বিজিত জনগণের সাংস্কৃতিক ধ্বংসসাধনের উপর এম এ খান লিখেছেন:

বিজিত জনগণের সাংস্কৃতিক ধ্বংসসাধনের উপর এম এ খান লিখেছেন:

…মুসলিম বিজয়ীরা একনিষ্ঠভাবে বিধর্মী বিজিতদের সংস্কৃতি ধ্বংসের কাজে লিপ্ত হন – এ বিশ্বাসে যে, ইসলামপূর্ব ‘জাহিলিয়া’ যুগের সমস্ত চিহ্ন বা সাক্ষ্য মুছে ফেলে তদস্থলে ইসলামের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। (পৃ ২০৮)

এটা একটা সাংঘাতিক বক্তব্য যা বলে যে, ইসলামে ধর্মান্তরকৃতরা তাদের আদি সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য ও সভ্যতাকে ঘৃণা করে; ইসলাম সম্পূর্ণরূপে বিজিত ও ধর্মান্তরিত জনগণের অতীতের সাথে সম্পর্ককে নস্যাৎ করে; এবং এটা ব্যাখ্যা করে: কেন একজন ভারতীয় মুসলিম প্রথমে নিজেকে মুসলিম মনে করে, তারপর ভারতীয় বা অন্য কিছু। বইটি সুস্পষ্ট করে তুলে: কেন একজন সদ্য-ধর্মান্তরিত মুসলিম ইসলামের জন্য নিজ জীবন বিসর্জন দিতে মরিয়া হয়ে উঠে এবং বিস্ফোরকপূর্ণ আত্মঘাতী-কোমরবন্ধ পরে নেয় তারই সম্প্রতি-অতীতের নিস্পাপ সহধর্মীদেরকে গণহারে নিধন করতে। সে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে তার শিকড়, বংশ-পরম্পরা, অতীত ধর্ম ও সম্ভবত তার ভাষা-সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। খানের বইটি অবশ্য পঠিতব্য সেসব মুসলিমদের জন্য, যারা তাদের অতীতকে হারিয়েছে।

লেখক বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ইসলামি আক্রমণ চিত্রায়িত করেছেন, যা শুরু হয় নবি মুহাম্মদের দ্বারা ও চলমান থাকে তার মৃত্যুর পর। প্রধাণত মুসলিম ইতিহাসবিদ-লিখিত খাটি ঐতিহাসিক দলিল থেকে সংগৃহিত তথ্যের ভিত্তিতে খান ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, বলকান অঞ্চল, স্পেন, আফ্রিকা ও ইউরোপে ইসলামের আক্রমণ চিত্রিত করেছেন; সেই সাথে বর্ণনা করেছেন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ইসলামের প্রসার। এসব আক্রমণের বর্ণনা বিস্তারিত ও মনোযোগ আকর্ষণকারী; বহু অজানা তথ্য যুক্ত হয়েছে। এবং বইটি কেবল ইসলামের ইতিহাস নথিবদ্ধ করে নি, বরং বর্তমানকাল পর্যন্ত বিস্তৃত। পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদদের জন্য বইটি ইসলামি জিহাদের ইতিহাসের জন্য একটি মূল্যবান সূত্র হিসেবে কাজ করবে। মুসলিম পাঠকরা নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতির শিকড় অনুধাবনে বইটিকে পাবেন একটি অনন্য সাহিত্যকর্ম হিসেবে, যা তাদেরকে বুঝাতে সহায়তা করবে তারা কেন বা কীভাবে আজ মুসলিম। গবেষক ও লেখকদের জন্য বইটি হবে মূল্যবান তথ্য ও সূত্রের উৎস।

খান ভারত, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ইসলামি আগ্রাসন ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের তুলনা করে দেখিয়েছেন দু’টোই ছিল উপনিবেশবাদি প্রকৃতির – অথচ এসব অঞ্চলের ধর্মান্তরিত মুসলিমরা সেখানে ইসলামের আগমণ বা ইসলামি সাম্রাজ্যবাদকে গৌরবান্বিত করে, যা তাদের পূর্বপুরুষের উপর ইসলামের নিষ্ঠুরতার সাথে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পশ্চিমা শাসন বা সাম্রাজ্যবাদের আগমনকে দেখে দাসত্ব, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও শোষন হিসেবে। লেখক যথার্থ প্রমাণ সহ দেখিয়েছেন যে, পশ্চিমা উপনিবেশীরা ইসলামি দখলদারদের তুলনায় কম দাসত্বের চর্চা ও সহিংসতা করেছে, এবং অনেকক্ষেত্রে বিজিত জনগণের আদি সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে ব্যাহত করে নি। খান জোর দিয়ে বলেছেন যে, ইসলাম দখলকৃত ভুখণ্ডে স্বাধীনতা ও মুক্তি এনেছিল – মুসলিমদের এরূপ ধারনা সম্পূর্ণ ভুল। সত্যটি হলোঃ ইসলাম তাদের পূর্বপুরুষদের জন্য এনেছিল সাংঘাতিক ক্রীতদাসত্ব, অধীনতা, জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, আদি সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে বিনাশকরণ, অমুসলিমদেরকে জিম্মিকরণ, ধর্মীয় নির্যাতন ও গণহত্যা। পশ্চিমা উপনিবেশীরা এরূপ অপকর্ম করেছে কম ক্ষেত্রে বা কম মাত্রায়।

এম,এ,খান তার ইসলামিক “জিহাদ : জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরন এবং দাসত্বের উত্তরাধিকার” বইতে সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন কীভাবে মুসলিম আগ্রাসীরা রক্তঝরা যুদ্ধ, সন্ত্রাস, লুটতরাজ ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের মাধ্যমে ভারতে অনুপ্রবেশ করে ও অগ্রসর হয়। ইসলামি আগ্রাসীরা সুচিন্তিতভাবে তাদের নাগালের মাঝে আসা যুদ্ধ-বয়সী হিন্দুদেরকে হত্যা করে, তাদের ধর্মীয় মন্দির-সৌধ লুটপাট ও বিধ্বস্ত করে, এবং তাদের নারী-শিশুদেরকে ক্রীতদাস হিসেবে কব্জা করে। ক্রীতদাসকৃত সেসব হিন্দু শিশুদের অনেককে মুসলিম ধর্মযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাদেরই ধর্মগোত্রীয় হিন্দুদেরকে নিধনমূলক জিহাদে অংশ নিতে। মুসলিম যোদ্ধারা সন্তান-প্রশব-বয়সী হিন্দু মেয়েদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে যুদ্ধের ‘গনিমতের মাল’ হিসেবে কব্জা করে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে ধর্ষণ করে। এসব অসহায় হিন্দু নারীদের ইসলাম গ্রহণ বিনা কোনো উপায় থাকে না, এবং তারা এভাবে মুসলিম সন্তানের জন্ম দেয়। এ প্রক্রিয়া ভারতে (ও অন্যত্র) ধর্মীয় জনসংখ্যার বণ্টনকে বিশেষভাবে পরিবর্তিত করে; যেমন খান লিখেছেনঃ

সুতরাং মুসলিমরা ভারতের যেখানেই সার্থকভাবে আক্রমণ করেছে, সেখানেই হিন্দু পুরুষদেরকে গণহারে হত্যা ও তাদের নারী-শিশুদেরকে বন্দি করে হিন্দু জনসংখ্যা সরাসরি হ্রাস করেছে৷ পরোক্ষভাবে, সন্তান উৎপাদনক্ষম নারীদেরকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে হিন্দু পুরুষদেরকে যৌনসঙ্গী থেকে বঞ্চিত করে হিন্দুদের বংশবৃদ্ধিতে অন্তরায় সৃষ্টিও হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাস করে৷ যেহেতু হিন্দু পরিবারগুলোর নারীরা পরবর্তিকালে মুসলিম সন্তান জন্মদানের যন্ত্রে পরিণত হয়, সেহেতু গণহারে ক্রীতদাসকরণের চূড়ান্ত ফলাফল দাঁড়ায়: হিন্দু জনসংখ্যার দ্রুত হ্রাস ও মুসলিম জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি৷ আর দ্রুত বর্ধিত এ মুসলিম জনসংখ্যার রক্ষণাবেক্ষণ হতো পরাজিত হিন্দু বা অমুসলিমদেরকে নিষ্পেষিত করা করের মাধ্যমে৷ এটা মূলত সে একই আচরণবিধি, যা নবি মোহাম্মদ বানু কোরাইজা ও খাইবারের ইহুদিদের উপর প্রয়োগ করেছিলেন৷ (পৃ ১২৪)

খান জানান: সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে ইসলামে ধর্মান্তরকরণে এটা ছিল মুসলিম দখলদারদের একটি ইচ্ছাকৃত কৌশল ভারতের ধর্মীয় জনসংখ্যা চিরতরে বদলে দিতে। এ প্রচেষ্টা এতটাই কার্যকর হয়েছিল যে, ভারত আজ দু’টি ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দ্বারা দু’দিক থেকে ঘেরা (অন্যত্র তা আরো বেশী সফলতা পেয়েছে)। যারা আজও পাকিস্তানি-বাংলাদেশী মুসলিমদের শিকড় বা উৎপত্তি সম্বন্ধে ধারনাহীন, খানের বইটি পড়লে বিষয়টি তাদের কাছে স্বচ্ছ হয়ে উঠবে। সত্যি বলতে খানের বইটি আমাকে আমার হিন্দু শিকড় ও ঐতিহ্যকে খুজতে উদ্বুদ্ধ, এমনকি বাধ্য করেছে, যা বইটি পড়লে অন্যান্য মুসলিমদের ক্ষেত্রে ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস।

ভারতে ইসলামের প্রসার মানবতাবাদি মুসলিম সুফি বা পীরদের দ্বারা ঘটেছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে বলে বহুল জনপ্রিয় ধারণাটিকেও খান ছিন্নভিন্ন করেছেন। অকাট্য ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ দ্বারা তিনি দেখিয়েছেন যে, ওসব তথাকথিত সুফি-পীররা মোটেও শান্তিপ্রিয় ছিলেন না। বরং অনেক বিখ্যাত সুফিরা – যেমন খাজা মইনুদ্দিন চিস্তি, নিজামুদ্দিন আউলিয়া ও শাহ জালাল – ছিলেন ভয়ংকর জিহাদি, যারা জিহাদি যুদ্ধ, লুটপাট কিংবা জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণে লিপ্ত হয়েছিলেন।