ভিন্ন ধর্মে বিয়ে

ভিন্ন ধর্মে বিয়ে: মা, বাবাকে বুঝিয়েছিল, আধুনিক যুগে বিধর্মীকে বিয়ে করা কোনো সমস্যার নয়,কিন্তু!!

ভিন্ন ধর্মে বিয়ে: মা, বাবাকে বুঝিয়েছিল, আধুনিক যুগে বিধর্মীকে বিয়ে করা কোনো সমস্যার নয়,কিন্তু!!ঢাকাই জামদানি; না, গরদের লালপাড় শাড়ি, কোনটা পরবে, ঋতুর মাথায় কিছুই আসছে না! দরজা ঠেলে রাকেশ ঘরে ঢুকলো। “একি ঋতু তুমি এখনও বসে আছো ?”

ঋতু ছেলেমানুষ। তার বায়না পূরণ করতেই হয় রাকেশকে। ওদের বিয়ের মাত্র ছয় মাস হয়েছে। একবছর চুটিয়ে প্রেম করার পর পালিয়ে বিয়ে করেছে দুজনে।

এছাড়া অন্য পথ ছিল না ওদের কাছে। ঋতু বাড়ির একমাত্র সন্তান। শহুরে পরিবেশে মানুষ হয়েছে সে। বাবা মায়ের চোঁখের মণি। ঋতুর বাবা উত্তরবঙ্গের একজন নাম করা ব্যবসায়ী, এছাড়াও ঋতুদের প্রচুর জমি জায়গা রয়েছে।

ফলে কোনো মতেই একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করা মধ্যবিত্ত রাকেশকে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না ঋতুর পরিবারের পক্ষে।

তবে পরিবারের অমত থাকলেও, মেয়ের জেদের কাছে হার মানতে হয় তাদের। মাস দুয়েক পর একমাত্র মেয়েকে ছেড়ে আর থাকতে পারেন নি ঋতুর বাবা মা, রাকেশকে মেনে নিয়েছিলেন ওরা। রাকেশের পরিবারে মা ও ছেলে, মা গ্রামে থাকে।

…ঋতুর গায়ের রং সামান্য চাপা হলেও তার গোলগাল মুখে বেশ একটা অভিজাত লাবণ্য আছে। রাকেশও বেশ স্মার্ট। টিকালো নাক, প্রশস্ত বুক, উজ্জ্বল গায়ের রং, সকল মেয়ের মনেই কামনার আগুন জ্বালায়।

…রাকেশ ঘরে প্রবেশ করতেই ঋতুর আহ্লাদের সীমা নেই।
…ঋতু বায়না ধরলো, “রাকেশ আজ তুমি আমায় আলতা পড়িয়ে দেবে ?”  কথাটি বলেই ঋতুর আদুরে মুখে শিশুর সারল্য মাখা হাসির ছটা খেলে গেলো।

…ঋতু! আজ মায়ের বিসর্জন। সকল হিন্দু স্ত্রীরা সিঁদুর খেলতে যাবে। এসো, আমি তোমাকে নিজ হাতে সাজিয়ে দেবো।

…ঋতু উৎফুল্ল হয়ে সামান্য জোরে বলে উঠলো, সত্যি ?
…রাকেশ স্বল্পভাষী হলেও ঋতুর সামনে মনের আবেগ ধরে রাখতে পারে না।

…ঋতু, তোমার উপর আর কারও অধিকার নেই, তুমি শুধু আমার; এই বলে রাকেশ ঋতুর ফোলা ফোলা গালগুলি হাল্কা করে টিপে দিলো।

…ঋতুর হয় নি মাসিমা ? বল্টুর মা এসে ঋতুর শাশুড়ীকে সুধালো।
…ঋতু জ্ঞান হওয়া থেকে দেখে এসেছে, প্রতিবছর দশমীর দিন পাড়ার বৌদি, কাকিমা, দিদি, মাসিমা সবাই মিলে সিঁদুর খেলতে যায়। এই বছর ঋতুও যাবে, মা দুর্গার কাছে তার রাকেশের দীর্ঘায়ু কামনা করতে।

…বৌমা ? আর কতক্ষণ ? সবাই এসে গেছে।
…ঋতুর শাশুড়ি সবাইকে ঘরে নিয়ে এলো। বল্টুর মা মেঝেতেই বসে পরলো।
…উফ! রাকেশ, তাড়াতাড়ি আলতাটা পরিয়ে দাও, সবাই এসে গিয়েছে।
…লালপেড়ে গরদের শাড়িটা পরে ঋতুকে পাক্কা গিন্নির মতন লাগছে।

খাটের উপর বসে হাঁটু পর্যন্ত শাড়িটি তুলে নিলো ঋতু। ব্যস্ততায় ছটফট করছে ঋতু। রাকেশ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার নববধূর দিকে।
…কি দেখছো রাকেশ ? আলতাটা পরাও!

কথাটা যেন রাকেশের কানেই গেল না। তার দৃষ্টি ঝর্ণাসম ঋতুর পায়ের দিকে। মুখটি এগিয়ে ঋতুর একটি পায়ে আলতো চুমু দিলো সে।
…কি হচ্ছে রাকেশ ? দুষ্টুমি কোরো না সোনা!
..সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রাকেশ খুব যত্ন করে আলতা পড়িয়ে দিলো ঋতুর পায়ে।

…ঋতুর শাশুড়ী চিৎকার করে ডাকছে, আর কতক্ষণ বৌমা ? বেলা চলে যাচ্ছে যে, এরপর ভিড় হয়ে যাবে। এই মেয়েটাকে নিয়ে আমি আর পারি না, কবে যে বড় হবে। বল্টুর মা, তোমরা কি সন্দেশ কিনেছো ?

…না মাসিমা, পূজা মণ্ডপের পাশেই দোকান দিয়েছে সেখান থেকেই কিনে নেবো।
…তাহলে বৌমার জন্যও কিনে নিও তো! বাচ্চা মন কি থেকে কি নেবে। এই বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে খাটের কাছে গেল,

তার কিঞ্চিত সঞ্চয় করে রাখা টাকার ব্যাগটি বালিশের নীচ থেকে বের করে খুচরো পঞ্চাশ টাকা বল্টুর মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ভালো ক্ষীরের সন্দেশ কিনে দিয়ো বৌমাকে।

…ঋতু, রাকেশ তোরা কি করছিস ? সবাই বিরক্ত হচ্ছে যে। বৌমা কে পাঠিয়ে দে তাড়াতাড়ি।
…দরজার ভিতরে থেকে ঋতুর গলার আওয়াজ ভেসে আসছে, হ্যাঁ মা, হয়ে গেছে। কাকিমাদের বলো আর একটু অপেক্ষা করতে।

…কি হচ্ছে রাকেশ, ছাড়ো! এই না, প্লিজ! এসময় একদম না। সবাই অপেক্ষা করছে।
…না আগে একটু আদর করি। আজ তোমায় ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে ঋতু।
…এই বলে ঋতুকে বুকে জড়িয়ে ধরলো রাকেশ।

ঠোঁটে ঠোঁট রেখে দুজনেই ভেসে যাচ্ছে, শরীরের ভিতর যেন বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে, দুজনের নিশ্বাসের শব্দ ভারি হয়ে আসছে।

ক্রমে ঘরের ভেতর যেন হিংস্র পশুর লড়াই শুরু হলো, হার কেউই মানবে না। একসময় উভয়েই পরাজয় হয়। প্রকৃতির এটাই নিয়ম।

…সমস্ত ঘর জুড়ে যেন একটা কালবৌশাখী ঝড় বয়ে গেলো। ঝড়ের পর প্রকৃতি যেভাবে শান্ত হয়ে ওঠে, ধরাভূমির মলিনতা দূর হয়, গাছে গাছে ফুল ফোটে, নতুন পাতা জন্মায়,

আকাশ মেঘমুক্ত হয়ে নতুন আলোয় মানুষকে নতুনভাবে শুরু করার স্বপ্ন দেখায়, পাখিরা আবার ঘর বানায়, ঠিক সেভাবেই এই ঝড়ের পর রাকেশ ও ঋতু হয়তো নতুন প্রকৃতির জন্ম দেবে অচিরেই।

…আচমকা! ঘুমটা ভেঙে গেলো ঋতুর। মনটা খুব ভার ভার লাগছে। ঋতু জানে, স্বপ্ন কখনও সত্যি হয় না। তাই ওইসব নিয়ে সে ভাবেও না আজকাল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ভোর পাঁচটা বেজে দশ। বিছানা ছেড়ে উঠে পরলো ঋতু। গায়ে একটা হালকা চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে পরলো মর্নিংওয়াকে।

…আজ বছর দুই হল সে একাই থাকে। বাবা, মা গতবছরেই গত হয়েছেন। তারপরেই একাকীত্বের হাতছানি তাকে তড়াইয়ের এই পাহাড়ি অঞ্চলে নিয়ে এসেছে।

ঋতু পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে হেঁটে চলছে আনমনে, হালকা শীতল বাতাস তার গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। ভোরের আলোর সোনালী আভা সমস্ত পাহাড়টিকে যেন সোনা দিয়ে মুরে দিয়েছে। একের পর এক পাহাড়ি বাঁক অতিক্রম করে ঋতু হেঁটে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।

মনে পরছে সেই প্রথমদিন যেদিন রাকেশকে ছাড়াই ঋতু বিছনায় একা শুয়েছিল, রাকেশ তখন তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে পাশের ঘরে প্রথম বাসররাত কাটাতে ব্যস্ত। ঋতুর সেই লালপেড়ে শাড়ির স্বপ্ন আজ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কারণ, সে একজন মুসলিম বৌ। ধর্মীয় নির্দেশেই তার স্বামীকে অন্য নারীর সঙ্গে তাকে ভাগ করে নিতেই হবে।

…হ্যাঁ! ঠিক এই কথাটাই যেদিন রাকেশ ঋতুকে বলেছিল, সেদিন রাতে ঋতুর নিজের শরীরটিকেই পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। যে শরীরে দিনের পর দিন সে রাকেশের ভালোবাসা ধারণ করেছিল অশ্লেষে।

যে শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি সে ব্যবহার করেছিল রাকেশের প্রতি তার ভালোবাসার প্রতিদান হিসেবে। কিন্তু রাকেশ তাকে ঠকিয়েছে। সে তার মুসলিম পরিচয় গোপন করেই বিয়ে করেছে ঋতুকে।
কিন্তু ঋতু তো তারপরেও সব মেনে নিয়েছিল। শাঁখা, সিঁদুর, কপালের টিপ কিছুই তো ছুঁয়ে দেখেনি কোনোদিন। মা, বাবাকে বুঝিয়েছিল, আধুনিক যুগে বিধর্মীকে বিয়ে করা কোনো সমস্যার নয়।

সে জোর গলায় বলেছিল, #লাভ_জেহাদ বলে বাস্তবে কিছুই নেই৷ সকলেই মানুষ, ঈশ্বর আল্লাহর সন্তান। ওরা একে অন্যকে ভালোবাসে এটাই আসল কথা। খারাপ মানুষ হয়, ধর্ম খারাপ হয় না। কারণ, ধর্ম মানুষেরই তৈরী৷ রাকেশ খুবই মুক্তমনের, ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্মান করে, ধর্মীয় ভেদাভেদ মানে না৷ বাবা, মাকে বড় মুখ করে বলেছিল, তোমাদের চিন্তা নেই৷ দেখো, রাকেশ কখনওই কষ্ট দেবে না আমায়।

…কিন্তু আজ ঋতু মনে-মনে বলছে, রাকেশ তুমি লম্পট, তুমি শুধুই একজন মুসলমান। তোমার বিশ্বাসঘাতী ভালোবাসা আমাকে কাঁদিয়েছে।

সেদিন যখন তোমার মা এসে জানালো, “বৌমা রাকেশের বাবাও তিনটে বিয়ে করেছিল, আমি মেনে নিয়েছি; তুমিও মেনে নাও। আজকে রাকেশের বাসররাত, যাও ওদের বাসরঘর নিজের হাতে সাজিয়ে দাও।

তখন পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেছিলো আমার। বার বার ভাবছিলাম, আমার রাকেশের বুকে আজ অন্য কেউ মাথা রাখবে, আমার আর সে অধিকার নেই। আমি নিঃস্ব নিঃস্ব নিঃস্ব !

…শুভ বিহন, দিদি! কথাটি কানে আসতেই ঋতু সামান্য কেঁপে উঠলো। ধাতস্থ হয়ে উত্তর দিল, শুভ বিহন বিপুল। বিপুল এই পাহাড়ি গ্রামেই থাকে। এই নেপালি ছেলেটি মাঝে মাঝেই ঋতুর বাড়ির বাগান পরিষ্কার করতে আসে।
…বিপুল চলে যেতেই ঋতু তাড়াতাড়ি পা চালাতে লাগলো, ঘরে ফিরতে হবে। কিন্তু এই ঘর তার স্বপ্নের ঘর নয়, যে স্বপ্ন ঋতুকে নষ্ট করে দিয়েছে। তার ঘৃণা হয় সে কথা ভেবে সেদিন রাকেশ গায়ে হাত দিয়েছিলো তার।

যে জন্য ঋতুর পেটের সন্তানটিও নষ্ট হয়ে যায়। যেহেতু সেও রাকেশের সুখের কথা ভেবে নজিয়া বেগম নাম নিয়ে মুসলিম হয়েছিল, সেহেতু অভিযোগ করলে কাজী সাহেব রায় দিয়েছিল, মুসলিম পুরুষের অবাধ্য স্ত্রীকে পেটানোর ধর্মীয় নির্দেশ আছে।

এটা অপরাধ নয়। গর্ভের সন্তানের মৃত্যুর জন্যে সে চাইলে থানায় মামলা করতেই পারে।
…না, রাকেশের প্রতি ভালোবাসা তখনও মরে যায়নি, কোনো কেস করেনি সে সেদিন। আজ বুঝতে পারছে, মনটা যেন চিৎকার করে বলছে- রাকেশ তুমি পাপী, লম্পট, প্রতারক, বর্বর।

তুমি শুধু তোমার স্বার্থের জন্যে, ধর্মীয় নির্দেশের দোহাই দিয়ে আমাকে মুসলিম ধর্ম নিতে বাধ্য করেছো।

…ঋতু সেদিন রাতের পরেই রাকেশের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে আসে। ঘরে ফিরে তিনদিন মায়ের মন্দিরে মাথা ঠুকেছিল, যে মন্দিরে সে অগণিতবার নিজের অসহায়তা দূর করতে গিয়েছে।

এসবের পর ঋতুর মা ঋতুকে একটি কথাই বুঝিয়েছিলো, “তুমি কাদায় পড়েছিলে, কাদা ধুয়ে ফেলো। তুমি ঈশ্বর ভক্ত, তোমার মন আত্মা জুড়ে ঈশ্বর আছেন। তাই তোমার শরীরে কাদা লেগেছিল মাত্র, আত্মাকে সেই নোংরা ছুঁতেও পারে নি।

সেইদিন ঋতু খুব কেঁদেছিল। মনের ভেতর জমে থাকা মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পরে চোখ দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা।
…এই মুহূর্তে খুব হালকা লাগছে ঋতুর৷ তার নিজের প্রতি ঘেন্না ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে৷ রাকেশের মতন ধর্মীয় উন্মাদরা বিধর্মী নারীকে শুধুই ভোগের বস্তু ভাবে৷ তাইতো ধর্মের জন্য হিন্দু মহিলাকে বিয়ে করেছিল সে ভালোবাসার পোশাকে৷ যদিও ঋতু জানে, সেই পশুর হাত থেকে সে অনেক কিছু হারিয়ে শেষে রেহাই পেলেও, তার মতই আবারও কেউ এ মায়াবী ফাঁদে পড়বেই!

(সম্পাদনা- #Writankar_Das)

আরো পড়ুন…..