বাংলাদেশে বাঙালী জাতীয়তাবাদও কেবল মুসলমান জাতীয়তাবাদ।

১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ শহরে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো। শতকরা আশি ভাগ দোকানই ছিলো হিন্দুদের। তখন শেখ মুজিবর রহমান স্কুলের ছাত্র। নিজের বয়ানেই বলছেন তখনকার গোপালগঞ্জের কথা তার আত্মজীবনীতে। লিখেছেন হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে ছিলো তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। অবিভক্ত বাংলায় তখন শেখ মুজিবদের মত বনেদি মুসলমান পরিবারগুলো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের বাংলায় কতখানি সামাজিক প্রভাব বিস্তার করে থাকতেন সেটা স্পষ্ট হয় সুরেন ব্যানার্জীর ঘটনায়। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তার দলবল সুরেন ব্যানার্জী বাড়িতে গিয়ে হামলা করার পর (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-১২) মুজিবের নামে মামলা হয়। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে ইতস্তত করতে থাকে। দারোগা সাহেবের লজ্জ্বা করছিলো শেখ বাড়ির ছেলেকে এসে ধরবে! দারোগা সাহেব চাইছিলো মুজিব যেন সটকে পড়ে তাই তিনি ইচ্ছে করে টাউন হলের মাঠে আলাপ করছিলেন। মুজিবকে তার স্বজনরা পরামর্শ দিচ্ছিল গা ঢাকা দিতে। শেখ মুজিব একগুয়ে ছিলেন। তিনি রাজি হলেন না। মুজিবের বাবা দারোগাকে বললেন, নিয়ে যান। দারোগা শশব্যস্ত হয়ে বললেন, না না ও খেয়েদেয়ে ধীরে-সুস্থে আসুক না…।

এই ঘটনার সামাজিক চিত্রটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা আমাদের যে রাজনৈতিক ইতিহাস দেশভাগকে চিত্রিত করেছে সেখানে অবিরাম বলা হয়, দেশভাগের আগে হিন্দুদের প্রভাব ও আধিপত্যের জোরে মুসলিম সমাজ ছিলো অবিকাশিত। কিন্তু শেখ মুজিব নিজেই জানাচ্ছেন তাদের পরিবার ইংরেজি শিক্ষা আরম্ভ করে ইংরেজ আমলেই। এমন তো না হিন্দুরা মুসলমানদের জন্য লেখাপড়া কঠিন করে রেখেছিলো। বরং ইংরেজ আমলে গ্রামগঞ্জে স্কুল তৈরি করে শিক্ষাকে সর্বসাধারণের কাছে পৌছে দিয়েছিলো হিন্দু জমিদার, বড় সরকারি চাকুরে, ব্যবসায়ীরা। এসব স্কুলে মুসলমান ছেলেরাও ইংরেজি শিক্ষা লাভ করত। তখনকার দিনে শিক্ষকদের ৯৯ ভাগই হতো হিন্দু। শেখ মুজিবের মিশন স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষকও হিন্দু ছিলো। কাজেই পাকিস্তান না হলে অবিভক্ত বাংলায় শেখ পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়া শিখে ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ শিখরে যাওয়াতে কোন ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা ছিলো না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেই ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জের প্রভাবশালী শেখ পরিবারও তখন মনে করছে পাকিস্তান করতে না পারলে মুসলমনাদের ভাগ্যের কোন উন্নতি হবে না। হিন্দুদের সঙ্গে থাকলে তারাই সবটা খেয়ে ফেলবে তাই মুসলমানদের জন্য পৃথক দেশ ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই…। অথচ ১৯৩৭ সালে ঢাকা থেকে খাজা বংশের এগারোজনই এমএলএ হয়েছিলো। ১৯৪৩ সালে খাজা নাজিমউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হোন এবং তার ছোট ভাই খাজা শাহাবুদ্দিন হোন শিল্পমন্ত্রী। তবু সুরেন ব্যানার্জীদের বাংলা ছাড়া না করলে মুসলমানদের নাকি কোন উন্নতি হবে না!

দেখা যাচ্ছে ‘পাকিস্তান’ সৃষ্টির আবহ পুরোটাই রাজনৈতিক ধাপ্পা ছিলো। সেকালের ক্ষমতাধর (শেখ পরিবারকে বলছি না) মুসলমানও রাজনৈতিক প্রচারণায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলো, পাকিস্তান না হলে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না! গরীব চাষাভুষা মানুষের ধর্মীয় পরিচয় কখনই তাদেরকে শাসকের চাবুক থেকে নিস্তার দেয়নি। নবাব আমলে কোন মুসলমান মুটে চাষাভুষা নবাবী করেনি তারই সমগোত্রীয় হিন্দুর উপর। একই কথা ইংরেজ আমলে পাকিস্তান আমল বাংলাদেশ আমলের জন্যও সত্য। দেখা গেছে পাকিস্তান বা মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র না হলে চলবে না- এটি মনে করছিলো সমাজের উচু তলার মুসলমানরাই। তারাই পরবর্তীকালে গরীব সমাজের নিচুতলার মুসলমানদের (যারা একইভাবে উচু তলার মুসলমানদের দ্বারা নিপীড়িত বঞ্চিত ছিলো) বুঝিয়ে ছিলো হিন্দুদের তাড়াতে না পালে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না…।

শিক্ষিত তরুণ শেখ মুজিব কেমন করে দেখতেন পাকিস্তান আন্দোলনকে? তিনি তার আত্মজীবনীতে তার মুসলিম রাজনীতির তখনকার দর্শনের কথা লিখেছেন যা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত তিনি লালন করতেন। তিনি এই দর্শন থেকে সরে এসেছিলেন এমন কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই কেননা পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের যে দাবীগুলো তার কোনটাই ‘পাকিস্তান আদর্শ’ থেকে বিচ্যুত নয়। ছয় দফা’র কোথাও ‘পাকিস্তান’ আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু ছিলো না। শেখ মুজিব দ্বিজাতিতত্ত্ব থেকে সরে এসেছিলেন এমন রাজনৈতিক কর্মসূচী আমাদের দৃষ্টি গোচর হয় না। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গোটা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আগে পরে কোথাও স্পষ্টতর হয়েছে দ্বিজাতি তত্ত্ব বা সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখান করা হয়েছে? দেশভাগের মাধ্যমে চিরতরে পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের ‘সংখ্যালঘু’ করে মেরুদ্বন্ডহীন বানিয়ে রাখা হয়েছে যারা কিনা কখনই রাজনৈতিকভাবে পূর্ববঙ্গে উঠে দাঁড়াতে পারবে না। বাংলাদেশ কি সেই ৭২ সালেও একজন হিন্দুকে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হিসেবে গ্রহণ করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলো?  নাহ্…।

শেখ মুজিবর রহমান লিখেছেন, সিপাহী বিদ্রোহ ও ওহাবী আন্দোলনের ইতিহাসও আমার জানা ছিলো। কেমন করে ব্রিটিশরাজ মুসলমানদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল, কি করে রাতারাতি মুসলমনাদের সর্বস্বান্ত করে হিন্দুদের সাহায্য করেছিল, মুসলমানরা ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিদারি, সিপাহির চাকরি থেকে বিতাড়িত হল- মুসলমানদের স্থান হিন্দুদের দ্বারা পূরণ করতে শুরু করেছিল ইংরেজরা কেন? মুসলমানরা কিছুদিন পূর্বে দেশ শাসন করেছে তাই ইংরেজকে গ্রহণ করতে পারে নাই। সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করত। ওহাবী আন্দোলন কি করে শুরু করেছিল হাজার হাজার বাঙালী মুজাহিদরা? বাংলাদেশ থেকে পায়ে হেঁটে সীমান্ত প্রদেশে যেয়ে জেহাদে শরিক হয়েছিল। তিতুমীরের জেহাদ, হাজী শরীয়তুল্লাহ ফরায়েজি আন্দোলন সম্বন্ধে আলোচনা করেই আমি পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস বলতাম। ভীষণভাবে হিন্দু বেনিয়া ও জমিদারদের আক্রমন করতাম। এর কারণও ছিল যথেষ্ঠ। একসাথে লেখাপড়া করতাম, একসাথে বল খেলতাম, একসাথে বেড়াতাম, বন্ধুত্ব ছিল হিন্দুদের অনেকের সাথে। আমার বংশও খুব সন্মান পেত হিন্দু মুসলমানদের কাছে। কিন্তু আমি যখন কোন হিন্দু বন্ধুর বাড়ি যেতাম তখন অনেক সময় তাদের ঘরে মধ্যে নিতে সাহস করত না আমার সহপাঠীরা। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবর রহমান, পৃষ্ঠা ২২-২৩)

শেখ মুজিবর রহমান অবিসংবাদিতভাবে ‘বাঙালী মুসলমানের’ মহান নেতা। বাঙালী মুসলমানের নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় তিনি সবচেয়ে বড় মন্ত্রকের ভূমিকায় ছিলেন। বাংলাদেশও বাঙালী মুসলমানের দেশ। যেহেতু আশেপাশে আর কোন জাতিসত্ত্বা প্রতিদ্বন্দ্বী নেই তাই সেটি এখন কেবলই মুসলমানের দেশ। বাঙালী জাতীয়তাবাদও তাই কেবল মুসলমান জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশকে সেক্যুলার আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করতে তাই অতিতের কোন রাজনীতির ধারক বাহক হয়ে বাস্তবায়ন সম্ভব না। সেক্যুলার বাংলাদেশ নির্মাণে ভাবিকালের কোন মহান নেতার জন্মের জন্য তাই অবিরাম মুক্তবুদ্ধির চর্চা অব্যাহত রাখাই আপাতত আমাদের ব্রত হওয়া উচিত।