ভোলা ময়রা (১৯শ শতক) কবিওয়ালা। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম ভোলানাথ মোদক; কুলগত পেশা মোদক বা ময়রাবৃত্তি। পিতা কৃপারামের মিষ্টান্নের দোকান ছিল কলকাতার বাগবাজারে। ভোলানাথ সামান্য শিক্ষালাভ করে পিতার দোকানে কাজ করতেন। পরে কবিয়ালরূপে খ্যাতি লাভ করলে তিনি ভোলা ময়রা নামে পরিচিত হন।
ভোলানাথের গুরু ছিলেন কবিয়াল হরু ঠাকুর। তাঁর দলে দোহাররূপে ভোলানাথের হাতেখড়ি হয়; পরে দল গঠন করে তিনি স্বাধীনভাবে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কবিগান পরিবেশন করেন। কবির লড়াইয়ে ভোলা ময়রা বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। রাম বসু, বলাই সরকার, যজ্ঞেশ্বর ধোপা, এন্টনি ফিরিঙ্গি, হোসেন খাঁ প্রমুখ ছিলেন তাঁর প্রতিপক্ষ। উপস্থিতবুদ্ধি, চটুল ও আক্রমণাত্মক বাগ্ভঙ্গি, লঘু-গুরু বিষয়বস্ত্ত এবং সস্তা রস-রুচি দ্বারা তিনি শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারতেন। তিনি সাধারণত গুরু হরু ঠাকুর, গদাধর মুখোপাধ্যায়, ঠাকুরদাস চক্রবর্তী প্রমুখের রচিত গান গাইতেন।
কবিওয়ালারা স্বাভাবিকভাবে ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ, ইতিহাস ও সমকাল সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখতেন। ভোলা ময়রার একটি ছড়াগানে বাংলার কোন জেলার কি উত্তম তার একটি চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়:
ময়মনসিংহের মুগ ভালো, খুলনার ভালো কই।ঢাকার ভালো পাতাক্ষীর, বাঁকুড়ার ভালো দইকৃষ্ণনগরের ময়রা ভালো, মালদহের ভালো আম।উলোর ভালো বাঁদর পুরুষ, মুর্শিদাবাদের জামরংপুরের শ্বশুর ভালো, রাজশাহীর জামাই।নোয়াখালির নৌকা ভালো, চট্টগ্রামের ধাইদিনাজপুরের কায়েত ভালো, হাবড়ার ভালো শুঁড়ি।পাবনা জেলার বৈষ্ণব ভালো, ফরিদপুরের মুড়িবর্ধমানের চাষী ভালো, চবিবশ পরগনার গোপ।গুপ্তিপাড়ার মেয়ে ভালো, শীঘ্র বংশলোপহুগলির ভালো কোটাল লেঠেল, বীরভূমের ভালো ঘোল।ঢাকের বাদ্য থামলেই ভালো, হরিহরি বোল
কবিগানের লোকমনোরঞ্জনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভোলা ময়রাকে সমকালের প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করে বলেছেন: ‘বাঙ্গালা দেশের সমাজকে সজীব রাখিবার জন্য মধ্যে মধ্যে রামগোপাল ঘোষের ন্যায় বক্তার, হুতোম প্যাঁচার ন্যায় রসিক লোকের এবং ভোলা ময়রার ন্যায় কবিওয়ালার প্রাদুর্ভাব হওয়া নিতান্ত আবশ্যক।’ উল্লেখ্য যে, রসগোল্লার উদ্ভাবক নবীনচন্দ্র দাস ছিলেন ভোলা ময়রার জামাতা।