মহারাণা প্রতাপকে নিয়ে যদি বলিউড সিনেমা বানায় তাহলে কি সেটা হিন্দুত্ববাদীদের কাজ হবে? মুঘল সম্রাট আকবর, বাবর, শাহজাহানকে নিয়ে সিনেমা টিভি সিরিয়ালে ভারত ছয়লাব। এসব সিরিয়ালে স্থানীয় হিন্দু রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়গুলিকে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে জয় দেখানো হয়েছে। কিন্তু রাজপুত মহারাণা প্রতাপ আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন তার দেশের জন্য সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে।
চিতোর যুদ্ধে তিরিশ হাজার রাজপুত বীর যোদ্ধা মারা যায়। একশো রাজপুত নারী আত্মহুতি ও জহরব্রত নেয় শত্রুর হাতে ধরা না পড়ার জন্য। মহারাণা প্রতাপ হলদিঘাট যুদ্ধে অসামান্য লড়াই করেন। রাজপুত হয়েও আকবরের সেনাপতি হওয়া মানসিংহকে মহারাণা প্রতাপ বলেন, ‘আপনি সেই রাজপুত তো নন যিনি রাজপুতী সংস্কৃতিম মান সন্মান আত্মীয়তার লজ্জ্বা বিসর্জন দিয়ে বোন-বেটিদের বিধর্মীদের হাতে তুলে দিতে পারেন…’।
আকবরের নিজস্ব ঐতিহাসিক আল বদায়ুনী যে ইতিহাস লিখে গেছেন সেখানে দেখা যায় রাজপুতরা যুদ্ধের সময় ধ্বনি দিচ্ছে ‘হর হর মহাদেব’ আর মুঘলরা ‘আল্লা আকবর’। ইংরেজ আসার আগে মুসলিম সাম্রাজ্য সম্প্রসারণকালের এই যুদ্ধগুলিতে পেশাদার সৈনিকদের জাত ধর্ম নির্বিশেষ খাকলেও শাসকদের জাতি-ধর্মগত জাতীয়তাবাদ ছিলো পুরো মাত্রায়। তবু কেমন করে বাম ইতিহাসবিদরা বলেন মুসলিম শাসনে হিন্দু মুসলমানের সম্পর্ক ছিলো ভাই ভাই?
যতীন সরকারের মত লেখক কেমন করে বলেন, ইংরেজ আসার আগে সাতশো বছরের মুসলিম শাসনে একটিও হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার ইতিহাস নেই? অথচ রবীন্দ্রনাথের ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসে পাঠানদের চোখে স্থানীয় কাফেরদের প্রতি ঘৃণা ও তাদের হত্যা করতে পারলে জান্নাত পাবার বিশ্বাসের পাশাপাশি প্রতাপাদিত্যের হিন্দুত্ববাদ যে ষোল আনা ছিলো সেটি তুলে ধরা হয়েছে।
পানিপথের যুদ্ধে বাবর তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে এই অভিযানকে ‘জিহাদ’ বলেছিলেন। তখন একজন সৈন্য বলেছিলো, শরাব পানকারীর সঙ্গে আল্লা থাকে না। বাবুর উত্তর দিয়েছিলো, হ্যাঁ সত্য যে শরাব পানকারীর সঙ্গে আল্লা থাকে না তাই আজ থেকে আমি শরাব ত্যাগ করার ঘোষণা দিলাম…।
বাবুর মদ সত্যিই ছেড়েছিলেন কিনা জানা নেই। কিন্তু সেকালে ভারতবর্ষে আসা এইসব মুসলিম যোদ্ধারা স্থানীয়দের চোখে কেমন ছিলো যেখানে রাজ পরিবারের নারীদের স্বনির্মিত চিতা তৈরি করে আত্মহুতি দিতে হতো? সেই ইতিহাস তো সাতশো বছর ধরে স্থানীয়দের মধ্যে চর্চা হয়েছে। তবু কেন এমন যুক্তি দেয়া হয় মুসলিম শাসন ছিলো হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সহিষ্ষুতার সম্পর্ক?
মধ্যযুগের কাব্যগুলিতে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হিন্দু মুসলমান বিদ্বেষ। আছে বাদশা জাহাঙ্গীরের হিন্দু বিদ্বেষ। আছে প্রতাপাদিত্যের মুসলিম বিদ্বেষ। তবু বামদের সাতশো বছরের মুসলিম সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে এত বায়াস হতে হয় কেন?
- নানজিং ধর্ষণ: কি ছিল নানজিং ধর্ষণের ঘটনা যা মানবতার সব সীমা অতিক্রম করেছে?
- ভারত কি হায়দ্রাবাদ, সিকিম বা গোয়া উদ্ধার করেছে নাকি দখল?
বলছিলাম মহারাণা প্রতাপকে নিয়ে যদি সিনেমা তৈরি হয় তাতে আকবর বাদশাহকে ঠিক ভিলেন হতে হবে না। আকবর সত্যিই ভারতের মহান একজন শাসক ছিলেন। কিন্তু মহারাণা প্রতাপের সামনে তাকে স্রেফ বিদেশীই মনে হয়। যদিও আকবরের জন্ম এই দেশেই। তার পরবর্তী সমস্ত জেনারেশনও এই ভূমিতে জন্মেছিলেন। এমনকি মুঘলদের বংশধরদের যখন উজবেকিস্তানের সরকার নাগরিত্ব দিতে চেয়েছিলো তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
কাজেই রবীন্ত্রনাথের ভাষায় আর্য অনার্য চীন শক হুন পাঠান মুঘল একদেহে হলো লীন। তবু মুঘলসহ অন্যান্য মুসলিম সাম্রাজ্যবাদের শাসকদের হিরো হিসেবে তৈরি সিনেমা সিরিয়াল হতে পারেল, এমনকি তুরস্কের অটোমান খিলাফতের মুসলিম শাসকদের সিরিয়াল যদি ভাষান্তর করে সম্প্রচারিত হতে পারে তাহলে ভারতবর্ষের স্থানীয় রাজাদের নিয়ে সিনেমা বানালে কেন সেটা হিন্দুত্ববাদীদের কাজ হবে?
আমি বাজি ধরে বলতে পারি, মহারাণা প্রতাপকে নিয়ে সিনেমা বানালে লিবারালদের হাউ কাউয়ে কান পাতা দায় হবে। যখন মানসিংহকে প্রতাপ ‘গাদ্দার’ বলবে, যখন বিদেশী শক্তি বলে মুঘলদের আথ্যায়িত করবে সেটা কি তারা মেনে নিতে পারবে? জটিল প্রশ্ন।
#সুষুপ্ত_পাঠক