ইমাম হোসেনের নির্মম হত্যা মুসলমানদের জন্য কি শিক্ষা বহন করে?

ইমাম হোসেনের মির্মম হত্যা মুসলমানদের জন্য কি শিক্ষা বহন করে? আজ ‘পবিত্র আশুরা’ বা মহরম। এই দিন নবী নাতি ইমাম হোসাইনকে নির্মমভাবে হত্যা করে তার কাটা মন্ডু বর্শার মাথায় বিদ্ধ করে আনন্দ উল্লাস করা হয়েছিলো।

এই দিনকে তাহলে মুসলমানরা ‘পবিত্র’ বলছে কেন? আসলে একমাত্র শিয়ারা ছাড়া আশুরা পালন করা অন্য মুসলমানদের জন্য রীতিমত অস্বস্তিকর! কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে যাবার মত অবস্থা। এ কারণে ইদানিং আশুরা পালন নিয়ে মুসলমানদের সুন্নি গ্রুপ রীতিমত বিদ্রোহ প্রকাশ করছে।

তারা বলছে আশুরার দিন নবী রোজা রাখতেন, সে হিসেবে আশুরা পবিত্র। প্রকৃতপক্ষে মহরম মাসের এই দশ তারিখে মদিনার ইহুদী রোজা রাখত, সেটি দেখাদেখি মদিনা যাবার পর মুহাম্মদও একই দিন রোজা রাখা শুরু করে। তার মৃত্যুর পর প্রায় ষাট বছর পরে এই মহরম মাসের দশ তারিখেই কারবালা নামক স্থানে হোসাইনকে হত্যা করে খলিফা ইয়াজিদ বাহিনী।

হোসাইনের অনুসারীদের কাছে সেই থেকে মহরম মাসের দশ তারিখ অত্যন্ত বেদনাদায়ক। প্রকৃত পক্ষে এই দিনটি আসলে ইসলামের আসল চেহারা প্রকাশিত হয়ে যাবার একটি অন্যতম ঐতিহাসিক দিন। হযরত মুহাম্মদ ইসলামী শাসন নামের যে খিলাফত সৃষ্টি করেছিলেন সেটি কতখানি বিষবৃক্ষ ছিলো তার অন্যতম ঘটনা ছিলো কারবালার হত্যাকান্ড।

তারো আগে হযরত আলীর হত্যাকান্ডের কথাটা স্মরণ করুন। আলী সেজদা দেওয়া অবস্থায় তাকে হত্যা করেন আবদুর রহমান ইবনে মুলজাম। এই লোক পাক্কা ঈমানদার একজন মুসলমান। কিন্তু খেলাফতের রাজনীতিতে আলীকে হত্যা করতে তার হাত কাঁপেনি। একইভাবে হযরত উমার ও ওসমান খুন হয়েছিলো অপর মুসলমানের হাতে ক্ষমতার রাজনীতিতে। ইসলাম যদি পৃথিবীতে রহমত হিসেবে এসে থাকে তাহলে এই তিনজন কেন অপঘাতে নির্মমভাবে মারা যাবে?

এবার আসি নবীর দুই নাতি প্রসঙ্গে। ইসলাম তো কেবল নামাজকলাম পড়ার ধর্ম না, ইসলাম হচ্ছে ক্ষমতা ও রাজনীতির ধর্মও। এই ক্ষমতার ভাগ চাইতে গিয়ে, সম্পত্তির উত্তরাধিকার দাবী করতে গিয়ে নবী কন্যা ফাতিমা উমারের চাকরের হাতে আঘাত পেয়ে গর্ভপাত হয়ে মারা যান।

হযরত আবু বকরের পুত্রকে বস্তায় ভরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। যারা এই হত্যাগুলো করেছে তারা সবাই নামাজী আল্লাঅলা মুসল্লি মুসলমান ছিলো। ইমাম হোসাইনের মাথা নিয়ে ফুটবল খেলেছিলো বড় বড় সব মুসলমানরা। নবীর প্রিয় এই দুই নাতি বড়জনের নাম হযরত হাসান ইবন আলী।

যিনি ইমাম হাসান নামে মুসলিমদের কাছে সমাদৃত, যাকে বেহেস্তে যুবকদের নেতা নির্বাচন করে গেছেন নবী মুহাম্মদ, তার জীবন ও চরিত্র জানা এ অর্থে গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসলাম একটি সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টি করেছিল যার প্রসাদ চক্রান্তের বলি হয়েছিলেন হযরত আলীর জেষ্ঠ পুত্র ইমাম হাসান ও কনিষ্ঠ পুত্র ইমাম হোসেন।

আরো একটি দিক হচ্ছে, রক্ত-মাংসের এই চরিত্রগুলো ধর্মের অলৌকিক দাবীর সঙ্গে মূর্তিমান কৌতুক যেন! যেমন নবী মুহাম্মদ তার দুই নাতির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন এভাবে, ‘হে আল্লাহ, এ দুজনকে আপনি দোয়া করুন, কারণ আমি তাদের জন্য দুয়া করেছি…’ (ইসলামের ইতিহাস: আদি-অন্ত, অষ্টম খন্ড, মূল: আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকি (র), ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত, পৃষ্ঠা-৭৫)।

ইমাম হাসান বিষক্রিয়ায় ও ইমাম হোসেন কারবালায় খুন হয়েছিলেন। ইমাম হাসানের মৃত্যুটি ছিল করুণ ও অমর্যদাকর। বেহেস্তের যুবকদের নেতার এরকম হীন মৃত্যু কোনভাবেই কাম্য নয়। তাদের নবী সম্মান চেয়েছিলেন, কল্যাণ চেয়েছিলেন আল্লাহ’র কাছে। নবীর সে দোয়ায় কোন কাজ হয়নি।

সবচেয়ে বড় কথা, ইমাম হাসানের মৃত্যু থেকে কোন রূপ শিক্ষণীয় নেই তার ভক্তবৃন্দর। বরং তার ভোগ-বিলাসময় জীবন আর দুঃশ্চিত্রতা ইসলামের জন্য হয়ে উঠেছে চরম বিব্রতকর। ক্ষমতা সম্পত্তি যে রাজশক্তির জন্ম দেয়, যে নীল রক্তের সূচনা করে তা কেমন করে ধর্মীয় আধ্যাত্মিক চেতনাকে ধরে রাখতে পারে সেই প্রশ্ন উঠা যৌক্তিক। ইসলাম খিলাফত ব্যবস্থাকে ধর্ম প্রতিষ্ঠা বলেছে যা আসলে মানুষের ধর্ম চেতনার ঘোর বিরোধী।

ইসলামের আদি সোর্সগুলো জানাচ্ছে এই ক্ষমতা ও সম্পদ ‘বেহেস্তের নেতাকে’ রিপুর দাসে পরিণত করেছিলো। যেমন ইমাম হাসানের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল নারী। হযরত আলী পুত্রের চরিত্র সম্পর্কে কুফার জনগণকে সতর্ক করে বলেছিলেন, তোমরা হাসানের কাছে তোমাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়ো না কারণ সে অতিশয় তালাক দানকারী ব্যক্তি…।

রাতে বাসর ঘর করে পরদিন সকালে তালাক দিয়ে বের করে দেয়া ছিলো হাসানের নেশা। সীরাত গ্রন্থকারদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে হাসানের এই চরিত্রকে ঢেকেঢুকে রাখতে। ইবনে কাসির, বুখারী ব্যাখ্যা করেছেন যে, হাসানের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে লোকজন নবী বংশের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে মড়িয়া ছিলেন বলেই বেচারা হাসানের অনিচ্ছা সত্ত্বে এতগুলো বিয়ে (ইবনে কাসিরের মতে সংখ্যাটা ৮০ উপরে!

এছাড়া অগণিত দাসীবাঁদী তো ছিলেই আল্লার রহমতে!) করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু বিশিষ্ট হাদিস ও সীরাত গ্রন্থকাররা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা করেছিলেন। তারা ভুলে গিয়েছিলেন, তালাক দেয়ার পর ধর্মীয় মতেই আর কোন সম্পর্কই থাকে না স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। কাজেই নবী বংশের সঙ্গে যুক্ত থাকার দাবী এক্ষত্রে খাটে না।

হাসানের এই বিয়ে বিয়ে খেলা যে নারীদের কতখানি ক্ষুব্ধ করেছিল সেটা সীরাত গ্রন্থগুলোতেই পাওয়া যায়। এরকমই একজন মারওয়ান যিনি হাসানকে কাঁচা খেয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন…। (ইসলামের ইতিহাস: আদি-অন্ত, অষ্টম খন্ড, মূল: আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকি (র), ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত, পৃষ্ঠা-৭৩-৮৪)।

ইমাম হাসান যখন অর্থের লোভে খিলাফতের দাবী ছেড়ে দিয়েছিলেন মুয়াবিয়ার কাছে তখন লোকজন তাকে ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন ‘মুমিনদের গ্লাণি’! হাসান আপোষে খিলাফতের দাবী ছেড়ে দিয়েছিলেন এই শর্তে তিনি কুফার বাইতুল মালে (লুট করে কাফেরদের দেশ থেকে আনা রাজস্ব বা গণিমত) রক্ষিত সমস্ত অর্থ তিনি নিয়ে নিবেন।

কুফার রাজকোষে তখন ৫০ লক্ষ দিরহাম ছিল! কল্পনা করুন সে যুগে সেটা কি পরিমাণ অর্থ ছিল! মুআবিয়া এহেন কাপুরুষের দাবী যে হাসতে হাসতে মেনে নিবেন সে তো বলাই বাহুল্য। ৫০ লক্ষ দিরহামের বিনিময়ে গোটা খিলাফতের দাবী ছেড়ে দেন হাসান। এছাড়া বৎসরে ৪ লক্ষ দিরহাম দেয়ার অঙ্গিকারও করেন মুআবিয়া। হাসান যুদ্ধ পোশাক ছেড়ে বাড়ি এসে আমোদপ্রমোদের মেতে উঠেন।

মুআইবয়া তার দেয়া কথা রেখেছিলেন। আমৃত্যু হাসানকে তিনি তার দাবী মত অর্থ দিয়ে এসেছেন। বহু নারী হাসানের গৃহে এসেছে, হাসান বহু বিবাহ করা পুরুষ ছিলেন। অনেকেই তাকে মনে মনে ঘৃণা করতেন। তাকে একাধিকবার বিষ খাইয়ে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল বলে সীরাত গ্র্ন্থ দাবী করে। শেষবার আর শেষ রক্ষা হয়নি।

জা’দা বিনতে আশ’আছ নামের হাসানের একজন স্ত্রী হাসানকে বিষ পান করিয়ে হত্যা করে। কথিত আছে মুআবিয়া জা’দাকে হাসানকে হত্যার বিনিময়ে বিপুল অর্থ-সম্পদ ও খোদ খলিফা পুত্র ইয়াজিতের সঙ্গে বিয়ের অঙ্গিকার করেছিলেন। মুআবিয়া ছিলেন স্বয়ং নবী মুহাম্মদের উপদেষ্টা।

এখানে ‘ইহুদীদের কোন ষড়যন্ত্র’ ছিল না। একইভাবে খলিফা ওসমানকে যারা হত্যা করেছিল তারা গৃহবন্দি ওসমানের ঘরের চারপাশে তাকে অবরুদ্ধ করে তাকবিরের সঙ্গে নামাজ আদায় করত। ওসমানের বুকে তলোয়ার চালানোর সময় তাদের মুখে ছিল ‘আল্লাহো আকবর’ শ্লোগান। একইভাবে ওমর ও আলীকে খুন করেছিল নামাজি আল্লাওয়ালা লোকজনই।

এই দিকগুলো স্মরণে রাখা তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। (ইসলামের ইতিহাস: আদি-অন্ত, অষ্টম খন্ড, মূল: আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকি (র), ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত, পৃষ্ঠা-৭৩-৯৪)।

কারবালায় মহরম মাসের দশ তারিখে ইমাম হোসেইনের মাথা কেটে আসরের নামাজ আদায় করেন মুসলিম জাহানের খলিফা ইয়াজিদের বাহিনী। হাসানের কাটা মাথা ধুলোয় মাখামাখি। ইয়াজিদ বাহিনী সেই কাটা মন্ডু বর্শার মাথায় গেঁথে আনন্দ উল্লাস করতে করতে ইয়াজিদের দরবারে পেশ করে। এই ছিন্ন মস্তকই ইসলাম নামের বিষবৃক্ষের একটি ফল। এরকম ফল এরপর বিগত ১৪০০ বছর পর্যন্ত ফলিয়ে যাচ্ছে।

গোটা মধ্যপাচ্য অশান্তির আগুনে পুড়ছে। আফ্রিকা থেকে উপমহাদেশ, ইউরোপ আমেরিকা যেখানেই ইসলাম উপস্থিত সেখানেই অশান্তির আগুন লেগে আছেই। ইসলামিক সোর্সগুলোই দাবী করছে কথিত ‘বেহেস্তের যুবকদের নেতা’ হাসানকে পানীয়র সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল। হাসানের চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, বিষে হাসানের পেটের নাড়ি-ভূড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

অকল্পনীয় যন্ত্রণায় হাসান মাত্র ৪৭ বছর বয়েসে মারা গিয়েছিলেন। প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক, বেহেস্তের যুবকদের নেতার এহেন করুণ পরিণতির মুজেজাটা কি? কিংবা হাসানের মৃত্যুর মোড়াল স্টোরিটাই বা কি? আজতক কোন ইসলামিস্টদের কাছে ইসলামের খিলাফত যুগে ঘটা একের পর এক খুনোখুনির মানেটা কি- জিজ্ঞেস করেও কোন যৌক্তিক উত্তরটি পাইনি।

প্রকৃত উত্তরটা হচ্ছে, ইসলাম একদিন আরবের বুকে যে ভ্রাত্বি হত্যার আগুন জ্বালিয়েছিল, পিতার বিরুদ্ধে পুত্রকে লেলিয়ে দিয়েছিল, খিলাফতের জন্য যে রক্তের হোলিখেলা শুরু হয়েছিল, সেটাই ফাঙ্কাংস্টাইন হয়ে নিজেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল।

এর একটাই শিক্ষা হতে পারে- ঘৃণা দিয়ে কোন পরিবর্তন সাধিত হলে তার ফল দেরীতে হলেও খারাপই হবে। আজো ইসলামী বিশ্ব যে পরস্পর ঘৃণা ও আত্মঘাতিতে মত্ত সেটা তাদের ধ্বংসের ইঙ্গিত বহন করছে মাত্র…।

লেখক- আনোয়ার পারভেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৮]

আরো পড়ুন…