জ্ঞানের সল্পতা থেকেই বেদের অবজ্ঞা সৃষ্টি। বেদে কি অশ্লীতা রয়েছে ?

আজকাল বেদ বিষয়ে আমাদের সামনে অনেক বিচিত্র তথ্য আসে। বেদের মধ্যে বিভিন্ন শব্দ যেমনঃ ইন্দ্র,মহাবীর,রাম, কৃষ্ণ ইত্যাদি আদি কল্পনা স্বর্গের রাজা ইন্দ্র, জৈন ধর্মের মহাবীর,আর্য রাজা শ্রীরাম,কৃষ্ণ ইত্যাদি। যাহার দ্বারা প্রতীত হয় যে, বেদের মধ্যে ইতিহাস রয়েছে। পশ্চিম বিদ্বানরা বেদ মধ্যে আর্য দ্রবিড়ের যুদ্ধের বর্ণনা খুজে বের করেছেন।যার ফলস্বরূপ বিভিন্ন মতাবলম্বীরা তাদের নিজ নিজ মতের জনক কে বেদের মধ্যে প্রদর্শনের প্রয়াস করে।


শুধু তাই নয় পুরাণে বর্ণিত বিভিন্ন অশ্লিল ভাষ্য বেদের মধ্যে বিভিন্ন পন্ডিত খুজে পেয়েছেন। যেমনঃ প্রজাপতির দুহিতার (কণ্যার) সাথে সমন্ধ্য, ইন্দ্র অহল্লার অবৈধ সমন্ধ ইত্যাদি। যার ফলে বেদ বিদ্বেষীরা আজ বেদ কে অবমাননা করার সুযোগ পায়। এক্ষনে আমরা বেদ মধ্যে হতে কিছু অশ্লীতা দাবী সমীক্ষা করে দেখবো –
.
(i) ঋগবেদ ১।৬৪। ৩৩ এ প্রজাপতি তার দুহিতার (পুত্রীর) মধ্যে গর্ভ উৎপাদন করেন।
এই মন্ত্রের অশ্লিলতা দেখে অনেকে বেদে পিতা কণ্যার অনৈতিক সমন্ধ দেখানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে।
.
মন্ত্রটিতে মূলত অলংকারিক বর্ণনা এসেছে। এখানে প্রজাপতি হচ্ছে সূর্য [ প্রজাপতি বৈ সুপর্নো গুরত্বানেষ সবিতা, শতঃ ১।২।২।৪]। তার দুটি কণ্যা ১ম প্রকাশ ২য় ঊষা। যে দ্রব্য যাহা হইতে উৎপন্ন হয় বলে তাকে উক্ত দ্রব্যের সন্তান বলা হয়। ঊষা যা রাত্রির তিন বা চারঘটিকায় পূর্ব দিশায় রক্তবর্ণ দৃষ্টিগোচর হয় তা সূর্যের কীরণ হতে উৎপন্ন বলে তাকে কণ্যা হয়। ঊষার সম্মুখে সূর্যের যে কিরণ পতিত হয় তাহাতে বীর্য স্থাপন রূপ কার্য হয়ে থাকে। এই দুইয়ের সংযোগ দ্বারা পুত্র অর্থাৎ দিবস উৎপন্ন হয়।
নিরুক্ত ৪।২১ এ বলা আছে, “তত্র পিতা দুহিতু গর্ভং দধাতি পর্জন্য পৃথিব্যা “। অর্থাৎ পিতার যে পর্জন্য অর্থাৎ জলরূপী যে মেঘ তাহার কণ্যা ভাব পৃথিবী হয়ে থাকে। ঐ মেঘ যখন পৃথিবীরূপ কণ্যাতে বৃদ্ধি দ্বারা জলরূপী বীর্য ধারন করে। তখন ঐ পৃথিবী গর্ভবতী হইয়া কিছুকাল থাকিয়া পরে ঔষধাদি রূপ অনেক পূত্র উৎপন্ন করে।
.
(ii) ইন্দ্র ও অহল্যা বিষয়ে একটা কথা খুব প্রচলিত আছে সেটি হলো – ইন্দ্র গৌতম ঋষির স্ত্রীর সহিত ব্যাভিচারে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। যা গৌতম ঋষি জানার পর অহল্যাকে পাষাণ হওয়ার অভিশাপ প্রদান করেন এবং ইন্দ্রকে সহস্র যোনীযুক্ত শরীর হওয়ার অভিশাপ দেন।
.
” ইন্দ্রাগচ্ছেতি। গৌরবস্কন্দিন্নহল্যায়ৈ জারেতি (শতপথ ৩।৩।৪।১৮)” এখানে ইন্দ্র শব্দে সূর্য বুঝায় এবং রাত্রীকে অহল্যা বলা যায় তথা গৌতম চন্দ্র সদৃশ। এস্থলে রুপকালঙ্কার মতে রাত্রীকে চন্দ্রমার স্ত্রী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। চন্দ্রমা নিজ স্ত্রীর সহিত রাত্রীকালে সকল প্রাণীর আনন্দদায়ক হযে থাকে। ইন্দ্র তথা সূর্যের আগমনেই চন্দ্রমার সহিত রাত্রীর শৃঙ্গার ভঙ্গ বা নষ্ট করে দেয়। চন্দ্রমাকে গৌতম এজন্য বলা যায় যে উক্ত চন্দ্রমা অত্যন্ত বেগশালী। এবং রাত্রীকে অহল্যা এই কারনে বলা হয় যে রাত্রীতে দিবসের লয় হয়। পুনরায় সূর্যই রাত্রীর নিবৃত্তকারী এইজন্য সূর্যকে রাত্রীর জার বলে ” আদিত্যোত্রজার উচ্যতে, রাত্রের্জরয়িতা (নিরুক্ত ৩।১৬)।
এইরূপ চমৎকার রূপকালঙ্কার কে অল্পবুদ্ধি ব্যক্তি অনর্থ প্রকাশ করে অশ্লিতার সৃষ্টি করেছে।
.
(iii) কশ্যপ ঋষি সমন্ধ্যে একটি ভ্রম এই যে – মরীচির পুত্র কশ্যপ কে দক্ষ প্রজাপতি তাহার ১৩ টি কণ্যা বিবাহ বিধানে অর্পন করেন। যাহার দ্বারা সমগ্র জগতের সৃষ্টি হলো। অর্থাৎ দিতি হতে দৈত্য, অদিতি হতে আদিত্য, দনু হতে দানব কদ্রু হইতে সর্প ও বিনতা হতে পক্ষী তথা অনান্য জন হতে বানর, তৃণ আদি উৎপন্ন হয়েছে।
.
এগুলো তো বিজ্ঞান বিরুদ্ধ বটেই সঙ্গে অসম্ভবও। একমাত্র ঈশ্বর হতেই সমস্ত কিছু উৎপন্ন হতে পারে। এজন্য পরমেশ্বরকে কূর্ম বলা হয় “স য়ৎ কূর্ম নাম, (শতপথ ৭।৫।১।৫)। এইরুপে পরমাত্মা নিজ জ্ঞাননেত্র দ্বারা সমস্ত কিছু দর্শন করে বলে তাহাকে কশ্যপ বলে। ” কশ্যপো বৈ কূর্ম্মস্তস্মাদাহুঃ সর্বাঃ প্রজাঃ কাশ্যপ্য ইতি (শতপথ ৭।৫।১।৫)। এই কশ্যপ শব্দে পানিনীকৃত অষ্টাধ্যায়ী ব্যকরনের সূত্র মতে অাদ্যান্তক্ষরের বিপর্যয় ঘটিয়া থাকে অর্থাৎ শেষাক্ষর প্রথমে এবং প্রথমাক্ষর শেষে চলে যায় । এ জন্য পশ্যকঃ এই শব্দের আদ্যান্তের বিপর্যয় ঘটিয়া পশ্যক স্থানে কশ্যপ হয়ে গেলো। এজন্য পরমাত্মাকে কশ্যপ বলা যায়।
.
(iv) যজুর্বেদ ১৩।২০ এ অশ্বমেধ যজ্ঞ নিয়ে একটা ভ্রান্তি যে, যজমানের স্ত্রী ঘোড়ার বীর্য নিজ গর্ভে ধারন করবে।
.
মন্ত্রটিতে “বাজী ” শব্দটিকে অনেকে ঘোড়া অর্থে ব্যবহার করে এরকম অনর্থ করেছে। ঐতেরীয় ৩।১৮ এ বাজী অর্থে বলা হয়েছে “ইন্দ্র বৈ বাজী”। এখানে ইন্দ্র পরমঐশ্বর্যযুক্ত রাজা। অশ্বমেধ যজ্ঞ সমন্ধে শতপথ ১৩।২।২।১৬ রয়েছে – ” রাষ্ট্রমশ্বমেধো জ্যোতিরেব তদ্রাষ্ট্রে দধাতি ” রাষ্ট্রমশ্বমেধ শব্দের অর্থ হলো যার দ্বারা রাজ্যের প্রকাশ বা উন্নতি ঘটে। এভাবে রাষ্ট্রে প্রজা এবং রাজা মিলে চতুরপদ অর্থাৎ ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ সিদ্ধির প্রচার করনে সদা প্রবৃত্ত থাকবে। এবং ঐশ্বর্যবান রাজা বীর্য- পরাক্রম ধারন করে রাষ্ট্রকে পরাক্রম প্রদান করবে।
.
(v) মিত্র বরুণ এবং উর্বশী দ্বারা বসিষ্টের উৎপত্তির কথা ঋগবেদ ৭।৩৩।১৭ এ প্রচলিত আছে যে, মিত্র বরুণ উর্বশী অপ্সরা কে দেখে বীর্য স্খলিত হয়ে যায়। এবং সেই বীর্য থেকে ঋষি বসিষ্ট উৎপন্ন হন।
.
বেদের এরুপ অশ্লিল অর্থ কারীর বুদ্ধি নিশ্চয়রূপে ভ্রষ্ট হয়েছে। মিত্র এবং বরুণ হচ্ছে বর্ষার অধিপতি “মিত্রাবরুণ বৃষ্টাধিপতি অঃ ১।২৪।৫। এবং উর্বশী হচ্ছে বিদ্যুৎ এবং বসিষ্ট হচ্ছে বৃষ্টির জল। অর্থাৎ আকাশে যখন শীতল এবং উষ্ণ বায়ু প্রবাহিত হয় এবং বিদ্যুৎ চমকে। তখন অধিকতর বৃষ্টি উৎপন্ন হয়।
.
এরূপ অলংকারীক বর্ণনাকে ভূল অর্থ করে বেদকে কলুষিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে কিছু মুর্খ লোক। কিন্তু বেদ জ্ঞান অত্যন্ত নির্মল এবং পবিত্র। বেদের সকল শব্দ ধাতু থেকে তৈরী অর্থাৎ বেদের শব্দ যৌগিক এবং যোগারুঢ। ধাতুর যতগুলো অর্থ হয় ততগুলো অর্থ ঐ সকল শব্দের হয়ে যায়। রুঢি শব্দ বেদে নেই, এজন্য বেদে বিবিধ বিদ্যার বর্ণনা রয়েছে। একটা সময় বেদ সবাই পড়ার অনুমতি পেতনা। কারণটা ব্যকারণের সঠিক জ্ঞান না থাকলে, এর থেকে জ্ঞানে শাস গ্রহণ করা যায় না। তাই আসুন ব্যকারণ জেনে বেদের গভীর অর্থ বোঝার প্রয়াস করি এবং নিজের তথা অপরের কল্যাণ করি।