রাষ্ট্রভাবনা রবীন্দ্রনাথ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ

রাষ্ট্রভাবনা রবীন্দ্রনাথ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ।-দুরর্ম

রাষ্ট্রভাবনা রবীন্দ্রনাথ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ।  ভারতবর্ষের বৌদ্ধিক জগতে স্বাধীনোত্তর কাল থেকেই নেহরুর আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে ছদ্ম সেকুলার ও বামপন্থীদেরই রমরমা। এদের সুকীর্তির(?) ফলে বিবেকানন্দ রচনাবলী থেকে বহু জায়গায় হিন্দু শব্দ উধাও হয়ে গেছে ।

এদের কল্যাণে (?) স্বামীজি হয়েছেন ‘গীতা ছেড়ে ফুটবল খেলার পরামর্শদাতা‘ এবং ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে‘ ও ‘শক, হুণ দল মোঘল পাঠান এক দেহে হল লীন‘ – এর বাইরে আর রবীন্দ্রনাথের কোনও অস্তিত্ব নেই। অথচ কবির বহু প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত ( উদ্দেশ্য প্রণোদিত) রচনার গভীর ও মনজ্ঞ অধ্যয়ন দেখায় যে, কবিগুরুর রাষ্ট্রভাবনা পাশ্চাত্য ভাবনার একদম বিপরীত এবং আরও আশ্চর্যের বিষয় তার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তারজী, দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক শ্রীগুরুজী সহ পরবর্তী সরসঙ্ঘচালকগণ এবং সঙ্ঘের বরিষ্ঠ প্রবাদপ্রতীম কার্যকর্তাদের বিভিন্ন সময়ে ব্যক্ত ভাবনার সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য। নীচের আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে।

রাষ্ট্রভাবনা রবীন্দ্রনাথ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ
রাষ্ট্রভাবনা রবীন্দ্রনাথ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ।

 

প্রথমেই রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath) তাঁর ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য‘প্রবন্ধে লিখেছেন ‘নেশন‘ শব্দ আমাদের ভাষায় নাই, আমাদের দেশে ছিল না। সম্প্রতি ইউরোপীয় শিক্ষাগুনে ন্যাশনাল মহত্ত্বকে আমরা অত্যধিক আদর দিতে শিখিয়াছি।

আবার, ‘ আত্মশক্তি-র অন্তর্গত ‘নেশন‘ প্রবন্ধে তিনি রেঁনার ‘নেশন‘ – এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ‘রেঁনার‘ নেশন -এর ব্যাখ্যা আমাদের ‘রাষ্ট্র’ ভাবনার কাছাকাছি হলেও পূর্ণাঙ্গ নয়। তার থেকেও বড় হল পাশ্চাত্য ‘নেশন’ বলতে যা বোঝে তা ‘রেঁনার’ ভাবনা থেকে অনেকটাই ভিন্ন।

 

রেঁনা দেখিয়েছেন, নেশনের মূল লক্ষ্য কী, তা বলা শক্ত, জাতীর ঐক্য, ভাষাগত ঐক্য,ধর্মের ঐক্য, দেশের ভূমি সংস্থান, এ-সকলের উপর ন্যাশনালত্ব নির্ভরশীল নয়। কিন্তু পাশ্চাত্য জগত রাজনৈতিক বা শাসনগত সার্বভৌমত্বকেই নেশনের’ মূল উপাদান হিসাবে গ্রহণ করেছেন-যার প্রবক্তা রূপে ইতালির ম্যাকিয়াভেলির নাম অগ্রগণ্য।

এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ রূপে ব্রিটিশ সরকারের কাউন্সিল অফ সেক্রেটারি অফ স্টেট্স- এর সদস্য জন স্ট্রেচি ১৮৮৮ সালে লেখেন-
This is the first and most essentialal thing to learn about India that there is not and never was an India or even any country of India possessing, according to European ideas, any sort of unity, physical, political, social or Religions. No Indian nation, no people of India of which we hear so much.’

 

এই কথারই অনুসরণ করেই যে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ‘ A Nation in a making‘- বলেছিলেন তা বলাই বাহুল্য। মেকলে শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়দের অনেকেই জ্ঞানত বা অজ্ঞানত এই ধারণা পোষণ করেন। এখানেই রবি ভাবনার মঞ্চ-প্রবেশ। কবি ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন- ‘এই লোকচিত্তের একতা সব দেশে এক ভাবে সাধিত হয় না। এইজন্য ইউরোপীয় ঐক্য ও হিন্দু ঐক্য এক প্রকারের নহে, কিন্তু তাই বলিয়া হিন্দুর মধ্যে যে একটা ঐক্য নাই, সে কথা বলা যায় না। সে ঐক্যকে ন্যাশনাল না বলিতে পার- কারণ নেশন ও ন্যাশনাল কথাটা আমাদের নহে, য়ুরোপীয় ভাবের দ্বারা তাহার অর্থ- সীমাবদ্ধ হইয়াছে।.ইউরোপের কাছে ন্যাশনাল ঐক্য অর্থাৎ রাষ্ট্রতন্ত্র মূলক(শাসনতন্ত্রমূলক পড়লে বুঝতে সুবিধা) ঐক্যই শ্রেষ্ঠ; আমরাও ইউরোপীয় গুরুর নিকট হইতে সেই কথা গ্রহণ করিয়া পূর্বপুরুষদিগের ন্যাশনাল ভাবের অভাবে লজ্জবোধ করিতেছি।

সকলে আপন ভাষা, বর্ণ, ধর্ম ও আচারের প্রভেদ সত্ত্বেও সুবিশাল হিন্দুসমাজের মধ্যে একটি বৃহৎ সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া একত্রে বাস করিতেছে। হিন্দুসভ্যতা এত বিচিত্র লোককে আশ্রয় দিতে গিয়ে নিজেকে নানা প্রকারে বঞ্চিত করিয়াছে, কিন্তু তবু কাহাকেও পরিত্যাগ করে নাই…..”

 

প্রবন্ধের শীর্ষক ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ’ কিন্তু রাষ্ট্রের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হিন্দু, হিন্দু সভ্যতা, হিন্দুসমাজ-শব্দগুলি বারবার এসেছে। এর মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট ভাবে ‘ভারতীয়’ এবং ‘হিন্দু’ শব্দকে সমার্থক রূপে গ্রহণ করেছেন এবং কার্যত: স্বীকার করেছেন ভারতীয় বৈশিষ্ট্যের আধার হচ্ছে হিন্দু সমাজ, সভ্যতা। অর্থাৎ মূল সমাজ হিন্দু। একই প্রবন্ধে আমাদের রাষ্ট্র ধারণায় প্রাশ্চাত্যের বিপরীত এই সমাজই যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তা ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছেন- “কিন্তু একথা আমাদিগকে বুঝিতে হইবে, আমাদের দেশে সমাজ সকলের বড়ো, অন্য দেশে নেশন নানা বিপ্লবের মধ্যে আত্মরক্ষা করিয়া জয়ী হইয়াছে – আমাদের দেশে তদপেক্ষা দীর্ঘকাল সমাজ নিজেকে সকল প্রকার সঙ্কটের মধ্যে রক্ষা করিয়াছে।”

 

রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath) ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য‘ প্রবন্ধে লিখেছেন-
“আমাদের হিন্দু সভ্যতার মূলে সমাজ, ইউরোপীয় সভ্যতার মূলে রাষ্ট্রনীতি“

” হিন্দু সভ্যতা রাষ্ট্রীয় ঐক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নহে, আমরা স্বাধীন হই বা পরাধীন, হিন্দুসভ্যতাকে সমাজের ভিতর হইতে পুনরায় সঞ্জীবিত করিয়া তুলিতে পারি এ আশা ত্যাগ করার নহে।”

 

বারবার হিন্দু শব্দই তিনি ব্যবহার করেছেন। মিশ্র বা ভারতীয় শব্দ ব্যবহার করেননি। আবার ‘আত্মপরিচয়‘ প্রবন্ধে তিনি বলছেন, – “মুসলমান একটা বিশেষ ধর্ম কিন্তু হিন্দু কোন বিশেষ ধর্ম নহে। হিন্দু ভারতবর্ষের একটি জাতিগত পরিণাম।” অর্থাৎ রাষ্ট্রের ব্যাখ্যায় যে হিন্দু সভ্যতা, সমাজের কথা বলছেন তা সংকীর্ণ উপাসনা ভিত্তিক হিন্দু সম্প্রদায় নয় তা আমাদের মধ্যকার আত্মিক যোগসূত্রের ভিত্তি। এক জীবন-দর্শন ‘জীবনচর্যা যা অন্য অনেক প্রবন্ধে তিনি বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু কবির এই  লোচনা থেকে বোঝা যায় যে তিনি ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় রূপকে হিন্দু রূপেই দেখেছেন যা মোটেই সাম্প্রদায়িক নয়।

তাহলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ যখন বলে ভারতের রাষ্ট্রীয় সমাজ হিন্দু, ভারত একটি হিন্দুরাষ্ট্র তখন তা কিভাবে Theocratic state বা পোপতন্ত্র / খলিফা তন্ত্রের সমান হয়। সঙ্ঘ ভাবনার বিরোধিতা করার অর্থ তো কবিগুরুরই বিরোধিতা করা। সঙ্ঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গুরুজীর বক্তব্যে কবিগুরুর কথারই যেন প্রতিধ্বনি।

 

১৯৬২-র ৩ জুন প্রধানমন্ত্রী নেহরুরজীর সভাপতিত্বে আয়োজিত জাতীয় সংহতি পরিষদ (ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন কাউন্সিল) এর বৈঠকে ব্যক্ত শ্রী গুরুজির নিম্নোক্ত ভাবনা নথিভূক্ত আছে–“ভারতীয় রাষ্ট্রীয় জীবন পুরাতন। এক তত্ত্বজ্ঞানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একই জীবনাদর্শের সঙ্গে যুক্ত এক সাংস্কৃতিক পরম্পরার মাধ্যমে জনজীবন পরস্পর আবদ্ধ। খ্রিস্টান ও ইসলাম আক্রমণকারীদের অনেক আগে থেকেই তা বিদ্যমান। অনেক মত, সম্প্রদায়, জাতি কখনও কখনও অনেক রাজ্যে বিভক্ত দেখা গেলেও তাঁর একাত্মতা অবিচ্ছিন্ন। যে মানবসমূহের মধ্যে এই একাত্ম জীবনধারা রয়েছে, তাদের ‘হিন্দু’ বলে সম্বোধন করা হয়। তাই ভারতীয় রাষ্ট্রজীবন ‘হিন্দু‘ রাষ্ট্রজীবন।”

“ভারতে হিন্দুকে কোনভাবেই সম্প্রদায়িক (কম্যুনাল) বলা যায় না। তারা সম্পূর্ণ ভারতকে ভক্তি, শ্রদ্ধা করে এবং তাঁর উন্নতি ও গৌরবের জন্য পরিশ্রম করতে সদা তৎপর। ভারতে রাষ্ট্র জীবনের আদর্শ (ভ্যালুজ) হিন্দু জীবন থেকেই পুষ্ট রয়েছে। অতএব, তা রাষ্ট্রীয়, কখনই কম্যুনাল (সাম্প্রদায়িক) নয়।”

 

‘ভারতবর্ষীয় সমাজ‘ প্রবন্ধের শেষে কবি বলেছেন,”সমাজকে শিক্ষাদান, স্বাস্থ্যদান, অন্নদান, ধনসম্পদ-দান, ইহা আমাদের নিজের কর্ম; ইহাতেই আমাদের মঙ্গল – ইহাকে বাণিজ্য হিসাবে দেখা নহে, ইহার বিনিময়ে পূর্ণ ও কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই আশা না করা, ইহাই যজ্ঞ, ইহাকে ব্রহ্মের সহিত কর্মযোগ, এই কথা নিয়ত স্মরণ করা, ইহাই হিন্দুত্ব।” ভাবনা চিন্তার কী আশ্চর্য সমাপতন। শ্রী গুরুজী বলেছেন ‘ সম্পূর্ণ ভারতের উন্নতি ও গর্বের জন্য পরিশ্রমকারীরা হিন্দু, কবিগুরু বলেছেন সমাজের সর্বাঙ্গীণ উন্নতিতে দানের মাধ্যমে ত্যাগ স্বীকারই হিন্দুত্ব। 

তাহলে শ্রীগুরুজীর হিন্দুত্ব যদি সাম্প্রদায়িক হয় তবে কবিগুরুর হিন্দুত্ব কী? ‌কবি বলেছেন হিন্দু সভ্যতা রাষ্ট্রীয় ঐক্যের ওপর নির্ভরশীল নয় এবং সমাজই প্রধান। অর্থাৎ একটি মাত্র শাসনতন্ত্রের দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া ঐক্য নয় সমাজের একাত্মতাই মুখ্য। এটা সঙ্ঘের সার্বিক দৃষ্টিকোণ যে ভারতের রাষ্ট্রীয় ঐক্য বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক। তা রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের উপর নির্ভরশীল নয়।

 

তাই অতীতে অসংখ্য রাজা বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য থাকলেও ভারত সাংস্কৃতিকভাবে এক ছিল। এমনকি ওই জন্যই আমরা ‘অখন্ড ভারতের’ স্বপ্ন বুকে লালন করি।অর্থাৎ সেখানে শাসক ভিন্ন হলেও হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমরা সাংস্কৃতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হব। অর্থাৎ শাসনতন্ত্র প্রধান নয়। সঙ্ঘের এক সময়কার সরকার্যবাহ ও বিশিষ্ট লেখক স্বর্গীয় শেষাদ্রিজি তাঁর ‘হিন্দুরাষ্ট্র পর চর্চা-এক স্বাগত যোগ্য কদম’ প্রবন্ধে বলেছেন-” প্রত্যেক রাষ্ট্র তার জাগতিক প্রয়োজন পূরণের জন্য রাজ্য (state) নামক এক ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

রাষ্ট্রজীবনে সেটির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও, তা রাষ্ট্রের সমকক্ষ বা সমার্থক হতে পারে না। রাষ্ট্র এক সজীব সত্তা এবং রাজ্য তার শরীর, সংস্কৃতি তাঁর মন ও বুদ্ধি। হিন্দু তাত্ত্বিক ধারণার মধ্যে সকলে সেই সম্পূর্ণ রচনা পরিপূর্ণ ভাবে উপলব্ধি করেন।” সঙ্গের দৃষ্টিকোণ এটাই যে ভারতে গ্রীক, শক,হুন,তাতার, মঙ্গোলীয় অনেক গোষ্ঠী আক্রমণকারী রুপে এসেছেন। কিন্তু তাঁরা কালক্রমে ভারতের মূল রাষ্ট্রীয় সমাজ বা কবির ভাষায় হিন্দু সমাজের সঙ্গে মিশে গেছে।

 

কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক ভারতের মুসলমানেরা মূল হিন্দু সমাজের মধ্যে মিশে যায়নি। সেটা এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানেরা হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েও শ্রীরাম বা রামায়ণের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা হারায়নি। কিন্তু ভারতে মুসলমান সমাজের অধিকাংশের তা করতে অসুবিধা হয়েছে। উপাসনা পদ্ধতি ভিন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা হিন্দু সংস্কৃতি, হিন্দু জীবনচর্যা থেকেও নিজেদের ভিন্ন মনে করেছে, পরিণামে দেশভাগ। অর্থাৎ সঙ্ঘ যে ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের’ কথা বলে যা উপাসনা পদ্ধতি,শাসনতন্ত্রের অনেক ঊর্ধ্বে তার সঙ্গে মুসলমানদের অনেকেই একাত্ম হতে পারেনি।

এখানেও রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা,তাঁর ‘আত্মপরিচয়‘ প্রবন্ধে সঙ্ঘ ভাবনারই প্রতিফলন দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট – “আমি হিন্দু সমাজে জন্মিয়াছি এবং ব্রাহ্মসম্প্রদায়কে গ্রহণ করিয়াছি – ইচ্ছা করিলে আমি অন্য সম্প্রদায়ে যাইতে পারি কিন্তু অন্য সমাজে যাইব কি করিয়া ? সে সমাজের ইতিহাস তো আমার নহে ।

 

গাছের ফল এক ঝাঁকা হইতে অন্য ঝাঁকায় যাইতে পারে কিন্তু এক শাখা হইতে অন্য শাখায় ফলিবে কী করিয়া ? তবে কি মুসলমান অথবা খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ে যোগ দিলেও তুমি হিন্দু থাকিতে পার ? নিশ্চয়ই পারি। ইহার মধ্যে পারাপারির তর্কমাত্রই নাই। জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর হিন্দু খ্রিষ্টান ছিলেন, তাহারও পূর্বে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দু খ্রিস্টান ছিলেন, অর্থাৎ তাঁহারা জাতিতে হিন্দু, ধর্মে (এখানে সম্প্রদায় অর্থে) খ্রিস্টান। বাংলাদেশে হাজার হাজার মুসলমান আছে, হিন্দুরা অহনীশি তাহাদিগকে হিন্দু নও হিন্দু নও বলিয়াছে এবং তাহারাও নিজেদিগকে হিন্দু নই হিন্দু নই শুনাইইয়া আসিয়াছে কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাহারা প্রকৃতই হিন্দুমুসলমান।”

“হিন্দু শব্দে এবং মুসলমান শব্দে একই পর্যায়ের পরিচয়কে বুঝায় না। মুসলমান একটি বিশেষ ধর্ম কিন্তু হিন্দু কোনো বিশেষ ধর্ম নহে। হিন্দু ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি জাতিগত পরিণাম।”

 

গান্ধীজী তো মুসলমানদের কাছে টানার চেষ্টা করেও সফল হননি। অর্থাৎ অধিকাংশ মুসলমান অন্য সম্প্রদায়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য সমাজেও চলে গিয়েছেন। তাই ভারতের ইতিহাস, মহাপুরুষ—–তাদের শ্রদ্ধেয় থাকেনি। কুরুক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণ-অর্জুন তাঁদের কাছে ব্রাত্য। কিন্তু কারবালা প্রান্তরের হাসান-হোসেন তাদের প্রিয় যার সঙ্গে এখানকার ইতিহাস, সংস্কৃতি, সমাজ, পূর্বপুরুষ কোনও কিছুরই সম্পর্ক নেই এবং এই মানসিকতার জন্যই দেশভাগ।

তাই সঙ্ঘ যখন বারবার ভারতীয় মুসলমান-খ্রিস্টানরা উপাসনা পদ্ধতিতে ভিন্ন হলেও একই হিন্দু সংস্কৃতি, জীবনচর্যা, পূর্বপুরুষ, ইতিহাসের অঙ্গীভূত এবং তার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক, না থাকাটাই অস্বাভাবিক বলে, তখন সঙ্ঘকে সাম্প্রদায়িক বলা হয় কেন ? বর্তমান সঙ্ঘচালক মোহনজী যখন ১৩০ কোটি দেশবাসীকেই ‘হিন্দু’ সম্বোধন করেন তখন তা ‘আধিপত্যবাদী’ বলে সমালোচনা কেন? তিনি তো কবিগুরুর কথাই প্রতিধ্বনি করেছেন। বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবীদের তো তাঁর জয়গান করার কথা, নিন্দা নয়।

 

সঙ্ঘ এ বিষয়ে আশাবাদী যে মুসলমান, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মত পরিবর্তন হবে। তাঁরাও হিন্দু সভ্যতা, সংস্কৃতি, সমাজের জন্য গর্ববোধ করবেন। তাদের মধ্যে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিরাও এ ব্যাপারে সচেষ্ট। পঞ্চম সরসঙ্ঘচালক স্বর্গীয় সুদর্শনজী তাঁর ‘হিন্দু রাষ্ট্র কিঁউ‘ প্রবন্ধে এই প্রসঙ্গে এরনাকুলামের আর্চবিশপ ড. জোসেফ কার্ডিনল পেরাকেটিলের একটি বক্তব্য যা ৫ ডিসেম্বর ১৯৭৮ – এ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত হয়েছিল তা উদ্ধৃত করেছেন – “গীর্জাঘরের সঙ্গে যুক্ত এখানকার লোকেদের এই ভূমির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ হিন্দু পরম্পরা থেকে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করা উচিত।

আর্চবিশপ যিনি চার্চের ভারতীয়করণের প্রবল পক্ষপাতী, বলেন যে মুসলমান খ্রিস্টান সমেত সব ভারতীয়র এই দেশের সংস্কৃতিকে স্বীকার করা উচিত।” সঙ্ঘের এই ইতিবাচক ভাবনা ও প্রচেষ্টা যেন কবিগুরুর আশা-আকাঙ্ক্ষারই প্রতিচ্ছবি যখন তিনি তাঁর ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে বলেন – হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিস্টান ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে পরস্পর লড়াই করিয়া মরিবে না – এইখানে তাঁহারা একটি সামঞ্জস্য খুঁজিয়া পাইবে। সেই সামঞ্জস্য অহিন্দু হইবে না, তাহা বিশেষভাবে হিন্দু। তাঁহার অঙ্গ প্রতঙ্গ যতই দেশ-বিদেশের হউক, তাঁহার প্রাণ, তাঁহার আত্মা ভারতবর্ষের।

 

 

“সেই সামঞ্জস্য অহিন্দু হইবে না তাহা বিশেষভাবে হিন্দু” – ছদ্ম সেকুলার ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের তো তাহলে সঙ্ঘ ও বর্তমান সঙ্ঘপ্রধানকে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট; আধিপত্যবাদী ইত্যাদি বাছাই করা বিশেষণে ভূষিত করার আগে কবিগুরুকেই ওই সব বিশেষণে ভূষিত করতে হয় ! পাঠকরাই বিচার করুন ।

লেখক :- শুভঙ্কর সাহা- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

আরো পড়ুন……….