অপ্রকাশিত মরিচঝাঁপি- ইতিহাস কোন ক্ষামা করবে না। দুই যুগের উদ্বাস্তু জীবন শেষে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বাংলাদেশ লাগোয়া সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে শেষ আশ্রয় নিয়েছিলেন।
নির্বাচনে জেতার জন্য উদ্বাস্তুবান্ধব জ্যোতি বসুর বাম দলই তাদের ডেকে এনেছিলো। জ্যোতি বসু খোদ একসময় রিফ্যুজি সমস্যা নিয়ে দেনদরবার করেছেন বিধান রায় সরকারের সঙ্গে, নিজের ভাবনাচিন্তা বাতলেছেন, সম্ভাব্য পুনর্বাসনের রূপরেখা দিয়েছেন যার মধ্যে সুন্দরবনও ছিলো।
‘৭৫সালের ২৫ জানুয়ারি ভিলাইয়ে এক জনসভায় নিজে বলেছেন, সিপিএম পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে, উদ্বাস্তুদের সেখানে নিয়ে যাবে।
ক্ষমতায় আসার বছরখানেক আগে সিপিএম সরকারের মন্ত্রী ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা রাম চ্যাটার্জি সহ কয়েকজনকে দণ্ডকারণ্যে পাঠিয়ে এসব রিফ্যুজিকে পশ্চিমবঙ্গ ফেরার আমন্ত্রণ জানানো হয়।
বলা হয় পশ্চিমবঙ্গের পাঁচ কোটি বাঙালী দশ কোটি হাত তুলে তাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। মালকানগিড়িতে রাম চ্যাটার্জি আবেগঘন বক্তৃতায় বললেন : মাতৃভূমি তোদের দুহাত তুলে ডাকছে, ওরে অবুঝ সন্তান, তোরা ছুটে আয় । মিঠে সেসব মিছে কথাকে সত্যি ভেবে ভুলেছিলো রিফ্যুজিরা।
১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে উদ্বেল হয়ে ওঠে তারা। এবার তারা ফিরতে পারবে, এমন জায়গায় যেখানে তাদের মতো বাংলায় কথা বলে মানুষ। ১৯৭৮ সালের মার্চ নাগাদ সহায় সম্বল যা ছিলো বিক্রি করে দণ্ডকারণ্য থেকে স্বপ্নের এলডোরাডোতে রওয়ানা হয় দেড় লাখ রিফ্যুজি।
কিন্তু সেখানে অপেক্ষায় ছিলো ভিন্ন এক বাস্তবতা। নির্বাচনের আগের বামফ্রন্ট আর ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টের কথাবার্তায় তখন ব্যাপক ফারাক।
বদলে গেছে তাদের পলিসি। নেতারা বললেন, তারা বললেই চলে আসতে হবে নাকি! পুলিশ পিটিয়ে খেদালো অনেককে, জেলে পুরলো অনেককে।
ভাঙা হৃদয় নিয়ে ফিরে এলো অনেকে। কিন্তু মরিয়া কিছু থেকে গেলো। উদ্বাস্তু সমিতি অনেক আগেই খোঁজখবর নিয়ে বসত গড়ার জন্য পছন্দ করে এসেছিলো মরিচঝাঁপি, যার ঠিকানা দিয়েছিলেন বাম নেতারাই।
কলকাতা থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের লাগোয়া ১২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি দ্বীপ। ’৭৮ এর শেষ নাগাদ সেখানে ঠাঁই নিলো ৩০ হাজার সর্বহারা মানুষ।
কিন্তু ক্ষমতায় গিয়েই জ্যোতিবাবুরা ভুলে গেলো প্রতিশ্রুতি। লাখ খানেক উদ্বাস্তুকে ফেরত পাঠালো দণ্ডকারণ্যে। কিন্তু হাজার চল্লিশেক তবু রয়ে গেলো মাটি কামড়ে।
বাঘের কামড় খাবে, তবু দণ্ডকারণ্যে ফিরে যাবে না। দুর্গম দ্বীপ মরিচঝাঁপিতে বসতি গড়লো তারা। সরকারকে সাফ জানিয়ে দিলো, কোনো সাহায্য লাগবে না, শুধু বাধা না দিলেই খুশি।
এদেরও কিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলো। জ্যোতি বসু উদ্বাস্তু নেতাদের বললেন, যাচ্ছো ঠিক আছে, কিন্তু তোমাদের কোনো রকম সহায়তা করা হবে না। যা করার নিজেদেরই করে নিতে হবে।
রিফ্যুজিরা মেনে নিয়েছিলো তা। সরকার একদম সহায়তা করেনি তাও ঠিক নয়। এদের বেকারি এবং ফিশিং লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিলো, যা ছিলো একরকম মেনে নেওয়ারই নামান্তর। সাত মাসের নিরলস পরিশ্রমে সোনা ফলালো রিফ্যুজিরা।
আবাদী জমিতে ফসল ফলানোর পাশাপাশি মাছের ঘের তুলে বছরে ২০ কোটি রূপি সরকারকে লাভ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলো তারা।
মরিচঝাঁপির সাফল্য উঠে এলো গণমাধ্যমেও। নিজেরাই সেখানে গড়ে তুললো জনপদ। রাস্তা তৈরি করলো, নদী থেকে মাছ ধরে খায়, বড় মাছ পেলে পাশের বাজারে বিক্রি করে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিন্তায় নিজেরাই স্কুল বসালো। স্বপ্ন দেখলো নতুন করে।
জ্যোতি বসুর অহমে লাগলো এটাই। কোনো রকম সরকারী সাহায্য ছাড়া, পার্টির আনুকূল্য ছাড়াই একটা জঙ্গলে একদল অশিক্ষিত ছোটজাতের মানুষ স্বনির্ভর হয়ে উঠছে এটা হয়তো তার মার্ক্সবাদের অলিখিত লঙ্ঘন।
এবং এটা উদাহরণ হয়ে উঠলে লালদের জন্য ব্যাপক সমস্যা। নির্দেশ পাঠালেন, এদের জায়গা ছাড়তে হবে। ওজর দিলেন, এরা সুন্দরবনের পরিবেশ নষ্ট করছে, বাঘের অভয়ারণ্য এদের কারণে বিপন্ন!
সব যুক্তিতেই বাকোয়াস্ ছিলো তা। রিজার্ভ ফরেস্টের মানচিত্রে মরিচঝাপির ওই জায়গাটুকু অন্তর্ভূক্ত ছিলো না কোনোকালেই।
সিদ্ধান্তটা সার্বিকভাবে আরেকটু আগেই নেওয়া হয়েছিলো। ‘৭৮এর ১লা জুলাই সিপিএমের রাজ্যকমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো- যেসব উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন, প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে হলেও তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে।
চালালো নারকীয় তাণ্ডব। বামফ্রন্টের শরীকদলের নেতাই যাকে বর্ণনা করেছেন ‘জালিয়ানওয়ালাবাগকেও হার মানানো তাণ্ডব’ বলে!
বাঘ নয়, বামফ্রন্ট সরকারই খেলো তাদের। রাতের আঁধারে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হলো মরিচঝাঁপি থেকে। পাঠিয়ে দেওয়া হলো দণ্ডকারণ্যে আবার।
আর সেই রাতের আঁধারে কতো লোক মারা পড়লো তা কেউ জানে না। অভিযোগ আছে বস্তায় করে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় টাইগার প্রজেক্টে, বাঘের খাদ্য হিসেবে। আর বাকীগুলো ফেলে দেওযা হয় গভীর সমুদ্রে।
উদ্বাস্তুরা যখন মরিচঝাঁপিতে আশ্রয় নিয়েছিলো, তখন পশ্চিমবঙ্গের বাবুরা অনেকেই জানতেন না এসব খবর। কিন্তু অনেকেই জানতেন, খবর রাখতেন। শঙ্খ ঘোষ একাধিক কবিতা লিখেছেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একাধিকবার সশরীরে গিয়েছেন মরিচঝাঁপিতে, আনন্দবাজারে লিখেছেন তাদের দুর্দশার কথা। অনেক সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, মানবাধিকার কর্মীও ছিলেন উদ্বাস্তুদের পাশে।
কিন্তু জ্যোতি বসু সরকার একাই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলেন। ধর্মের বলি হওয়া লাখো বাঙালির কান্নার মরিচঝাঁপি, জ্যোতিবসু সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা আর নৃশংসতার মরিচঝাঁপি, বাঘের মতো মনোবল নিয়ে তবু বেঁচে থাকা বাঙালি হিন্দুর বার বার মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াবার মরিচঝাঁপি, আমাদের খুব অন্তর্গত বেদনা, কান্না আর লজ্জার মরিচঝাঁপি।
সাতচল্লিশে ভারতে নমশূদ্ররা যায় নি। অধিকাংশই থেকে গিয়েছিল পাকিস্তানে। কী নির্মম নির্যাতন সহ্য করে থেকেছে–মারা গেছে–শেষ মেষ চলে গেছে ভারতে–মরিচঝাঁপির মত এলাকায়।
একাত্তরে লবণহ্রদে এই নমশূদ্ররা পশুর চেয়েও অধম জীবন যাপন করেছে। তখন মৃত্যু ছিল নিত্যসঙ্গী।
নমশূদ্রদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে–সবাই। বৃটেন, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ– কে করে নি তাদের সঙ্গে অমানবিক ব্যবহার!
বাম রাজনীতিক জ্যোতি বসুতো সাম্যবাদী নেতা ছিলেন। এইছিলো তাঁর সাম্যবাদের নমুনা।
চারমাসের বিভীষিকা : মরিচঝাঁপির গণহত্যা
১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু উৎখাতের প্রথম পর্যায়। ২৪ জানুয়ারি থেকে শুরু হলো অর্থনৈতিক অবরোধ।
৩০টি লঞ্চ অধিগ্রহণ করে মরিচঝাঁপিকে ঘিরে ফেললো জ্যোতি বসুর পুলিশ। সংবাদমাধ্যমের জন্য জারি হলো ১৪৪ ধারা, মরিচঝাঁপি তাদের জন্য অগম্য এবং নিষিদ্ধ। এ নিয়ে কিছু লেখা যাবে না, বলাও যাবে না।
রিফ্যুজিদের টিউবওয়েল থেকে শুরু করে ক্ষেতিজমি, মাছের ঘের, নৌকা সব নষ্ট করে ফেলা হলো। বৃষ্টির জল ধরে রেখে তা পান করে প্রাণ বাচানো চেষ্টা করছিলো তারা, সেখানে বিষ মেশানো হলো। সে বিষে মরলো অসংখ্য শিশু।
বাইরে থেকে খাবার আনার জো নেই, রসদ পাওয়ার জো নেই। ৩১ জানুয়ারি কিছু মরিয়া যুবক পাশের কুমীরমারি থেকে খাবার আনতে সাঁতরে ব্যারিকেড ভাঙলো। পুলিশের গুলিতে মরতে হলো তাদের ৩৬ জনকে। মানুষ ততদিনে বাঁচার জন্য ঘাস খেতে শুরু করেছে!
বিপন্ন এই মানবিকতায় উদ্বিগ্ন হয়ে পশ্চিমবঙ্গের যারাই সাহায্যের হাত বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছেন, তাদের সে হাত ঠেকিয়ে দিয়েছে বামফ্রন্ট।
সরকারী এবং দলীয় তরফে। জগদ্দরদী মাদার তেরেসা পর্যন্ত জানালেন, আক্রান্ত মরিচঝাঁপিতে কিছু করতে তিনি অপারগ!
সাহায্যপ্রার্থী সুব্রত চ্যাটার্জিকে বললেন, সর্যি উই কান্ট গো, নাইদার উই কান এক্সপ্লেইন হোয়াই উই কান্ট…।
এদিকে অনাহারে মরতে শুরু করেছে মানুষ। যা-তা খেয়ে অসুখে মরছে শিশু এবং বৃদ্ধরা। গুলিতে যাদের মারা হচ্ছে, তাদের লাশ নগদে গুম করে ফেলা হচ্ছে। হয় লঞ্চে তুলে জলে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, নয়তো ডাম্প করা হচ্ছে টাইগার প্রজেক্টে।
বাঘের আহার জোগাতে। জ্যোতি বসু ওদিকে সংবাদ মাধ্যমে বলে চলেছেন- সুন্দরবনে এসব উদ্বাস্তু আসলে সিআইএর চক্রান্ত বাস্তবায়ন করছে, তারা সশস্ত্র ট্রেনিং নিচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে লোক এসে এখানে আশ্রয় নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ঘাত ঘটানোর ষড়যন্ত্র করছে বলে তার কাছে পাকা খবর আছে।
মে মাসের শুরুতে যাকে বলে ফাইনাল অ্যাসল্ট। কাহিনীটা খতম করার সিদ্ধান্ত নিলেন জ্যোতি বসু।
পুলিশের হাত শক্ত করতে যোগ দিলো সিপিএম ক্যাডাররা। পার্টির নির্দেশ বলে কথা! আশেপাশের দ্বীপগুলোতে কঠোর আদেশ জারি হলো- এতদিন যা সাহায্য করার করেছো, খবরদার আর নয়।
১৩ মে মরিচঝাঁপিতে নরক ভেঙ্গে পড়লো। গভীর রাত থেকে সেখানে শুরু হলো বর্বর এক নৃশংসতা। টানা তিনদিন চললো আক্রমণ। নৌকা করে লোক যখন পালাচ্ছে তখন তার ওপর লঞ্চ তুলে দেওয়া হলো।
লাশগুম এবং নৌকা ভাঙার জন্য থাকলো আলাদা পুরষ্কার- নগদ টাকায়। লেলিয়ে দেওয়া পার্টিজান গুণ্ডারা ঘরে ঘরে আগুন দিলো, সামনে যে পড়েছে তার ওপর চললো আঘাত, নারী হলে তাকে হতে হলো ধর্ষিতা।
আগুনে পুড়ে ছাই হলো শ’খানেক শিশু। তাদের তুলে আনার সময়টা দেওয়া হলো না মায়েদের। পলায়নপরদের ওপর গুলি চলছে পুলিশের। দুঃস্বপ্নের একাত্তরই ফিরে এলো মরিচঝাঁপির ওই বাঙালী রিফ্যুজিদের ওপর। তফাৎ এরা ধর্মেও এক, ভাষায়ও।
অবশেষে সাফ মরিচঝাঁপি। সম্পূর্ণ এলাকায় কোনো স্থাপনা নেই যা দাঁড়িয়ে আছে। ধংসস্তুপ কথাটার আক্ষরিক এক প্রদর্শনী চারদিক জুড়ে।
পোড়া ছাইয়ের মাঝে হয়তো উকি মেরে আছে ঘুমের মধ্যেই লাশ হয়ে যাওয়া কোনো শিশুর রোস্ট।
সরকারী নিষেধাজ্ঞার ঘেরে ক্যাজুয়ালটির সঠিক সংখ্যাটা এখনও অজানা। কারো মতো শয়ে শয়ে, কারো মতে হাজারে হাজার।
লাশ জলে ভেসে গেছে, বাঘে খেয়েছে, তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ। সাংবাদিক তুষার ভট্টাচার্য্য তার এক প্রামাণ্যচিত্রে একটা হিসাব দিয়েছেন অবশ্য।
২৪ জানুয়ারি থেকে শুরু অবরোধ থেকে ১৩ মে পর্যন্ত অনাহারে ৯৪ জন এবং বিনা চিকিৎসায় ১৭৭ জন শিশু মারা গেছে। ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা ২৪ জন, মারা গেছেন ২৩৯ জন। অনাহারে আত্মহত্যা করেছেন ২ জন।
আহত ১৫০, নিখোজ ১২৮ জন এবং গ্রেফতার হয়ে জেলে গেছেন ৫০০ জন। অন্যান্য ভাষ্যে সংখ্যাটা কয়েকগুণ। এদের অনেকেই দন্ডকারণ্যে আবার ফিরে গেছেন। কেউবা পালিয়ে কলকাতায় এসে এখন ফুচকা বিক্রি করেন, হকারি করছেন।
অনেকেই জানেন না তার স্বজনদের কে কোথায় আছে, বেচে আছে কিনা মরে গেছে। মেয়েরা হয়ে গেছেন পতিতা!
আরো পড়ুন….