সিরাজউদ্দৌলার বংশধর যুগলকিশোর রায়চৌধুরী: ইতিহাসের এক অনালোকিত অধ্যায়ের সন্ধানে।

সিরাজউদ্দৌলার বংশধর: যুগলকিশোর রায়চৌধুরী: ইতিহাসের এক অনালোকিত অধ্যায়ের সন্ধানে। মুর্শিদাবাদ নামটা শুনলেই খালি মনে হয় নবাবদের নবাবীর কাহিনী, প্রেম, যুদ্ধ, শপ্রেম, গুপ্তহত্যা, রাজনৈতিক চক্রান্ত, বেইমানি, আত্মত্যাগ এবং বন্ধুত্বের কথা, আর হাজারদুয়ারীর কথা ভেসে ওঠে।কিন্তু তার পাশেই অবহেলায়,

অনেকের অজান্তেই অনেক ইতিহাস আমরা জানতে পারি না। আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, বইতে পড়েছি মুর্শিদাবাদের কথা, পলাশীর যুদ্ধের কথা, শুধু পড়ার জন্য পড়েছি , আবার কেউ গল্প বলে ভুলে গেছি। কিন্তু মনে কিছু প্রশ্ন বরাবরই থেকে গেছে !

মোহনলাল সিরাজউদ্দৌলার পেশকার
মোহনলাল সিরাজউদ্দৌলার পেশকার

কোথায় গেল সিরাজউদৌল্লার বংশধর? তখনকার সামাজিক পরিস্থিতিতে কেনই বা একজন হিন্দু রাজপুত মোহনলাল যুদ্ধের অন্তিম সময়েও মুসলমান প্রভুর প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছিল, যেখানে তৎকালীন সমাজের কাছে চক্ষুশূল সিরাজদ্দৌলা চরিত্রহীন লম্পট এক নবাব বলে পরিচিত?

মোহনলালের কি হয়েছিল? তিনি কি যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হন? তারপর মারা যান ? কিচ্ছু জানা যায়নি।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা বিদেশী রাজবংশগুলির কথা যতটা জানি এটা কিন্তু সেভাবে জানিনা।

১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর যুদ্ধে মিরজাফর ও তাঁর সংগীদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে নবাব সিরাজউদৌল্লার বির্পযয়ের কাহিনী কারো অজানা নয়। ঠিক তেমন বীর সেনানী মীরমদন ও মোহনলালের বিশ্বস্ততার কথাও সবার জানা। 

মোহনলাল ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার একজন পেশকার। প্রভাবের দিক দিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সমান দায়িত্ব পালন করতেন। সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে মোহনলালের সখ্যতা ছিল। মোহনলালের বোনের নাম মাধবী। অসম্ভব রূপবতী এই কন্যাকে সবাই হীরা বলে ডাকতেন।

কাশ্মীর থেকে আগতা হীরার রূপে মুগ্ধ হলেন সিরাজউদ্দৌলা। মোহনলালের বোন হীরার সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার অন্তরঙ্গতা হল, ক্রমে ক্রমে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল! সময়ে অসময়ে সিরাজউদ্দৌলা ছুটে যেতেন হীরার কাছে, তিনি তখন মুর্শিদাবাদেই থাকতেন।

হীরার গর্ভে সিরাজের এক অবৈধ পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করল। যথারীতি হীরার কাছে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন সিরাজউদ্দৌলা। তাঁর ভেতর ভয়ংকর ভয় কাজ করতে লাগল, তিনি জানতেন বৃদ্ধ আলিবর্দি খাঁ এই সংবাদ পেলে ভীষণ ক্রদ্ধ হবেন।

সিরাজউদ্দৌলা হীরাকে সন্তানের কথা গোপন রাখতে বললেন, কোনোভাবেই যেন এই কথা আলিবর্দি খাঁর কানে গিয়ে না পৌঁছায়।

চিন্তামুক্ত হতে পারলেন না সিরাজউদ্দৌলা, পুত্র বড় হচ্ছে, খবর বেশিদিন গোপন রাখা যাবে না। আলিবর্দি খাঁ যে কোনদিন জেনে যাবেন। সিরাজউদ্দৌলা কিছুতেই নিজের অস্থিরতা কাটাতে পারলেন না।

একদিন সকালবেলা সিরাজউদ্দৌলা হীরার কাছে এসে বললেন, “পুত্রকে দাও, পিতা পুত্র ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে আসি!”

খুশি হয়েছিলেন হীরা, তিনি পুত্রকে নতুন কাপড়ে সাজিয়ে তুলে দিলেন সিরাজউদ্দৌলার হাতে।

সিরাজউদ্দৌলা পুত্রকে নিয়ে গেলেন ফাঁকা মাঠের ভেতর, তাকে ঘোড়ার ওপর বসিয়ে বেঁধে দিলেন। তারপর ঘোড়ার শরীরে তীর ছুঁড়ে মারলেন। তীরবিদ্ধ ঘোড়া পিঠের উপর সিরাজউদ্দৌলার পুত্রকে নিয়ে তীব্রবেগে ছুটে চলল!

খবর পেয়ে ছুটে এলেন হীরা, কিভাবে তিনি সন্তানকে বাঁচাবেন? হীরা ছুটে গেলেন ভাই মোহনলালের কাছে।

মোহনলাল নিজের ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন সিরাজউদ্দৌলার ঘোড়া যেদিকে গেছে সেইদিকে।
তীরবিদ্ধ আহত ঘোড়ার নাগাল পেয়ে তিনি ঘোড়া থামালেন। হীরার কোলে ফিরিয়ে
দিলেন তার প্রাণপ্রিয় সন্তানকে।

এই ঘটনায় ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন মোহনলাল, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে যাবেন।

আলিবর্দি খান খবর পেলেন, ঘটনা শুনে থমকে গেলেন আলিবর্দি খান। বহুদর্শী আলিবর্দি খান বুঝতে পারলেন এই সাহসী ও সৎ দেওয়ান সিরাজকে পরিত্যাগ করলে বিপদটা সিরাজেরই। তিনি এই সমস্যার সমাধান করলেন, পরিস্থিতির চাপে হীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল। তার নতুন নাম হলো লুৎফুননেসা আলেয়া (বিতর্কিত)।সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে ইসলামী রীতিতে আলেয়ার বিয়ে হয়ে গেল।

হীরাঝিল এই সিরাজপত্নীর নামেই, এখানে সিরাজ ও হীরার বিয়ে হয়েছিল বলে জানা যায়।
সোনিয়া আমিন আলেয়ার কবর দেখে লিখেছেন, “we stepped into the
last enclosure. Here lies Alibardi Khan, Siraj’s three years old
daughter Ummatul Zahwra and his wife Lufthunnesa Aleya (Mohonlal’s
sister)!”

পলাশীতে মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাবের সেনাবাহিনী যখন বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত, তখন মোহনলাল বুঝতে পারলেন ইংরেজ সৈন্যরা এবার নবাব পরিবারের সবাইকে আটক করবে। তারা সিরাজউদ্দৌলা আর তার বংশধরদের হত্যা করবে।

মোহনলার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চলে এলেন, চারদিকে তখন হৈ হুল্লোড়। আর্তের বাঁচার আকুতি, হত্যা, চিৎকার! মোহনলাল ইংরেজ গুপ্তচরদের বিভ্রান্ত করতে রটিয়ে দিলেন তিনি যুদ্ধে আহত হয়েছেন। মোহনলালের যুদ্ধে জখম হওয়ার খবর দাবানলের মত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল।

মোহনলাল ছুটে গেলেন সিরাজউদ্দৌলার প্রাসাদে। তিনি সিরাজের শিশুপুত্রকে নিয়ে পালালেন। তার সঙ্গে রইল আর দুইজন বিশ্বস্ত সাথী বাসুদেব আর হরানন্দ। তাঁরা পালাতে
পালাতে আশ্রয় নিলেন ময়মনসিংহের বোকাইনগর দূর্গে। সাথী বাসুদেবের কাকা বিনোদ রায়ের কাছে শিশুটিকে রেখে তার নিরাপত্তা বিধান করলেন মোহনলাল।

মোহনলাল সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে ময়মনসিংহের জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বড় ছেলে কৃষ্ণকিশোর চৌধুরীর কাছে গেলেন, তাঁকে ছয় বছরের শিশু সন্তানকে দত্তক নেওয়ার কথা বললেন।

জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর দুই ছেলে, কৃষ্ণকিশোর আর কৃষ্ণগোপাল। ছোট ছেলে কৃষ্ণগোপাল দুইবার বিয়ে করলেও তাঁর কোন সন্তান হয়নি।

কৃষ্ণগোপাল সন্তান দত্তক নিতে রাজি হলেন। কৃষ্ণগোপাল শুধু জিগ্যেস করেছিলেন, “কার সন্তান?”

মোহনলাল শিশুর সত্যিকারের পরিচয় গোপন করে বললেন, “বাসুদেবের কাকা বিনোদ রায়ের দ্বিতীয় সন্তান।”

কৃষ্ণকিশোর কিংবা কৃষ্ণগোপাল কেউ জানতে পারলেন না তাঁরা সিরাজউদ্দৌলার পুত্রকে দত্তক নিচ্ছেন।

কৃষ্ণগোপাল বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। পুত্র দত্তক নেওয়ার অনুষ্ঠানে তিনি জমিদারীর সবাইকে নিমন্ত্রণ জানালেন। পুত্রের নাম রাখলেন যুগলকিশোর রায়চৌধুরী।

মোহনলালের পলাতক জীবনের নানা কাহিনী ছড়িয়ে আছে বাংলায়। ঔপনিবেশিক আমলে সেই খবর সংগ্রহ করার কার এত দায় পড়েছে, বিশেষত লোকটা যখন ইংরেজদের ঘোষিত শত্রু!

স্বাভাবিক ভাবেই অষ্টাদশ শতকের গ্রাম বাংলায় মোহনলাল সম্পর্কিত খবর হারিয়ে যায় নানা কাহিনীর পিছনে, আর সূত্র পরম্পরা না থাকলে ঐতিহাসিক সত্য খুঁজে বের করা যায় না। বইতেও সব লেখা থাকে না।

সংগ্রহের উপায় হয় কিংবদন্তী নানা লোককথা বা চারনকবির গান। সিয়ার উল মুতাক্ষরিনের মতে শত্রুদের হাতে তিনি বন্দী হন, যা ঐতিহাসিক হিল মেনে নেননি।

তাঁর মতে আহত হয়েছিলেন মোহনলাল তবে মৃত্যু হয় অন্যত্র। অধ্যাপক তপনমোহন চট্টোপাধ্যায় তাঁর পলাশীর যুদ্ধে মোহনলাল সম্পর্কে নীরব থেকেছেন।

শুধু লিখেছেন মোহনলাল যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি হননি।নিজেই ইংরেজদের আক্রমন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

পরবর্তীকালে যুগলকিশোর জানতে পারলেন যে তাঁর পিতা সিরাজউদৌল্লা। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর পুত্র প্রাণকৃষ্ণনাথকে অনুরোধ করেন তাঁকে যেন সমাধিস্থ করা হয়, তাই করা হয়েছিল অত্যন্ত গোপনে। সে সমাধি হয় গৌরীপুর এস্টেটে যা যুগলকিশোর নিজে তৈরী করেছিলেন।

এঁরই বংশের ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ন্যাশনাল কাউন্সিলে বিপুল অর্থ দান করেন ১৯০৫ সালে যা পরে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি হয়।

ইতিহাসের এক অনালোকিত অধ্যায়ের সন্ধান দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই:
১। ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়কে I
২। নারায়ন সান্যাল ঐতিহাসিক নন, কিন্তু রূপমঞ্জরী গ্রন্থে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও তথ্য দাখিল করেছেন I
৩। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড:
অমলেন্দু দের সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে বইয়ে এ নিয়ে বিস্তারিত
আলোচনা ও তথ্য আছে I

সৌজন্য-চতুরঙ্গ।
কৃতজ্ঞতাঃ শ্রী Debal Dev Basu

আরো পড়ুন…