ভারতের বামপন্থী

গোমূত্রে পাপ ধুয়ে যায়! ময়ূরের চোখের জল পান করে ময়ূরী গর্ভবতী হয়! মহাভারতে ইন্টারনেট?

গোমূত্রে পাপ ধুয়ে যায়!  ময়ূরের চোখের জল পান করে ময়ূরী গর্ভবতী হয়!  মহাভারতে ইন্টারনেট? একুশ শতকে প্রবেশ করেও এই সব শুনতে হবে আমাদের?  কারা বলছেন?  না,  কোনো বিজ্ঞানী নন।

হাই কোর্টের বিচারপতি। অথবা রামভক্ত কোনো “মহাজ্ঞানী “ন্যাতা!  ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাচ্ছে!  ছেলেপুলে, নেতা নেতৃ, ক্যাডার, ল্যাডার, বুড়োবুড়ি সবাই প্রাণ খুলে হাসছে। ফেসবুকে স্টেটাস দিতে দিতে গড়িয়ে পড়ছে।  আমিও খুব হাসছিলাম জানেন!  গড়িয়েও পড়েছিলাম।

কিন্তু মাঝপথে আটকে গেলাম। পেটের খিলটা আচমকাই আলগা হয়ে গেল।  কোথা থেকে যেন  একটা কান্নার দলা উড়ে এলো!  কারণ আমি দেখলাম যারা আমার সঙ্গে হাসছেন তাঁদের বেশিরভাগই বাম ব্রিগেডের কমরেড। কী অবাক হলেন? 

চিরবিজ্ঞান মনস্ক বামেরাই তো বেশি করে হাসবেন!  এতে অবাক হওয়ার কী আছে!  এবার আপনি আমায় হাসালেন বন্ধু!  বামেরা বিজ্ঞানমনস্ক?  যুক্তিবাদী?  হা হা হা!  না, বন্ধু ভুল করছেন। বাম মানেই সকাল বিকাল বিজ্ঞান দিয়ে কুলকুচি?।

এই রাজ্যে অন্তত নয়।এরা গোরুতেও হাসেন, বিজ্ঞানেও হাসেন। মূত্রেও হাসেন, সূত্রেও হাসেন। কারণ এরা নিজেরাই একটি হাস্যকর প্রজাতি।

১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ শে জুন এক বিশ্ববিখ্যাত বাঙালী ডাক্তার এবং বিজ্ঞানী যখন একটি সিলিঙ ফ্যান থেকে ঝুলে পড়েছিলেন, তখনও এরা হেসেছিলেন।

আসুন আপনাদের একটা গল্প বলি!  গল্প নয়, তবু রূপকথার মত শোনাবে!  মনে হবে বিংশ শতাব্দীতেও এটা সম্ভব! 

আসুন আলাপ করিয়ে দিই। ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায়।  জন্ম ১৬ই জানুয়ারি, ১৯৩১, হাজারিবাগ। কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৫৫ সালে শারীরবিদ্যা ( Physiology)  তে স্নাতক হন।

সেই সময় এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। তারপর বিশিষ্ট অধ্যাপক শ্রীসচ্চিদানন্দ ব্যানার্জীর তত্ত্বাবধানে ১৯৫৮ খ্রীষ্টাব্দে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি reproductive physiology তে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।

না এখানেই থেমে যান নি। ১৯৬৭ খ্রীষ্টাব্দে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি আর একটি ডক্টরেট নেন। বিষয় Reproductive endocrinology.

হ্যাঁ তারপর যা ঘটল, তা  নিছক ইতিহাস বললে ভুল বলা হবে।  তৃতীয় বিশ্বের এই জনবহুল দেশটি যে কেবল মূলত ফিল্মস্টার, গায়ক, ন্যাতা এবং ক্রিকেটারের জন্ম দিতে দিতেই “মহান” হয়ে উঠছিল, 

সে এই প্রথম ঢাল তরোয়ালহীন এক “নিধিরাম সর্দার” বিজ্ঞানীর আবির্ভাব লগ্নের সাক্ষী হতে শুরু করল। Cryobiologist সুনীত মুখার্জী এবং gyneocologist সরোজকান্তি সহযোগী করে কোনো আধুনিক গবেষণাগার তথা যন্ত্রপাতি ছাড়াই তিনি এক অসাধ্য সাধন করে ফেললেন।

জন্ম দিলেন এশিয়ার প্রথম তথা পৃথিবীর দ্বিতীয় টেষ্ট টিউব বেবি দুর্গা ওরফে কানুপ্রিয়া আগরওয়ালের। ১৯৭৮ সালের ৩রা অক্টোবর।  পৃথিবীর প্রথম টেষ্ট টিউব বেবি লুইজি ব্রাউনের জন্মের মাত্র ৬৭ দিন পরে।

কী ভাবছেন?  বিজ্ঞানসম্মত দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে  বিশ্বাসী বামপন্থী সরকার তাঁর জন্য জয়মাল্য আর পুষ্পস্তবকের পাহাড় বানিয়ে লাল পতাকার মিছিল করে এই বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীটির দরোজায় পৌঁছে গেল? 

না, বন্ধু না। তেমন গৌরবগাঁথার জন্য আমাদের ঘেঁটুময় রাজ্য কখনই প্রস্তুত ছিল না। তবে কি হল?  অনুমান করুন তো!  হা হা হা! শুনুন তবে!  পাগল ডাক্তার বলে তাকে কেবল অপমানই করা হল না,

একঘরে করে দেওয়া হল। এমন একটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য তিনি অসংখ্য আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান মঞ্চ তথা সভায় বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। সমসাময়িক বাম সরকার তাঁকে একটিতে হাজির হতে দেন নি। বিদেশ ভ্রমণের সমস্ত কার্যক্রম কঠোর হাতে আটকে দেওয়া হয়।

১৮ই নভেম্বর, ১৯৭৮।  মহানুভব, বিজ্ঞানসম্মত এবং বিজ্ঞানমনস্ক বাম সরকার একটি এক্সপার্ট অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেন। উদ্দেশ্য?  ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায় নামক একজন “convict”  (বাংলায়?  হ্যাঁ ঠিক বলেছেন আসামী)  কে উচিত শিক্ষা দেওয়া।

কমিটিতে কে কে ছিলেন?  ছি ছি ছি!  দেখে নেবেন সেই সব দলদাস “বিজ্ঞানী ” “ডাক্তার ” এবং “বুদ্ধিজীবীর” নাম। আমার উচ্চারণ করতে ঘৃণা হচ্ছে। চাইলে লিংক দিয়ে দেব।  এই আসামীর বিরুদ্ধে কি কি অভিযোগ ছিল?  শুনুন।

১) কী সাহস!  এই পাগলটা বলে কিনা টেস্ট টিউব বানিয়েছে। আমেরকা পারল না, ফ্রান্স পারল না, জার্মানি পারল না, এমনকি সর্বহারার মহানতম দেশ সর্বশক্তিমান সোভিয়েত ইউনিয়নও পারল না,  আর এই শালা ঘরে বসে এই অতি আশ্চর্য বানিয়ে ফেলল!  তাও যদি আমাদের দলের কেউ হত! 

২) শালা বিজ্ঞানীর বাচ্চা!  তুই আমাদের মানে আলিমুদ্দিন, রাইটার্সকে না জানিয়েই প্রেসে বলে দিলি?  কী দুঃসাহস!  উঁহু এটা রীতিমত বিধিভঙ্গ ! 

৩) আবে বিজ্ঞানীর বাচ্চা, তোর কি যন্ত্রপাতি আছে বল তো?  দে লিষ্টি দে!  থাকিস তো একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে। কী বললি?  দু একটা “হাবিজাবি” যন্ত্রপাতি আর এক পিস পুরনো ফ্রিজ?  ঢপ মারার জায়গা পেলি না?  রাজ্যের নাম ডুবোনোর মতলব!  দাঁড়া তোকে চুমচুমির বাচ্চা দেখাচ্ছি।

৪) এই ডাক্তার!  তোর মাথাটা কেন এত উঁচু রে?  খুব রেলা না?  এই রকম বালের বিজ্ঞানী অনেক দেখেছি বুঝলি!  উনি বিজ্ঞান মারাতে এসেছেন! কত নামী দামী ডাক্তার আমাদের তোয়াজ করে জানিস?  ওদের ল্যাব দেখেছিস?  চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে বুঝলি!  ওরা কেউ পারল না আর তুই ছিঁড়ে ফেললি!  এবার আমাদের বোঝা দেখি কেমন করে করলি!

এই এক্সপার্ট কমিটির শীর্ষে কে ছিলেন জানেন?  এক রেডিও ফিজিসিস্ট। বাকিরা?  একজন সাইকোলজিস্ট, একজন নিউরোলজিস্ট,  আর একজন ফিজিসিস্ট।  বলাই বাহুল্য আধুনিক প্রজনন প্রযুক্তি নিয়ে এদের এক ছটাকও বিদ্যা ছিল না।

তারপর শুরু হল হেনস্থা আর অপমান!  প্রশ্নের পর প্রশ্ন। হাস্যকর, অমানবিক।  পার্টি আপিসে যেমন হয়। নমুনা শুনবেন?  এক পিস শোনাই! তা, ডাক্তারবাবু আপনি ভ্রুণগুলো কোথায় স্টোর করেন? কেন এমপুলের ভেতর! এম্পুল সিল করেন কিভাবে? 

হতবাক ডক্টর মুখোপাধ্যায় শুধু একবারই উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন — Pardon! না মানে সিল করার সময় এমব্রায়োগুলো মরে যায় না? 

সব তথ্য প্রমাণ বিচার বিবেচনা করে বিজ্ঞানসম্মত কমিটির বিজ্ঞানমনস্ক রায় দিলেন — এই লোকটি পাগল এবং যা দাবি করছে সব বোগাস!

এর মাত্র ৬৭ দিন আগেই ইংল্যান্ডের ওল্ডহ্যাম জেনারেল হসপিটালেই জন্ম নিয়েছে বিশ্বের প্রথম টেষ্ট টিউব বেবি লুইজি ব্রাউন। না এই বিজ্ঞানমনস্ক বাম নেতৃত্বের কেউই সে খবর রাখতেন না।

ডাক্তারবাবুও ঠিক বুঝতে পারেন নি। কেন এমন ঘটছে। বোঝার যে খুব ইচ্ছে ছিল তাও বলা যায় না। তাই ১৯৮১ সালের ১৯ শে জুন তিনি শেষমেশ ঝুলেই পড়লেন। স্তব্ধ হয়ে যাওয়া অনন্তের এপার থেকে একটি নারী দেখল একটি সিলিঙ ফ্যান থেকে তাঁর প্রিয় পুরুষ তথা স্বামীটির মৃতদেহটি মাটি ছোঁওয়ার চেষ্টা করছে।

তারপর অনেকটা জল বয়ে গেল। ১৯৮৬ সালের ১৬ই অগাস্ট ভারতের দ্বিতীয় টেস্ট টিউব বেবি জন্ম নিল। নাম হর্ষবর্ধন রেড্ডি।

কৃতিত্ব ডক্টর টি সি আনন্দকুমারের। দ্বিতীয় নয়, অফিসিয়ালি হর্ষই তখন ভারতের প্রথম টেষ্ট টিউব বেবি। সম্মান আর সম্বর্ধনার ঝড় বয়ে গেল। একটার পর একটা সম্মেলনে ছুটে যাচ্ছেন আনন্দকুমার। শুধু মালা আর মালা।

“পাগলা” ডাক্তারটি তখন ঘুমিয়ে।  অনন্তের ওপার থেকে তিনি তখনও অপেক্ষা করছেন। চোখের নিচে জল, ঠোঁটের কোনে রক্ত।

অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৯৭ সালে একটি বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে টি সি আনন্দকুমার কলকাতায় এলেন। “পাগলা” ডাক্তারের স্ত্রী এবং সহযোগী বিজ্ঞানীরা টি সি আনন্দকুমারের হাতে সমস্ত কাগজপত্র তুলে দিলেন। হ্যাঁ ” পাগলার” কাগজপত্র,  গবেষণা লব্ধ জ্ঞান যা তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছিলেন। দিস্তার পর দিস্তা। শুরু থেকে শেষ।

আনন্দকুমার সত্যিই একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। দলদাস ঘেঁটু ছিলেন না। তাই তিনি চুপ করে থাকতে পারলেন না। সবকিছু পড়ে বুঝে অনুভব করলেন তিনি নন,

আসলে এই “পাগলা” ডাক্তারটিই ভারত তথা এশিয়ার প্রথম টেষ্ট টিউব বেবির জন্মদাতা।  বিশ্বের বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীর সামনে নতমস্তকে ঘোষণা করলেন তিনি নন, ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই এই কৃতিত্বের দাবিদার। 

দুর্গা ওরফে কানুপ্রিয়া আগরওয়াল তাঁর ২৫ তম জন্মদিনে মিডিয়ার সামনে এলেন।  বাংলা জানল, ভারত জানল, বিশ্ব জানল। সৃষ্টি জানালো তার স্রষ্টার কথা। তিনি তখন পঞ্চভূতে বিলীন।

তাই এই বিশেষ প্রজাতির মানুষগুলো “বিজ্ঞান চাই” “বিজ্ঞান চাই” বলে চিৎকার করে ওঠেন, তখন আমি হেসে উঠি।  কারণ গোমূত্রের স্বাদটা ঠিক কেমন ওরা ১৯৭৮ সালেই জেনে গেছে।  সেই স্বাদগ্রহণকারী কমরেডদের অনেকেই এখনও জীবিত। 

আর একজনও হাসেন। কে বলুন তো?  সিমবায়োসিসের এম বি  এ এবং মর্গ্যান স্ট্যানলির ভাইস প্রেসিডেন্ট কানুপ্রিয়া আগরওয়াল।

আরো পড়ুন…….