সুশ্রুত আর আত্রেয় জন্মেছিলেন একই সময়ে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে। ঋষি
বিশ্বামিত্রের পুত্র ছিলেন সুশ্রুত। প্রমাণ না থাকলেও অনেকে বলেন
ধন্বন্তরীর কাছেই সুশ্রুতের শিক্ষা। ছোটবেলা থেকেই রোগ নিরাময়ের বিষয়ে তাঁর
খুব আগ্রহ ছিল। ধন্বন্তরী ছিলেন কাশী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সেখানকার
পাঠ শেষ করে সুশ্রুত নিজেও ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে যোগ দেন।
আত্রেয় শল্যচিকিৎসার ধারে কাছেও যাননি। সুশ্রুত চিলেন ঠিক উল্টো।
শল্যবিদ্যায় তাঁর অবদানের শেষ নেই। তিনি যে বই লিখেছেন তার নাম ‘সুশ্রুত
সংহিতা’। গবেষকরা নানাভাবে পরীক্ষা করে বলেছেন সুশ্রুতের বই শিষ্যরাই পরে
অনেক পাল্টে দিয়েছেন। বহুকাল আগেই নানাদেশের মানুষ এই বইটির কথা জানত। বহু
দেশের নানা ভাষায় বইটি অনুবাদ করা হয়। প্রথম অনুবাদ হয় আরবি ভাষায়। সময়টা
ছিল আট শতক। বইটির নাম হয়েছিল ‘কিতাব-ই-সুসরুদ’। উনিশ শতকে এই বইটি লাতিন,
জার্মান, ইংরেজি ও আরও নানা ইউরোপিয় ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।
অস্ত্রেপাচার করার জন্য ১২১টি বিভিন্ন যন্ত্রপাতির উল্লেখ রয়েছে এই বইয়ে।
যন্ত্রগুলিকে সুশ্রুত দুভাগে ভাগ করেছিলেন। যেগুলো ভোঁতা, নাম দিলেন
যন্ত্র। আর যেগুলো সরু ও ধারালো তার নাম দিলেন শস্ত্র। যন্ত্র ছিল ১০১ রকম।
শস্ত্র ছিল বাকি ২০ রকম। ছবি দেখলে বোঝা যাবে, কেমন সব নামও রয়েছে আলাদা
আলাদা।
সুশ্রুতের দেয়া যন্ত্রগুলোর নাম হল: মণ্ডলাগ্র ছুরিকা, করপত্র ব্রীহিমুখ,
বৃদ্ধিপত্র, নখ-শস্ত্র, বেতস পত্রক, মুদ্রিকা, উপল পত্র, দন্তশঙ্কু, অরা,
বাড়িশ এষণি, কুঠারিকা, অন্তর্মুখ কাঁচি, সূচী, আতীমুখ, মুদ্রিকা, অর্ধধার,
কুশপত্র, শররীমুখ কাঁচি, ত্রিকুর্চক ইত্যাদি।
শল্যচিকিৎসা শেখার জন্য তখন মৃতদেহ পাওয়া যেত না। শেখার তাহলে উপায়টা কি?
সুশ্রুত উপায় বার করলেন। চামড়ার থলি বা মাছের পটকা জল ভর্তি করে তার উপর
অস্ত্রোপাচার করতে বললেন। শরীরের কোথায় কেমনভাবে অস্ত্রোপাচার করতে হবে,
অস্ত্রোপাচারের পর কোথায় কেমন ভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে সব লেখা রয়েছে
‘সুশ্রুত সংহিতায়’। বহু জটিল রোগের বিবরণও রয়েছে। এমনকী কারও নাক
ক্ষতিগ্রস্ত হলে কি করে সেই নাক সারিয়ে তুলতে হবে তার বিবরণও এই বইয়ে
ভালোভাবে দেওয়া রয়েছে। নাক সারাইয়ের এই উপায়কে বলা হয় রিনোপ্লাস্টি। আজকাল
প্লাস্টিক সার্জারির কথা শোনা যায়, অথচ কতকাল আগেই আমাদের দেশেই এই প্রথার
জন্ম হয়েছিল। একজন চিকিৎসকের কেমন হওয়া উচিত, সুশ্রুত সেকথাও বলে গিয়েছেন।
চিকিৎসকের জ্ঞান সংকীর্ণ হলে কিছুতেই চলবে না। ‘আমি এ রোগের ব্যবস্থা জানি,
ওই রোগের জানি না’, এরকম কথা চিকিৎসকদের কিছুতেই বলা উচিত নয়।
অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব একজন চিকিৎসকের। মাঝে মাঝে কোনো
কোনো রোগ খুবই খারাপ দিকে মোড় নিতে পারে সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকতেই হবে
চিকিৎসককে। সংকীর্ণ জ্ঞানের চিকিৎসককে হাতুড়ে ডাক্তার বলেছেন সুশ্রুত।
বিস্ময়ের কথা কতকাল আগে তিনি বলেছেন, ভুল চিকিৎসার জন্য যদি কারও ক্ষতি হয়,
তবে ক্ষতির পরিমাণ দেখে সেইমতো চিকিৎসকের শাস্তি হওয়া উচিত। তেমন সর্বনাশ
করে থাকলে মৃত্যুদণ্ড দিলেও তিনি দোষের কিছু মনে করছেন না। এই আধুনিক মননের
মানুষটিকে আমরা যথাযথ কারণেই খুব উঁচু আসন দিই।