শ্রেষ্ঠ বাঙালি যিনি হলেন তার নামটাই বাংলা ভাষায় নয়। ভাষাগত ঐক্যের সঙ্গে জিনগত সাদৃশ্যের কোনো একমাত্রিক সম্পর্ক যেমন নেই, ভাষাগত ঐক্যের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ঐক্যের সম্পর্কও সেরকমই জটিল। সার্বিয়ান আর ক্রোয়েশিয়ান দুটো আলাদা জাতি একই ভাষায় কথা বলে। ধৰ্মও এক, কিন্তু চার্চ আলাদা।
সার্বিয়ানরা অর্থোডক্স, ক্রোয়েশিয়ানরা ক্যাথলিক। লিপিও আলাদা। সার্বিয়ানরা কিরিলিক এবং ক্রোয়েশিয়ানরা রোমান বর্ণমালা ব্যবহার করেন। এদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ হয়েছে ইতিহাসে।
বাংলা ভাষাকে বাঙালি জাতির সংজ্ঞা হিসেবে ব্যবহার করায় সমস্যা অনেকগুলো হয়েছে। সে সমস্যা বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় চলে গেল, যে আমরা শুনলাম হাজার বছরের বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ বাঙালি হলেন মুজিবর রহমান। অর্থাৎ এ জাতি নাকি মোটে হাজার বছরের পুরোনো, আর শ্রেষ্ঠ বাঙালি যিনি হলেন তার নামটাই বাংলা ভাষায় নয়।
বাংলা ভাষাকে নিয়ে প্রচুর ঢাকঢোল পিটিয়ে শেষমেশ বাঙালিকেই বাদ দেওয়ার যে আন্দোলন, যাকে আমি ভাষাবাদ বলি, সেটা যে শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষাকেই এক্সক্লুড করে দেয়, তার আরেকটা প্রমাণ, বাংলাদেশে যে বাংলাটা বলা হয়, সেটাকে আরবী ফার্সি উর্দু তুর্ক তূর্যনিনাদ মিলিয়ে (উদাহরণ দিয়ে বক্তব্য ভারাক্রান্ত করার কোনো ইচ্ছে নেই) বাংলা বলে চেনে কার বাপের সাধ্যি।
ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা যারা বলেন, তারা অতি প্রাচীনকাল থেকেই নানা জাতির মানুষ। আর্য কোনো জাতির নাম নয়। ভারতে আর্য বললে স্রেফ নোবল বর্ন বোঝাত। একথাও সত্যি, ইরানে এই আর্য কথাটা ব্যবহার হয়েছে জাতিবাচক অর্থে, এবং উচ্চজাতি অর্থে। (ভাষা এলিটদের পরিচয় হয় প্রায়ই, ভারতে ইংরেজি যেমন)। ইরান দেশটার নাম এসেছে আরিয়ান থেকে। ইরানের আর্যভাষীরা ভারত থেকে মাইগ্রেট করেছিলেন, এরা বেদের অসুর। আজ যেমন কলকাতায় অবাঙালি বললে অনেককেই বোঝায়, যদিও মূলত হিন্দিভাষীদের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত, অসুর বললে সেযুগে সমস্ত অবৈদিক আর্যভাষীদের বোঝানো হত। বাংলাও অসুরভাষী ছিল, এবং এইখানেই, আমাদের নিজস্ব অবৈদিক তন্ত্রধর্মেই বাঙালির শেকড়।
বাংলা নিঃসন্দেহে আর্যভাষা। বাংলা ভাষায় এবং বাঙালি জাতির মধ্যে অস্ট্রিক উপাদানও প্রচুর, দ্রাবিড় ভাষারও কিছু প্রভাব আছে, প্রাচীন তাম্রলিপ্ত দামল বা তামিল জাতির নগর ছিল। যতটা জানা আছে আমাদের, তার মধ্যে জেনেটিক তথ্য প্রায় কিছুই নেই, এবং সে স্টাডি কবে হতে পারবে, মা গঙ্গায় জানেন।
কিন্তু বাংলায় লেফট লিবারেল বিশ্বমানবদের একাধিপত্য শুরুর আগে বাঙালিকে নিয়ে বেশ কিছু নৃতাত্বিক পরীক্ষা হয়েছে, ভাষাতাত্বিক পরীক্ষা হয়েছে। সেগুলো যাচাই করে দেখলে বোঝা যায়, বাঙালির মধ্যে অবৈদিক ইন্দো আলপাইন রক্ত আছে, বাংলা ভাষার কাঠামোও তারাই দিয়েছেন। প্রকৃতি পুরুষের উপাসনা বাঙালির নিজস্ব দর্শন শুধু নয়, এ বস্তুটা বাঙালির নিজস্ব ধর্ম, এবং এটা বাঙালি জাতি গঠনে সাহায্য তো করেছেই, আমার মতে এ দর্শন যার পোশাকি নাম সাংখ্য এবং যার গুহ্য নাম তন্ত্র, তা এই জাতি গঠনের মুহূর্তে এক মহা অভিঘাত হিসেবে এসেছিল।
মহাভারতের সময় যে মগধের আধিপত্য ভারতজোড়া, ঐতিহাসিক কালে যে গঙ্গারিডাই-মগধ সাম্রাজ্য, পুণ্ড্র থেকে শ্রীগুপ্ত যে গুপ্ত সাম্রাজ্য গঠন করলেন, বুদ্ধের যে ধর্ম সারা এশিয়াকে আলো দেখিয়েছিল, এগুলোর উত্তরাধিকার আধুনিক যুগে যে জাতি বহন করে, তার নাম বাঙালি। মাতৃ উপাসক, শক্তি উপাসক বাঙালির পূর্বপুরুষ সিন্ধু সরস্বতী সভ্যতার অন্যতম অংশীদার ছিল। বাঙালির রক্তে প্রচুর দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক উপাদান, জিনেও তাই, কিন্তু জাতি হিসেবে, সংস্কৃতি হিসেবে আমরা ইন্দো আলপাইন অসুর অবৈদিক (ব্রাত্যক্ষত্রিয় পুণ্ড্র যেমন) আর্যদের উত্তরাধিকারী। কপিল সম্পর্কে হরপ্রসাদ বলেছিলেন, তাঁকে ঋষি বলা হয় না, সর্বদাই আদিবিদ্বান। কপিল অবৈদিক ছিলেন, তাই ঋষি নন। কপিল আর্য ছিলেন, কিন্তু অবৈদিক।
জিন আর ভাষা/জাতি এক সরলরেখায় তো অবশ্যই চলে না। কিন্তু ভাষা এক হলেও এক জাতি হয় না। শেষ বিচারে, সংস্কৃতিই নির্ধারণ করে জাতীয়তা। বাঙালির সংজ্ঞা দেয় প্রকৃতি পুরুষের দ্বৈতবাদ। যিনি সেটা মানেন না, মানেন, ধরা যাক, রাম বা হনুমান, আল্লা বা মহম্মদ, তাঁকে বাঙালি বলা যায় না।
আরো পড়ুন…