়। এই যেমন ধরুন আমার বর্তমান উপন্যাসটির পটভূমি ভারত, ফ্রান্স এবং নরওয়ে মূলত এই তিনটি দেশ। সেখানে অপরাধীর চরিত্র যেমন আছে,  আইনজ্ঞের চরিত্রও আছে। তাই নরওয়ে তথা ইউরোপের আইন ব্যবস্থা নিয়ে কিঞ্চিৎ পড়াশোনা করতেই হচ্ছে। নইলে চরিত্রগুলিকে ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। তাই আসুন দেখে নেওয়া যাক পৃথিবীর উন্নত তথা অগ্রসর দেশগুলিতে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন কি বলছে। তার আগে আর একটি বিষয় বুঝে নেওয়া যাক। সেটি কি ? হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন—অভিন্ন দেওয়ানী বিধি বা uniform civil code এর আদলে ধর্ষণের শাস্তির কোনো অভিন্ন পরিমাপ নেই। অর্থাৎ quantum of punishment ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হয়। আসলে সাম্যের জয়গান শুনতে শুনতে আমরা সাম্যের মূল ভিত্তিটিই বিস্মৃত হই। সাম্য সে কর্মসংস্থানই বলুন ট্রেনে বাসে চড়াই বলুন, নারী পুরুষের বিবাহ বিচ্ছেদই বলুন অথবা বিয়ের বয়সই বলুন কোনো গনতন্ত্রেই হুবহু এক রকম হয়না। তার পেছনে অনেক কারণও আছে। কিন্তু এই পোষ্টে বিশদ আলোচনা সম্ভব নয়। এই যেমন ধরুন আইন অনুযায়ী নারী পুরুষের বিবাহের বয়স এক নয়। এমনকি ঘরোয়া বিবাদের ক্ষেত্রেও নারী পুরুষের জন্য সমান আইন নেই। চাকরি বাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। বাস ট্রেনে, গচ্ছিত আমানতে সুদের ক্ষেত্রেও সিনিয়র সিটিজেনরা একটু বেশি সুবিধা পেয়ে থাকেন। তা নিয়ে আপনি নিশ্চয় বৈষম্যের আওয়াজ তোলেন না। অতএব শাস্তির ক্ষেত্রেও যে এমনটা হবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু আছে কি ? তাই ধর্ষণ মানেই প্রাণদণ্ড, বারো বছরের বেশি হলে কি কম কষ্ট হয় ? ইত্যাদি প্রশ্ন অবান্তর। হাস্যকরও বটে। মনে রাখতে হবে পৃথিবীর কোনো আইনব্যবস্থাই সেই অর্থে আদর্শ নয়। কারণ কিছু নির্দিষ্ট প্যারামিটার মেনে নিয়েই তাকে কাজ করতে হয়, যা আপনার আমার অপছন্দ হতেই পারে। এই যেমন ধরুন কোন আইনই আকাশ থেকে পেড়ে আনা হয়না। অনেক ভাবনা চিন্তা তো থাকেই , তার সঙ্গে থাকে বেশ কিছু পূর্বসুরী বা precedent .  এই যেমন ধরুন ভারতের সংবিধানটিই একাধিক দেশের আইন , অনুচ্ছেদ তথা ধারা উপধারার মিশ্রণ। কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,  আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া ইত্যাদি অনেক দেশের সংবিধান থেকে সাহায্য নিয়েই এটিকে রূপ দেওয়া হয়েছে। শুধু কি তাই ব্রিটেনের সংবিধান তথা আইনব্যবস্থা রূপায়নের ক্ষেত্রে যেমন বাইবেলের সাহায্য নেওয়া হয়েছে, তেমনই ভারতের ক্ষেত্রে মনুসংহিতা তথা অন্যান্য হিন্দু শাস্ত্রের অবদান অনস্বীকার্য। আর বর্তমানে দাঁড়িয়ে যে কোনো আইন প্রণয়ন করার সময় এগিয়ে থাকা দেশগুলির শরণাপন্ন হওয়াটাই অলিখিত নিয়ম। ভারতীয় সংবিধান রচনার সময় যা করা হয়েছিল। এবার দেখে নেওয়া যাক আমাদের দেশে যে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন বলবত আছে সেটি কি একেবারে ইউনিক ? অর্থাৎ এর কোনো পূর্বসুরী নেই? পৃথিবীর কোন দেশেই কি এমন আইন নেই ? বর্তমান শাসক দলটি কি মূর্খের মত অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা না করে এমন একটি “হাস্যকর” আইন বানিয়ে ফেলল ? আইন প্রণয়নকারী মানুষগুলির মাথাতেও গোবর আর গোমূত্র ঠাসা ? তবে ধর্ষিতার বয়স অনুযায়ী ধর্ষকের শাস্তির তীব্রতার পরিমাপ করা হচ্ছে কেন ? আগেই বলেছি এর পেছনে সামাজিক, বৈজ্ঞানিক, শারীরতাত্ত্বিক, প্রতিরোধ তথা আত্মরক্ষা করার ক্ষমতা, মানসিক আঘাত তথা ট্রমা, যৌনতা সম্পর্কিত জ্ঞান বা অজ্ঞতা, সম্মতির সম্ভাব্যতা ইত্যাদি অনেক কারণ আছে যা এই ক্ষুদ্র পরিসরে বর্ণনা করা অসম্ভব। তাই আসুন দেখে নেওয়া যাক এগিয়ে থাকা দেশগুলির আইন এব্যাপারে কি বলছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ধর্ষিতার বয়স একটি অন্যতম ফ্যাক্টর। ইউরোপও এর ব্যতিক্রম নয়। আমি কেবল দুটি দেশের উদাহরণ দেব। ১]নরওয়ে [ কারণ এই দেশটি সাধারণত human development index এর শীর্ষে থাকে এবং স্ক্যানডিনেভিয়ার প্রতিনিধিত্ব করে। এই অঞ্চলের বাকি দেশগুলির আইন কানুনও প্রায় একরকম ] ২] রাশিয়া এই দেশটি আগে সমাজতান্ত্রিক দেশ ছিল এবং এদেশের অনেকেই এই নামটির সঙ্গে পরিচিত।
দেখে নেওয়া যাক নরওয়ের মত প্রথম সারির দেশটিতে ধর্ষিতার বয়স গুরুত্ব পাচ্ছে কিনা।
Further, the same section defines aggravated rape as a rape committed

a. by multiple persons in cooperation (gang rape)
b. in a particularly painful or offensive manner
c. by a person previously convicted of rape under § 192 or of sexual activity with a child under the age of 14 (as per § 195 of the penal code)
d. in such a way that the victim either dies or receives grievous bodily harm.
প্রথমেই বলে রাখি এখানে কেবল aggravated rape অর্থাৎ চরম হিংস্র বলে বিবেচিত হতে পারে এমন ধর্ষণের মাপকাঠিই  উল্লেখ করা হয়েছে, এমন অংশটিই নিয়েছি, যেখানে শাস্তি সবচেয়ে বেশি। যদিও তা কখনও মৃত্যুদণ্ড নয়।কারণ এই শাস্তিটি ইউরোপ থেকেই উঠে গেছে।  নরওয়েতে ধর্ষণের ক্ষেত্রে শাস্তি সাধারণত সর্বোচ্চ দশ বছর। কিন্তু ভয়াবহতা এবং নৃশংসতার মানদণ্ড হিসেবে ভিন্ন একটি সেকশন সেখানেও আছে। কি বলা হচ্ছে সেখানে ?  
১] যদি একাধিক ব্যক্তির দ্বারা কোন নারী ধর্ষিতা হন অর্থাৎ গ্যাং রেইপ
২] যে ব্যক্তি  আগেও ধর্ষণে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে এবং ধর্ষিতার বয়স ১৪ বছরের নিচে। [ধারাও উল্লেখ করা আছে]
৩] এমনভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে যে ধর্ষিতার মৃত্যু ঘটেছে অথবা ভয়াবহ কোনো আঘাতের শিকার হয়েছে।
অর্থাৎ ধর্ষিতার বয়স একটি ফ্যাক্টর।

এবার আসি রাশিয়ার ক্ষেত্রে।
Rape or coercive sexual actions without any aggravating circumstances are punishable with 3 to 6 years of imprisonment. If the crime:

was committed repeatedly (against 1 or more than 1 victim)
was committed by a group of criminals
was committed with a threat of murder or grievous harm to the health
was committed with particular cruelty (e.g. the criminal used violence that caused severe physical pain or the crime was committed in presence of relatives of the victim)
caused an STD infection
then it is punishable with 4 to 10 years of imprisonment with possible subsequent restraint of liberty for up to 2 years (i.e. the criminal may not change or leave residence without permission and must register himself at local penal inspectorate 1 to 4 times a month; court may also impose additional restrictions such as the criminal may not leave home in certain hours, visit certain locations, change work without permission).

If the crime

Was committed against a person between 14 and 18 years
Caused the grievous harm to the health, HIV infection or other grievous consequences (e.g. suicide of the victim)
then it is punishable with 8 to 15 years of imprisonment with the subsequent mandatory restraint of liberty for up to 2 years and a possible ban on certain occupations or employment positions for up to 20 years.

If the crime

Caused the death of the victim by inadvertency
Was committed against a person under 14 years
then it is punishable with 12 to 20 years of imprisonment with the subsequent mandatory restraint of liberty for up to 2 years and a possible ban on certain occupations or employment positions for up to 20 years

পুরোটা অনুবাদ করছি না। সহজেই বুঝতে পারছেন ধর্ষিতার বয়স এখানেও একটি উল্লেখযোগ্য মানদণ্ড। এই যেমন ধরুন ধর্ষিতার বয়স যদি ১৪ থেকে ১৮ হয় তবে শাস্তির মেয়াদ ৮ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত। কিন্তু সর্বোচ্চ শাস্তিটি জানতে হলে শেষ অংশটি পড়ুন যেখানে হিংস্রতম ধর্ষণের কথা বলা হয়েছে।
১] যদি ধর্ষিতার মৃত্যু হয়
২] বয়স যদি ১৪ বছরের নিচে হয়।
[বি দ্র এখানে ব্যবহৃত victim শব্দটি লিঙ্গ নিরপেক্ষ । যেহেতু নারীরাই এর প্রধান শিকার তাই ধর্ষিতা শব্দটি অনুবাদে ব্যবহার করেছি]
এক্ষেত্রে শাস্তির মেয়াদ ১২ থেকে ২০ বছর।ধর্ষকের চাকরি বাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু বিধি নিষেধ লাগু হবে। সে বিষয়ে আর গেলাম না।
তবে কি দাঁড়াল ? ধর্ষণের শাস্তির ক্ষেত্রে কেবল ভারত নয়, পৃথিবীর সব দেশেই বয়স একটি মানদণ্ড। কেবল ধর্ষিতার নয়, ধর্ষকেরও[ সেটি এখানে আলোচনা করিনি, দিল্লিতে নির্ভয়া ধর্ষণের হিংস্রতম খলনায়কটি বয়সের কারণেই ছাড়া পেয়ে যায় ] yes, the age matters !  আর এটুকু বোঝার জন্য আইনঙ্গ হওয়ার দরকার নেই।

ভালবাসাই হোক অথবা বিশ্বাসযোগ্যতা, অনেক পাঠক/ বন্ধু/ শুভাকাঙ্ক্ষী বিভিন্ন বিষয়ের উপর আমার মতামত জানতে চান।আবদার এবং অনুরোধে ইনবক্স ভরে যায়। বিশেষ করা সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের বিভিন্ন দিক নিয়েই পোষ্ট লেখার আবেদন থাকে। কিন্তু সবার অনুরোধ রাখতে পারিনা। তাই মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি। এই মুহূর্তে আমি আমার প্রথম উপন্যাসটি নিয়ে ব্যস্ত আছি।  লেখার পাশাপাশি পড়াশোনা তো আছেই। যাক আজ একটি বিশেষ বিষয় যা এরররই মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় করে ফেলছে, হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, ধর্ষণ সংক্রান্ত নতুন অর্ডিন্যান্সটি নিয়ে কিছু আলোচনা করতে চাইছি। এটি অত্যন্ত জরুরী কারণ অজ্ঞতার [অসাধু উদ্দেশ্যের কথাটি নাই বা বললাম] কারণে এ নিয়ে বিভিন্ন ভুল বার্তা ছড়াচ্ছে, যা নাগরিক চেতনায় বিভ্রান্তি আনতে বাধ্য। ধর্ষিতার বয়স বারো বছর বা তার কম হলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে—এই ধারাটি নিয়েই সবচেয়ে বেশি খিল্লি ছড়ানো হচ্ছে। এই যেমন ধরুন বারো বছর এক মাস হলে কি মহামানবী হয়ে যাবে ? সেক্ষেত্রে কি ধর্ষকের শাস্তি হবে না ?অথবা বারো বছরের বেশি হলে ধর্ষণটা আরামদায়ক হবে ? কেউ কেউ বলছেন যে বয়সেই হোক ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই হওয়া উচিত  ইত্যাদি ইত্যাদি !এইসব পোষ্ট তথা পর্যবেক্ষণ আমাকে মোটেই বিস্মিত করেনি। কারণ আমি খুব ভাল করেই জানি ১৪০ কোটির এই দেশটির অলি গলি বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, কবি, খেলোয়াড় এবং অবশ্যই আইনঙ্গ দিয়ে টইটুম্বুর আর তাই মাঝেমধ্যেই উপচে পড়ার অবস্থা হয়। ফলশ্রুতি হিসেবে এই সব পোষ্ট, মতামত এবং পর্যবেক্ষণ। যাক আসুন এবার এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক, নতুন আইনটিতে কি বলা হয়েছে। 
ধর্ষণ একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ [ ধর্ষিতা যে বয়সেরই হোক] এই পর্যবেক্ষণটির একচুলও নড়চড় হয়নি। কেবল কোয়ান্টাম অফ পানিশমেন্ট অর্থাৎ শাস্তির মেয়াদ এবং তীব্রতা ক্ষেত্র বিশেষে বাড়ানো হয়েছে।
১] বারো বছর পর্যন্ত শিশুদের ক্ষেত্রে ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এই মর্মে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
২] ধর্ষিতা নারীদের ক্ষেত্রে [ ১৬ বছরের উর্ধ্বে] ধর্ষকের শাস্তির মেয়াদ সশ্রম কারাদণ্ডের মেয়াদ সাত বছর থেকে বাড়িয়ে দশ বছর করা হয়েছে,  আজীবন কারাবাসও হতে পারে। 
৩] ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত ধর্ষিতার ক্ষেত্রে শাস্তির মেয়াদ আগে দশ বছর ছিল, তাকে কুড়ি বছর অবধি বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রেও আজীবন কারাবাস হতে পারে।
৪] শুধু তাই নয়, ১৬ বছরের নিচে [ধর্ষিতার বয়স] হলে আগাম জামিন অর্থাৎ ancipatory bail পাওয়া যাবেনা।
৫] দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি–

এই গেল আইনটির সারমর্ম। মৃত্যুদণ্ড কতটা অমানবিক অথবা সেটি আরও ক্ষতি করবে কিনা, সেই আলোচনা এখানে করছি না। উপরিউল্লিখিত প্রশ্নগুলির বিশেষ করে ধর্ষিতার বয়সের উল্লেখ কতটা অবৈজ্ঞানিক এবং হাস্যকর তার উত্তর খোঁজাই এ পোষ্টের উদ্দেশ্য। প্রথমেই বলে রাখা ভাল আমি আইনজ্ঞ নই। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞও নই। যেহেতু কিঞ্চিৎ লেখালেখি করি, একটু আধটু পড়াশোনা করতেই হয়। এই যেমন ধরুন আমার বর্তমান উপন্যাসটির পটভূমি ভারত, ফ্রান্স এবং নরওয়ে মূলত এই তিনটি দেশ। সেখানে অপরাধীর চরিত্র যেমন আছে,  আইনজ্ঞের চরিত্রও আছে। তাই নরওয়ে তথা ইউরোপের আইন ব্যবস্থা নিয়ে কিঞ্চিৎ পড়াশোনা করতেই হচ্ছে। নইলে চরিত্রগুলিকে ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। তাই আসুন দেখে নেওয়া যাক পৃথিবীর উন্নত তথা অগ্রসর দেশগুলিতে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন কি বলছে। তার আগে আর একটি বিষয় বুঝে নেওয়া যাক। সেটি কি ? হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন—অভিন্ন দেওয়ানী বিধি বা uniform civil code এর আদলে ধর্ষণের শাস্তির কোনো অভিন্ন পরিমাপ নেই। অর্থাৎ quantum of punishment ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হয়। আসলে সাম্যের জয়গান শুনতে শুনতে আমরা সাম্যের মূল ভিত্তিটিই বিস্মৃত হই। সাম্য সে কর্মসংস্থানই বলুন ট্রেনে বাসে চড়াই বলুন, নারী পুরুষের বিবাহ বিচ্ছেদই বলুন অথবা বিয়ের বয়সই বলুন কোনো গনতন্ত্রেই হুবহু এক রকম হয়না। তার পেছনে অনেক কারণও আছে। কিন্তু এই পোষ্টে বিশদ আলোচনা সম্ভব নয়। এই যেমন ধরুন আইন অনুযায়ী নারী পুরুষের বিবাহের বয়স এক নয়। এমনকি ঘরোয়া বিবাদের ক্ষেত্রেও নারী পুরুষের জন্য সমান আইন নেই। চাকরি বাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। বাস ট্রেনে, গচ্ছিত আমানতে সুদের ক্ষেত্রেও সিনিয়র সিটিজেনরা একটু বেশি সুবিধা পেয়ে থাকেন। তা নিয়ে আপনি নিশ্চয় বৈষম্যের আওয়াজ তোলেন না। অতএব শাস্তির ক্ষেত্রেও যে এমনটা হবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু আছে কি ? তাই ধর্ষণ মানেই প্রাণদণ্ড, বারো বছরের বেশি হলে কি কম কষ্ট হয় ? ইত্যাদি প্রশ্ন অবান্তর। হাস্যকরও বটে। মনে রাখতে হবে পৃথিবীর কোনো আইনব্যবস্থাই সেই অর্থে আদর্শ নয়। কারণ কিছু নির্দিষ্ট প্যারামিটার মেনে নিয়েই তাকে কাজ করতে হয়, যা আপনার আমার অপছন্দ হতেই পারে। এই যেমন ধরুন কোন আইনই আকাশ থেকে পেড়ে আনা হয়না। অনেক ভাবনা চিন্তা তো থাকেই , তার সঙ্গে থাকে বেশ কিছু পূর্বসুরী বা precedent .  এই যেমন ধরুন ভারতের সংবিধানটিই একাধিক দেশের আইন , অনুচ্ছেদ তথা ধারা উপধারার মিশ্রণ। কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,  আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া ইত্যাদি অনেক দেশের সংবিধান থেকে সাহায্য নিয়েই এটিকে রূপ দেওয়া হয়েছে। শুধু কি তাই ব্রিটেনের সংবিধান তথা আইনব্যবস্থা রূপায়নের ক্ষেত্রে যেমন বাইবেলের সাহায্য নেওয়া হয়েছে, তেমনই ভারতের ক্ষেত্রে মনুসংহিতা তথা অন্যান্য হিন্দু শাস্ত্রের অবদান অনস্বীকার্য। আর বর্তমানে দাঁড়িয়ে যে কোনো আইন প্রণয়ন করার সময় এগিয়ে থাকা দেশগুলির শরণাপন্ন হওয়াটাই অলিখিত নিয়ম। ভারতীয় সংবিধান রচনার সময় যা করা হয়েছিল। এবার দেখে নেওয়া যাক আমাদের দেশে যে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন বলবত আছে সেটি কি একেবারে ইউনিক ? অর্থাৎ এর কোনো পূর্বসুরী নেই? পৃথিবীর কোন দেশেই কি এমন আইন নেই ? বর্তমান শাসক দলটি কি মূর্খের মত অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা না করে এমন একটি “হাস্যকর” আইন বানিয়ে ফেলল ? আইন প্রণয়নকারী মানুষগুলির মাথাতেও গোবর আর গোমূত্র ঠাসা ? তবে ধর্ষিতার বয়স অনুযায়ী ধর্ষকের শাস্তির তীব্রতার পরিমাপ করা হচ্ছে কেন ? আগেই বলেছি এর পেছনে সামাজিক, বৈজ্ঞানিক, শারীরতাত্ত্বিক, প্রতিরোধ তথা আত্মরক্ষা করার ক্ষমতা, মানসিক আঘাত তথা ট্রমা, যৌনতা সম্পর্কিত জ্ঞান বা অজ্ঞতা, সম্মতির সম্ভাব্যতা ইত্যাদি অনেক কারণ আছে যা এই ক্ষুদ্র পরিসরে বর্ণনা করা অসম্ভব। তাই আসুন দেখে নেওয়া যাক এগিয়ে থাকা দেশগুলির আইন এব্যাপারে কি বলছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ধর্ষিতার বয়স একটি অন্যতম ফ্যাক্টর। ইউরোপও এর ব্যতিক্রম নয়। আমি কেবল দুটি দেশের উদাহরণ দেব। ১]নরওয়ে [ কারণ এই দেশটি সাধারণত human development index এর শীর্ষে থাকে এবং স্ক্যানডিনেভিয়ার প্রতিনিধিত্ব করে। এই অঞ্চলের বাকি দেশগুলির আইন কানুনও প্রায় একরকম ] ২] রাশিয়া এই দেশটি আগে সমাজতান্ত্রিক দেশ ছিল এবং এদেশের অনেকেই এই নামটির সঙ্গে পরিচিত।
দেখে নেওয়া যাক নরওয়ের মত প্রথম সারির দেশটিতে ধর্ষিতার বয়স গুরুত্ব পাচ্ছে কিনা।
Further, the same section defines aggravated rape as a rape committed

a. by multiple persons in cooperation (gang rape)
b. in a particularly painful or offensive manner
c. by a person previously convicted of rape under § 192 or of sexual activity with a child under the age of 14 (as per § 195 of the penal code)
d. in such a way that the victim either dies or receives grievous bodily harm.
প্রথমেই বলে রাখি এখানে কেবল aggravated rape অর্থাৎ চরম হিংস্র বলে বিবেচিত হতে পারে এমন ধর্ষণের মাপকাঠিই  উল্লেখ করা হয়েছে, এমন অংশটিই নিয়েছি, যেখানে শাস্তি সবচেয়ে বেশি। যদিও তা কখনও মৃত্যুদণ্ড নয়।কারণ এই শাস্তিটি ইউরোপ থেকেই উঠে গেছে।  নরওয়েতে ধর্ষণের ক্ষেত্রে শাস্তি সাধারণত সর্বোচ্চ দশ বছর। কিন্তু ভয়াবহতা এবং নৃশংসতার মানদণ্ড হিসেবে ভিন্ন একটি সেকশন সেখানেও আছে। কি বলা হচ্ছে সেখানে ?  
১] যদি একাধিক ব্যক্তির দ্বারা কোন নারী ধর্ষিতা হন অর্থাৎ গ্যাং রেইপ
২] যে ব্যক্তি  আগেও ধর্ষণে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে এবং ধর্ষিতার বয়স ১৪ বছরের নিচে। [ধারাও উল্লেখ করা আছে]
৩] এমনভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে যে ধর্ষিতার মৃত্যু ঘটেছে অথবা ভয়াবহ কোনো আঘাতের শিকার হয়েছে।
অর্থাৎ ধর্ষিতার বয়স একটি ফ্যাক্টর।

এবার আসি রাশিয়ার ক্ষেত্রে।
Rape or coercive sexual actions without any aggravating circumstances are punishable with 3 to 6 years of imprisonment. If the crime:

was committed repeatedly (against 1 or more than 1 victim)
was committed by a group of criminals
was committed with a threat of murder or grievous harm to the health
was committed with particular cruelty (e.g. the criminal used violence that caused severe physical pain or the crime was committed in presence of relatives of the victim)
caused an STD infection
then it is punishable with 4 to 10 years of imprisonment with possible subsequent restraint of liberty for up to 2 years (i.e. the criminal may not change or leave residence without permission and must register himself at local penal inspectorate 1 to 4 times a month; court may also impose additional restrictions such as the criminal may not leave home in certain hours, visit certain locations, change work without permission).

If the crime

Was committed against a person between 14 and 18 years
Caused the grievous harm to the health, HIV infection or other grievous consequences (e.g. suicide of the victim)
then it is punishable with 8 to 15 years of imprisonment with the subsequent mandatory restraint of liberty for up to 2 years and a possible ban on certain occupations or employment positions for up to 20 years.

If the crime

Caused the death of the victim by inadvertency
Was committed against a person under 14 years
then it is punishable with 12 to 20 years of imprisonment with the subsequent mandatory restraint of liberty for up to 2 years and a possible ban on certain occupations or employment positions for up to 20 years

পুরোটা অনুবাদ করছি না। সহজেই বুঝতে পারছেন ধর্ষিতার বয়স এখানেও একটি উল্লেখযোগ্য মানদণ্ড। এই যেমন ধরুন ধর্ষিতার বয়স যদি ১৪ থেকে ১৮ হয় তবে শাস্তির মেয়াদ ৮ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত। কিন্তু সর্বোচ্চ শাস্তিটি জানতে হলে শেষ অংশটি পড়ুন যেখানে হিংস্রতম ধর্ষণের কথা বলা হয়েছে।
১] যদি ধর্ষিতার মৃত্যু হয়
২] বয়স যদি ১৪ বছরের নিচে হয়।
[বি দ্র এখানে ব্যবহৃত victim শব্দটি লিঙ্গ নিরপেক্ষ । যেহেতু নারীরাই এর প্রধান শিকার তাই ধর্ষিতা শব্দটি অনুবাদে ব্যবহার করেছি]
এক্ষেত্রে শাস্তির মেয়াদ ১২ থেকে ২০ বছর।ধর্ষকের চাকরি বাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু বিধি নিষেধ লাগু হবে। সে বিষয়ে আর গেলাম না।
তবে কি দাঁড়াল ? ধর্ষণের শাস্তির ক্ষেত্রে কেবল ভারত নয়, পৃথিবীর সব দেশেই বয়স একটি মানদণ্ড। কেবল ধর্ষিতার নয়, ধর্ষকেরও[ সেটি এখানে আলোচনা করিনি, দিল্লিতে নির্ভয়া ধর্ষণের হিংস্রতম খলনায়কটি বয়সের কারণেই ছাড়া পেয়ে যায় ] yes, the age matters !  আর এটুকু বোঝার জন্য আইনঙ্গ হওয়ার দরকার নেই।