এখন সেই দর্শনকে আড়াল করে বলছেন বামুনরাই থাকতে চায়নি! কেন ভাই, দ্বিজাতিত্ত্বকে স্বীকার করে নিতে লজ্জ্বা কেন? শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কি সত্যিই বলেছেন ‘বাংলাদেশ আলাদা না হলে বাংলা ভারতের রাষ্ট্রভাষা হতো’? ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রেক্ষিতে শীর্ষেন্দু এরকম অবশ্য বলতেই পারেন।
কিন্তু এতে গায়ে ফোসকা পড়ে গেলো কেন বাংলাদেশের মুসলিম জাতীয়তাবাদী বামপন্থি সাহিত্যিক জাকির তালুকদারের? তিনি শীর্ষেন্দুর নাম ধরে কটাক্ষ করে ফেইসবুকে লিখেছেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষরা ভারতের সাথে থাকেনি বলেই আজ আমরা স্বাধীন হতে পেরেছি। বিজেপি-র থিঙ্কট্যাঙ্ক তো বাংলাদেশকে দখলে নিতে চায়। আপনিও কি নরমসুরে সেই ইঙ্গিতটাই দিলেন?
আচ্ছা কেউ কি দেখাতে পারবেন পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ ‘অখন্ড বাংলা’ স্বাধীনতার কথা বলেছিলো বা প্রস্তাব দিয়েছিলো? শরৎ বসু-সোহরাওয়ার্দী মিলে যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তা একদম অন্তিমে। সেই সময়ে এই প্রস্তাব কানে তোলার মত পরিস্থিতি ছিলো না। ১৯৪৭ সালে যখন দেশভাগ অবধারিত দেখা যাচ্ছিল তখনই পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু নেতাদের মনে ভয় ঢুকে যায়। তারা মনে করেছে যদি বাংলা পুরোটা পাকিস্তানে যোগ দেয় তাহলে হিন্দুদের ভবিষ্যত কি? হিন্দুরা মার খেয়ে যাবে কোথায়?
আর্যরা বহিরাগত নয়: আর্য দ্রাবিড় এক জনজাতি, ‘আর্যরা বহিরাগত’ এই তত্ত্বের উদ্ভাবনের কারণ কি?
বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের সেই মর্মান্তিক কাহিনী
কিংবা বাংলা আলাদ স্বাধীন হলে কি গ্যারান্টি আছে যে পরে পাকিস্তানে যোগ দিবে না? তফসিলি বা দলিত হিন্দুদের নেতা যোগেন মন্ডল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের রাজনৈতিক বলয়ের ভারতে না থেকে ‘মুসলমানদের পাকিস্তানে’ থাকাকে তার শ্রেণীর মানুষদের জন্য মঙ্গলজনক মনে করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘হিন্দুদের আওতায় থাকিয়া ঘৃণিত জীবন যাপন করার চেয়ে মুসলমান অথবা অন্য কোন জাতির আওতায় স্বাধীন ও সম্মানের সহিত বাস করিতে তফসিলি জাতি বেশী পছন্দ করে’
যোগেন মন্ডল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পিছনে যে শ্রম দিয়েছিলেন তার পুরস্কার স্বরূপ জিন্না তাকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৫০ সালে বামুন-কায়েত হিন্দুদের হাতে নয়, বরং যাদের ভাই ডেকে এইদেশে থেকে গিয়েছিলেন সেই মুসলমানরা হাতে নিজ শ্রণীর কচুকাটা হতে দেখে তিনি ভীত হয়ে পড়েন। ট্রেনে কেবল হিন্দুদের রক্তাক্ত লাশ দেখে তিনি তীব্র প্রতিবাদ করেন। ফল পান হাতেনাতে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠে। তিনি পালিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেন।
সেখানে গিয়ে পদত্যাগপত্র লিখে পাঠান। সেখানে তিনি লেখেন, ‘আমার পক্ষে এটা বলা অন্যায্য নয় যে পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দুদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ‘নিজভূমে পরবাসী’ করা হয়েছে, আর এটাই এখন হিন্দুদের কাছে পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ চিত্র। হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করাটাই এদের একমাত্র অপরাধ।…সুদীর্ঘ ও উদ্বেগময় সংগ্রামের পর শেষ পর্যন্ত আমাকে একথাই বলতে হচ্ছে যে পাকিস্তান আর হিন্দুদের বাসযোগ্য নয়।
তাঁদের ভবিষ্যতে প্রাণনাশ ও ধর্মান্তরকরণের কালো ছায়া ঘনিয়ে আসছে। অধিকাংশ উচ্চবর্ণের হিন্দু ও রাজনৈতিক সচেতন তফসিলি জাতির লোকেরা পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে গেছে। যে সমস্ত হিন্দুরা এই অভিশপ্ত দেশে অর্থাৎ পাকিস্তানে থেকে যাবে, আমার দৃঢ বিশ্বাস ধীরে ধীরে এবং সুপরিকল্পিত ভাবে তাদের মুসলমানে পরিণত করা হবে বা নিশ্চিহ্ন করা হবে’ (মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ, জগদীশ মণ্ডল, ১ম খন্ড)।
কথা সেটা নয়। এই যে যোগেন মন্ডল জাকির তালুকদারদের ‘পূর্বপুরুষদের’ সঙ্গে পাকিস্তানে থেকে গেলেন বামুন-কায়েতের ভারতে না গিয়ে। তারপর যখন জান নিয়ে টানাটানি পড়ল তখন আশ্রয় নিলেন পশ্চিমবঙ্গ তথা বাঙালী একটা রাজ্যে। যদি পশ্চিমবঙ্গসুদ্ধ পাকিস্তানে যোগ দিত তাহলে যোগেন মন্ডল ভারতে আশ্রয় নিতো অবাঙালী কোন রাজ্যে। ভারতের বাঙালী হিন্দুরা এই ভয়টাই পেয়েছিলো। তারা ভেবেছিলো বাঙালী হিন্দু দেশহীন হতে পারে।
তারা প্রত্যক্ষ করেছিলো বাঙালী মুসলমানরা কিভাবে খিলাফত আন্দোলনে শরিক হয়েছিলো। কিভাবে তুরস্কের খলিফাকে নিজেদের খলিফা বলেছিলো। তারা নিজেদের আলাদা সংস্কৃতির উত্তোরাধিকার বলে মনে করে। জাকির তালুকদারের ‘পূর্বপুরুষ’ সাহিত্যিক আবুল ফজল বলেছিলেন, অখন্ড ভারত বা অখন্ড বাংলায় মুসলমানদের একটি বড় অভিযোগ ছিল – ‘হিন্দু সংস্কৃতি, ইসলামবিরোধী পৌত্তলিক মনোভাবপূর্ণ সাহিত্য মুসলমানদের উপর জোর করিয়া চাপানো হইয়াছে।
এক ভান্ডারের খোঁজ -আফগানিস্তানের চলচ্চিত্র আর অন্যান্য প্রতিবেদনের পুনরুদ্ধার।
বাংলার আত্মঘাতী সেক্যুলার সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির জগতে স্বামী প্রণবানন্দ এক উপেক্ষিত…
এই অভিযোগ লইয়া মুসলমান সমাজ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেও কম আন্দোলন করে নাই।’ অর্থ্যাৎ আবুল ফজলের সরল স্বীকারোক্তি পাকিস্তান আন্দোলন কিসের উপর দাঁড়িয়ে ছিলো। ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে চিঠি দিয়ে আবুল ফজল লিখেছিলেন, ‘মুসলমানের আবেগ অনুভূতি, ধ্যানধারণা আর রুচিতে যে সব রচনা আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে তা এখন পাঠ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়াই উচিত। আর উচিত এখন থেকে মুসলমান লেখকদের কিছু কিছু বই পাঠ্য তালিকাভুক্ত করা। তা হলেই পাকিস্তান হাসিলের সঙ্গে রক্ষিত হবে সংগতি আর মুসলমানদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চেতনাও পাবে কিছুটা তৃপ্তি’ (আবুল ফজল, স্মৃতিকথা রেখাচিত্র, ১৯৬৫)।
এই যখন দুই সম্প্রদায়ের একজনের মনোভাব তখন অপর পক্ষ কি নিজের হিন্দুত্ববোধ জাগিয়ে তুলবে না? ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে যদি খালি নিজ সম্প্রদায় আর জাতির তালগাছ ধরে থাকি তাহলে কেবল জাকির তালুকদারের মত সাম্প্রদায়িক বিশ্লেষণ করতে হবে। নিজের বই বিক্রি না হওয়ার জন্য ভারতীয় বাঙালী লেখকদের দুষতেন তাকির তালুকদারের ‘পূর্বপুরুষ’ আহমদ ছফা। এই জ্বালা জাকির তালুকদারের। যে কারণে পাকিস্তান করেছিলেন জাকির তালুকদারের ‘পূর্বপুরুষরা’, দেখা যাচ্ছে তবু শেষরক্ষা হচ্ছে না। হিন্দুদের জন্য কোথাও মাথা তোলা যাচ্ছে না।
পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ, তবু ভারতীয় বই, সিনেমা, টিভির জন্য বেকার হয়ে পড়ে বাংলাদেশের মুসলমানরা। এমনকি হিন্দুরা সংখ্যা বেশি থাকলে তারাই সব চাকরি বাকরিতে বসে যাবে তাই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে আলাদা মুসলিম দেশ করার বাসনা নিয়ে যে পাকিস্তানের জন্ম, সেখান থেকে বাংলাদেশ- কমতে কমতে হিন্দুর সংখ্যা এখন ৭ শতাংশ, তবু হিন্দুরা সরকারী চাকরিতে চোখে পড়ার মত অবস্থায়। হায় হায়, দ্বিজাতি তত্ত্ব এরকম মাঠে মারা যাচ্ছে দেখে কি কারোর মাথা ঠিক থাকে? তাই সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে এইসব বাম লিবারালরা বলা শুরু করল বাংলাদেশে হিন্দুরা অনেক ভালো থাকে (সরকারী চাকরি)। তারা দেশ ত্যাগ করে নির্যাতনের বানোয়াট কাল্পনিক ঘটনা তৈরি করে…। হিন্দুদের মধ্যে লেখাপড়ার চর্চা অনেক বেশি।
তাদের মধ্যে শিক্ষকতার ঝোঁক আজো অতিমাত্রায়। যে কারণে স্কুলগুলোতে প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে তাদের সংখ্যাটা চোখে পড়ার মত। এসব জায়গায় অর্থ্যাৎ সরকারি অন্যান্য চাকরিতে ধর্মীয় পরিচয়ের দয়াতে কেউ আসে না। যোগ্যতায় আসতে হয়। বাংলাকে যদি মুসলমানরা অখন্ড ভাগ চাইত তাহলে অখন্ড বাংলায় বামুন-কায়েতদের সঙ্গে কি জাকির তালুকদাররা পেড়ে উঠতেন? সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশদের তো বিদেশী বলে উচ্চ ট্যাক্সে ফে্লে বিক্রি মন্দ করতে চেষ্টা করেছিলেন। বিদেশী বলে তাদের সিনেমা আসা বন্ধ করতে পেরেছিলেন। যদি অখন্ড বাংলা হতো তখন প্রতিযোগিতাটা কিভাবে রুদ্ধ করতেন হে জাকির তালুকদার?
আপনার ‘পূর্বপুরুষরা’ জানত হিন্দুরা অনেক এগিয়ে। ওদের সঙ্গে পিছিয়ে থাকা মুসলমান সমাজ পারবে না। তাই তাদের বাদ দিয়ে কেবল মুসলিম পরিচয়ে দেশ চাইতে হবে। এখন সেই দর্শনকে আড়াল করে বলছেন বামুনরাই থাকতে চায়নি! কেন ভাই, দ্বিজাতিত্ত্বকে স্বীকার করে নিতে লজ্জ্বা কেন?
লেখক- মানব বন্দ্যোপাধ্যায়- ঢাকা।