মৌলবাদীদের ক্ষমতার কাছাকাছি রাখার কৌশল কতখানি সঠিক ছিলো সামনের দিনগুলিতে তা টের পাওয়া যাবে।

প্রধানমন্ত্রী সম্পত্তিতে মেয়েদের সমান ভাগ দেয়ার কথা বলেছেন। তিনি মন্তব্য করেন শরীয়া আইনের দোহাই দিয়ে মেয়েদের সম্পদ কেড়ে নেয়া হয়। তিনি সরকারকে বলেছেন নারীদের এই বৈষম্য দূর করার ব্যবস্থা নিতে। এই খবরে দেশের ইসলামিক  শক্তিগুলো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম চরমোনাই পীর। তিনি প্রকাশ্যে বাইতুল মোকাররমে সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘নাস্তিক-মুরতাদগিরি দেখালে এদেশ থেকে বের হয়ে দেখাও। এদেশ মুসলমানদের দেশ, বিরানব্বই ভাগ মুসলমানের দেশ। এদেশে ইসলাম নিয়ে চক্রান্ত করলে তার দাঁতভাঙা জবাব দেয়া দেয়া হবে’।

মজার বিষয় হচ্ছে আল্লার আইনের বিরুদ্ধে যিনি সবচেয়ে বেশি সংস্কার করেছেন তিনি ইসলামের অঘোষিত দ্বিতীয় নবী (মুহাম্মদ বলেছিলেন আমার পরে যদি কেউ নবী হত তাহলে সে হতো ওমর) হযরত ওমর। তিনি কুরআনের উত্তরাধিকার আইনের সমস্যা বুঝতে পেরে তার সংস্কার করেছিলেন। আমাদের শ্রদ্ধীয় লেখক হাসান মাহমুদ (শরীয়া কি বলে আমরা কি করি বইয়ের লেখক) সাম্প্রতিক সম্পত্তিতে নারীর সমান ভাগ নিয়ে উঠা বিতর্কে দেখিয়েছেন এরকম সংস্কার ইসলামের শুরু দিকে প্রচুর হয়েছে। হাসান মাহমুদের দেয়া সোর্সগুলো এখানে আমি ব্যবহার করব। কুরআনের আইন যে একজন মানুষের বানানো তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে আইনগুলো যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠে। যদি সত্যিই কোন মহাশক্তিধর কেউ এরকম আইন বানাতো তাহলে সেটা সর্বকালের জন্যই প্রযজ্য হতো। যদিও রোজ হুজুররা চিৎকার করে বলে এই কুরআনের কোন ভুল কেউ হাজার চেষ্টা করলেও ধরতে পারবে না। কিন্তু আমরা এখানে দেখাবো কেমন করে কুরআনের আইন মুসলমানরাই তাদের খিলাফতে সংস্কার করতে বাধ্য হয়েছিলো।

ইসলামি স্কলাররা সব সময় দাবী করেন কুরআনের আইনগুলির মধ্যে কিছু আইন সর্বকালের জন্য কিছু আইন কেবলমাত্র সেই যুগের জন্য গ্রহণীয়। এটি বড় রকমের একটা ধাপ্পাবাজী। কারণ কোন আইনটি সর্বকালের জন্য আর কোন আইন নির্দিষ্ট কালের জন্য এরকম কোন বক্তব্য কুরআনে নেই। কোন তাফসির বা হাদিসেও কুরআনের আইন সম্পর্কে এরকম কোন শ্রেণী ভাগ নেই। এইসব বানানো কথা বলা হচ্ছে কারণ বর্তমানকালে এসে ১৪০০ বছর আগের এক আরব গোত্র পিতার বানানো আইন মারাত্মকভাবে যুগের সঙ্গে সাংঘষিক হচ্ছে। কুরআনের আইনগুলোর বেশির ভাগ ইহুদীদের তাওরাত তালমুদ কেন্দ্রিক আইনের মিশ্রন। এসব আইন বর্তমানে ইহুদীরা তাদের ‘ইহুদী রাষ্ট্র’ ইজরাইলেও প্রয়োগ করেনি। ইজরাইল পরিচালিত হয় শতভাগ গণতান্ত্রিক বস্তুবাদী আইন ও সরকারে। কিন্তু মুসলমানরা অন্ধকারচ্ছন্ন বলেই আজো শরীয়া আইন চায় আর নিজ সম্প্রদায়কে যুগের নিমিত্তে এক কঠিন আত্মযুদ্ধের মধ্যে নিয়ে ফেলে।

মহা জ্ঞানী বিজ্ঞ আল্লাহ নিজেই কুরআনে তার নাযিল করা আয়াত বদলে ফেলেন। লেখকরা যেমন উপন্যাস লিখতে গিয়ে কাটাকুটি করে কোন পরিচ্ছদ বাদ দেন- এ যেন সেরকম ব্যাপার। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান তার কুরআন অনুবাদে লিখেছেন, “ইবনে উমর এই আয়াত পড়িত − ‘তাহাদের সুযোগ ছিল রোজা রাখা অথবা কোন দরিদ্রকে প্রতিদিন খাওয়ানো’ এবং বলিয়াছে এই আয়াতের আদেশ রহিত করা হয় – বুখারী ৩য় খণ্ড ১৭০। (খ) বার্ মাউনাতে যাহারা নিহত হইয়াছিল তাহাদের উপর নাজেলকৃত আয়াতটি আমরা পড়িতাম কিন্তু পরে তাহা বাতিল করা হয় (বুখারী ৪র্থ খণ্ড ৬৯)। (গ) নবীজীর সাথে একান্তে কথা বলতে হলে কিছু সদকা দিতে হবে এ-আয়াতও আল্লাহ পরে রহিত করেন (মুহিউদ্দিন খানের অনুদিত বাংলা-কোরান পৃষ্ঠা ১৩৪৭)।

যে কুরআন লওহে মাহফুজে লেখা হয়ে গিয়েছিলো মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগেই সেই কুরআন কেন বারবার কাটাছেড়া হলো? পরের ব্যাপার আরো বাজে। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর হযরত ওমর যখন খলিফা হন তখন তিনি দুই হাতে কুরআনের আইন লঙ্ঘন করেন। নিজেই কুরআনের আইন সংস্কার করে গেছেন। অথচ লিখিত কুরআনের আয়াত তেমনই থেকে গেছে। যেমন জিজিয়া কর বিষয়ে কুরআনের সুরা তওবার ২৯ আয়াতে স্পষ্ট করে অমুসলিমদের বাধ্যতামূলকভাব জিজিয়া কর দেয়ার কথা আল্লাহ ঘোষণা করেছেন এবং সেই মোতাবেক মুহাম্মদ জিজিয়া গ্রহণ করতেন। কিন্তু “হজরত ওমর (রা:) বিভিন্ন কারণে কিছু ব্যক্তি ও ইরানের এক গোত্রের কাছ থেকে জিজিয়া কর নেননি। তিনি নারী, শিশু, বিকলাঙ্গ, বৃদ্ধ ও যাজকদের কাছ থেকেও জিজিয়া নেয়া বন্ধ করে দেন (বিস্তারিত দেখুন মুহিউদ্দিন খানের অনুদিত বাংলা-কোরান, পৃষ্ঠা ৫৬৭ [হামান মাহমুদ থেকে প্রাপ্ত])।

সুরা মায়দার ৩৮ নাম্বারে চুরি করলে হাত কেটে নেয়ার আইন ওমর বাতিল করেন দুর্বিক্ষের সময়। সুরা মায়দা ৫ নম্বর আয়াতে আহলে কিতাবী যেমন ইহুদী খ্রিস্টান নারীদের মুসলিম পুরুষরা বিয়ে করতে পারবে বলে কুরআনের আইন আছে- সেটাও ওমর বিশেষ ক্ষেত্রে বাতিল করে দেন। স্বয়ং মুহাম্মদ বলে গিয়েছেন, আল্লাহর ইচ্ছায়, যদি আমি কোন ব্যাপারে শপথ করি আর পরে দেখি এর চেয়ে ভাল কিছু আছে তখন আমি যেটা ভাল মনে করি সেটাই করি আর তখন পূর্বেকার শপথ রক্ষার কোন দরকার মনে করি না (সহি বুখারী, বই – ৬৭, হাদিস-৪২৭)। কুরআনে আবার আল্লাহ বলছেন, ‘‘আমি কোন আয়াত রহিত করিলে বা ভুলাইয়া দিলে তাহা অপেক্ষা উত্তম বা সমপর্যায়ের আয়াত আনি’(বাকারা ১০৬), ‘যখন আমি এক আয়াতের স্থলে অন্য আয়াত আনি এবং আল্লাহ যা নাজিল করেন তা তিনিই ভালো জানেন’( নাহ্ল আয়াত ১০১)। এসব ভুরি ভুরি উদাহরণ ইসলামী আইনকে প্রশ্ব বিদ্ধ করে কারণ এত পরিবর্তন কিছুতে সর্বকালের জন্য পালনীয় হিসেবে কুরআন হাদিসের আইনকে মানুষের কাছে দুর্বল করে তোলে। শরীয়া আইনের বা কুরআন হাদিসীয় আইন যুগে যুগে সাংঘর্ষিক হবে কারণ এটাই বৈজ্ঞানিক কারণ যে যুগের প্রয়োজনে মানুষের জীবন বদলে যায়। তাই বোকা ঈশ্বর একটা বই পাঠিয়ে বলে দিলেই হবে না যে এটা দিয়ে চিরকাল মানুষের সমাজ চলবে। ধর্মগুলো যে অচল, ধর্ম এবং ঈশ্বর যে কল্পনা, বদ বাপটার লোকজন নিজেকে ঈশ্বর আল্লার প্রতিনিধি দাবী করে এই আইনগুলি বানিয়েছিলো তাদের স্বার্থ হাসিল করতে- এসব থেকেই এগুলো প্রমাণিত হয়। এসব কারণেই পৃথিবীতে কোন একটি ধর্মীয় আইন আধুনিক যুগের জন্য কার্যকর নেই।

মুসলিমদের জন্য ‘মুসলিম পারিবারিক আইন’ নামের যে মধ্যযুগীয় আইন এখানো মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত আছে যার বড় শিকার নারীরা। এই আইনগুলি সংস্কার নয় বাতিল করে প্রচলিত আধুনিক গণতান্ত্রিক বস্তুবাদী আইনে পরিচালিত হওয়া উচিত। একই দেশে দুই রকম আইন কিছুতে কাম্য নয়। ইসলামী আইন একজন নারীর বিবাহিত জীবনকে করে তুলেছে পতিতাবৃত্তির সমতুল্য। ইসলামি আইন বলে, “স্বামী খাবার, বাসা ও পোশাক দিবে বাধ্য স্ত্রীকে, অবাধ্য স্ত্রীকে নহে। বাচ্চা হইবার সময় ব্যতীত অন্য সময়ে ডাক্তার-ওষুধের খরচ বা সাবান-প্রসাধন কিংবা দিতে স্বামী বাধ্য নহে’’ – (হানাফি আইন হেদায়া পৃষ্ঠা ১৪০ ও শাফি’ আইন এম-১১-৪)। মুহিউদ্দিন খান অনুদিত কোরান পৃষ্ঠা ৮৬৭ – ‘‘স্ত্রীর যে প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করা স্বামীর জিম্মায় ওয়াজিব তা চারটি বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ – আহার, পানীয়, বস্ত্র ও বাসস্থান। স্বামী এর বেশি কিছু স্ত্রীকে দিলে অথবা ব্যয় করলে তা হবে অনুগ্রহ, অপরিহার্য নয়’’ (হাসান মাহমুদ থেকে প্রাপ্ত)।

এই আইন একটি মুসলিম নারীকে পতিতার চেয়ে কি বেশি সন্মান দিয়েছে? দেনমোহর নামের হাস্যকর রক্ষাকবচ কি মুসলিম নারীদের কোন সুবিধা করে দিয়েছে? দেন মোহর একটা লোহার আংটি হলেও চলবে। সেটা দিতে না পারলে কুরআনের কিছু আয়াত পাঠ করা হলেই উসুল হিসেবে দেখানো যাবে। এরকম আয়াত পড়ে দেনমোহর শোধ করে যখন কেউ তালাক দিবে তখন সেই মেয়েটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার জবাব কিন্তু ইসলামে নেই। স্বয়ং হযরতম মুহাম্মদ তার স্ত্রী ৩৫ বছর সয়স্ক সওদাকে তালাক দিতে চেয়েছিলেন ‘বৃদ্ধ’ হয়ে যাওয়ার কারণে। তখন সওদা তার ভাগের রাত কিশোরী আয়েশাকে দেয়ার শর্তে তালাক দেয়া থেকে রেহাই পান। নইলে সওদা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতেন সে কথা ভাবার দায় আল্লার নেই। তবে সওদার তার রাতের ভাগ আয়েশাকে দেয়ার পর কুরআনে সুরা নাযিল হয়, (কোরান ৪.১২৮): “এবং কোন নারী যদি স্বামীর কাছ থেকে অবজ্ঞা বা ফাঁকির ভয় করে, তাহলে তারা তাদের মাঝে কোন বোঝাপড়া স্থির করলে তাতে পাপের কিছুই থাকবে না…”।

সভ্য পৃথিবীর জন্য ধর্মীয় আইন নয়। অসভ্য ইতরদের জন্য ধর্মীয় আইন। সরকার কি পারবে বাংলাদেশের নারীদের জন্য সম্পত্তিতে সমান ভাগ করে দিতে? বিয়ে রেজিস্ট্রি ইসলামিক আইন নয়। কলেমা পড়লেই বিয়ে হয়ে যায় ইসলামিক বিয়েতে। কিন্তু বাংলাদেশসহ বহু মুসলিম দেশে রেজিস্ট্র বাধ্যতামূলক। দেখার বিষয় সম্পত্তিতে সমান ভাগ বাংলাদেশ দিতে পারে কিনা। মৌলবাদীদের ক্ষমতার কাছাকাছি রাখার কৌশল কতখানি সঠিক ছিলো সামনের দিনগুলিতে তা টের পাওয়া যাবে।
Susupto Pathok