উৎকল নরেশ নরসিংহদেবের বীরত্বঃ

উৎকল নরেশ নরসিংহদেবের বীরত্বঃ
(উল্টো রথের দিনে…. আমার শ্রদ্ধার্ঘ)

১১৯২ সালে মহম্মদ ঘুরির নেতৃিতে দিল্লি অধিকার করেছিল বিদেশী তুর্কি আক্রমণকারীরা, ১১৯৩ সালে বিহারের নালন্দা আর বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় নির্মমভাবে ধ্বংস করেছিল তুর্কি সর্দার বক্তিয়ার খিলজি, ১২০৩ সালে বক্তিয়ার খিলজি প্রায় বিনা বাধায় বিহার আর বাংলা অধিকার করেছিল, নিজেদের তলোয়ারের ফলার ধারে সমগ্র উত্তর আর পূর্ব ভারতে প্রবাহিত করেছিল রক্ত নদীর ধারা। সমগ্র উত্তর আর পূর্ব ভারতে পরপর এতগুলো সহজ জয়ের ফলে বিদেশী তুর্কি আগ্রাসনকারীরা ক্রমশ নিজেদের অপরাজেয় বলে ভাবতে শুরু করেছিল। এই ধারনার বশবর্তী হয়েই তুর্কি আগ্রাসনকারীরা ওড়িশা আক্রমনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর এখানেই তুর্কিরা পেয়েছিল ওদের যোগ্য জবাব, সম্মুখীন হতে হয়েছিল শোচনীয় পরাজয়ের।

ওড়িশা বাসীরা যুদ্ধ বিদ্যায় বরাবরই পারদর্শী। মগধ নৃপতি ধনানন্দ থেকে শুরু করে প্রবল প্রতাপান্বিত বৌদ্ধ সম্রাট অশোকও সহজে ওড়িশা অধিকার করতে সমর্থ হননি। প্রাচীনকালে ওড়িশার নাম ছিল উৎকল অর্থাৎ উত্তম কলা। শিল্পকলায় বরাবরই সহজাত পারদর্শিতা ছিল উৎকলবাসীদের।

১৩ শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন অধিকৃত বঙ্গের তুর্কি সুলতান তুগান খান(তুগ্রিল খান) ওড়িশা আগ্রাসনের সিদ্ধান্ত নিলেন তখন ওড়িশার রাজ সিংহাসনে আসীন উৎকল নরেশ নরসিংহদেব। চতুর এবং মাতৃভূমি প্রেমী রাজা নরসিংহদেব খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে সরাসরি যুদ্ধে বঙ্গের তুর্কি সুলতান তুগান খানের বিশাল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। সরাসরি সমরে গেলে ওঁর অবস্থাও বাংলার হিন্দু নরেশ লক্ষণ সেনের মতই হতে পারে। অতএব নরসিংহদেব তুগান খানের বিরুদ্ধে ছলনা আর ছায়া যুদ্ধের আশ্রয় নেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। এতদিন যে ছলনা আর ছায়া যুদ্ধের আশ্রয় নিয়ে মামুদ গজনী ধ্বংস করেছিল একের পর এক হিন্দু সাম্রাজ্য আর অগণিত মন্দির, একদিন যে ছলনার আশ্রয় নিয়ে মহম্মদ ঘুরি অধিকার করেছিল দিল্লি নগরী আর যে ছলনার আশ্রয় নিয়ে একদা অস্ত্র ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে বিহার আর বঙ্গদেশ অধিকার করেছিল বক্তিয়ার খিলজি।

ওড়িশা আক্রমনের কিছুকাল পূর্বেই অনায়াসে বাংলা অধিকার করতে সমর্থ হয়েছিল তুগ্রিল তুগান খান। তুগান খান পূর্বে দিল্লির সুলতান সামসুদ্দিন ইলতুতমিশের ক্রীতদাস ছিল। ইলতুতমিশ ওকে বিহারের সুবেদার হিসাবে নিয়োগ করেছিল। পরবর্তীকালে তুগান দিল্লির বিশৃঙ্খল শাসন কালের সুযোগ নিয়ে আচমকা বাংলা আক্রমন করে বাংলায় নিযুক্ত দিল্লির শাসক আওার খান আইবককে পরাজিত করে দিল্লির তৎকালীন নারী শাসক রাজিয়া সুলতানার কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে নিজেকে বাংলার স্বাধীন শাসক হিসাবে ঘোষণা করেছিল, পরপর অধিকার করেছিল অসম, বিহার আর অউধ । এরপরই তুগান খান ওড়িশা আক্রমনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

তুগান মনে করেছিল যে ওর বিশাল বাহিনী দেখেই ওড়িশার হিন্দু নরেশ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বেন। সেই অনুযায়ী তুগান নরসিংহদেবকে একটি পত্র দ্বারা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করবার জন্য আহ্বান করেছিল। চতুর দেশপ্রেমিক রাজা নরসিংহদেব তুগানের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব মেনে নিয়ে তাকে জবাবী পত্রে জানিয়েছিল যে তিনিও বাংলা, বিহার আর অসমের শাসকদের মতই বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করতে রাজি আছেন। আত্মতুষ্ট তুগান নরসিংহদেবের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব মেনে তাঁকে হিন্দুদের পবিত্র ধর্মস্থান পুরী শহরে আত্মসমর্পণের শর্ত দিল আর সেইসঙ্গে যোগ করলো আরও কয়েকটি শর্ত। শর্তগুলি হলঃ ১) ওড়িশার হিন্দু বাহিনীকে তাঁদের সমস্ত অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে তুগানের মুসলিম তুর্কি বাহিনীর হাতে, ২) পুরীর সমগ্র জনগনকে শ্রী জগন্নাথদেবের সুপ্রাচীন মন্দিরের গর্ভ গৃহের সামনেই হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে মুসলিম ধর্ম গ্রহন করতে হবে, ৩) আত্মসমর্পণের চিহ্ন হিসাবে পুরীর সমগ্র অবিলম্বে বিশাল অঙ্কের জিজিয়া কর দিতে হবে আর ৪) যত শীঘ্র সম্ভব পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করতে হবে।

শক্তিশালী আত্মতুষ্ট তুর্কি বাহিনীকে খুশি করে তাদের দেওয়া সবকটি অপমানজনক শর্তগুলিই বিনা তর্কে মেনে নিলেন চতুর নরসিংহদেব আর সেইসঙ্গে শুরু করলেন তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁর সুচতুর গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি। আত্মতুষ্ট তুর্কি বাহিনী উদাসীনভাবে বিশাল বাহিনী সমেত অগ্রসর হতে লাগলো পুরী শহরের উদ্দেশ্যে। তারা অনুধাবনই করতে পারল না যে রাজা নরসিংহদেব তাদের স্বাগত জানানোর জন্য শহরের মধ্যেই তাদের জন্য কি ধরনের ফাঁদ পেতে রেখেছেন। ইতিমধ্যেই নরসিংহদেবের নির্দেশে পুরী শহর থেকে স্থান্তরিত করা হয়েছিল সমগ্র তীর্থযাত্রী, বৃদ্ধ এবং শিশু সহ সব নাগরিকদের। তাদের পরিবর্তে পুরী শহরের সাময়িক দখল নিয়েছিল অস্ত্র আর যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী পেশাদার সেনাবাহিনী। ওড়িশার সেনাবাহিনী নাগরিকদের ছদ্মবেশে দখল নিয়েছিল পুরী শহরের সমস্ত রাজপথ,সরু গলিগুলির। পেশাদার যোদ্ধারা গৃহস্থের বেশে আশ্রয় নিয়েছিল শহরের গৃহগুলোতেও।
তুর্কি বাহিনী শহরের মধ্যে প্রবেশ করতেই সরু গলিগুলিতে পথভ্রষ্ট হল। ওরা উপলব্ধি করতে পারল যে অশ্বপৃষ্ঠে আর অগ্রসর হওয়া যাবে না। অতএব ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পদব্রজেই সাবধানে ধীর পদক্ষেপে তুর্কি বাহিনী অবশেষে এসে পৌঁছল জগন্নাথদেবের মন্দিরের নিকটে। এখানেই আর কিছুক্ষণ বাদেই শুরু হতে চলেছে আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান।

মুসলিম বাহিনী মন্দিরের নিকটে এসে উপস্থিত হতেই আচমকা সজরে বেজে উঠল মন্দিরের বিশাল ঘণ্টাগুলি। আসলে এই ঘণ্টাধ্বনিই ছিল ওড়িশার বাহিনীর প্রতি বিদেশী উৎপীড়ক তুর্কি বাহিনীকে পাল্টা আক্রমনের সংকেত। এরপর গগনভেদী জয় জগন্নাথ আর হর হর মহাদেব ধ্বনিতে চতুর্দিক বিকশিত করে তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে মরনপন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লো উৎকল বাহিনী। ভয়ানক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলল সারাদিন ধরে। ক্রমশ সূর্যাস্ত হল। মুসলিম বাহিনী ভেবেছিল যে দিল্লির সম্রাট পৃথ্বীরাজ চৌহানের মত হিন্দু ধর্মের যুদ্ধ নীতি মেনে সূর্যাস্তের পর নিশ্চিতভাবে যুদ্ধ বিরতি দেবে কলিঙ্গসেনা। কিন্তু তাদের সেই আশাতে ছাই ফেলে যুদ্ধ সম্প্রসারিত হল রাতের ঘন আঁধারের মধ্যেও। পুরী শহরের চারিদিক বারংবার কেঁপে উঠল আহত এবং মৃত্যুপথ যাত্রী হিন্দু এবং তুর্কি সেনাদের কাতর আর্তনাদে। যদিও এই ভয়ানক যুদ্ধে ওড়িশা বাহিনীর তাঁদের বেশ কিছু বীর যোদ্ধাদের হারিয়েছিল কিন্তু আক্রমণকারী বহিরাগত মুসলিম সেনাদের অবস্থা হয়েছিল অনেকটা জাতাকলে পরা ইঁদুরদের মত। পুরীর সরু গলিতে পথভ্রষ্ট হয়ে তারা পালানোর পথ খুঁজে পেল না এবং উৎকল বাহিনী তুগান খানের বাহিনীকে বাছাই করে পাল্টা নির্মমভাবে হত্যা করলো। শোনা যায় খুব অল্প সংখ্যক তুর্কি বাহিনীই সেদিনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেঁচে ফিরতে সক্ষম হয়েছিল।

সেদিনের সেই মহাভারতের সময়ের প্রচলিত হিন্দু যুদ্ধ নীতির বাইরে গিয়ে রাজা নরসিংহদেবের এই সাহসী আর অপ্রচলিত যুদ্ধ নীতি আগ্রাসনকারী তুর্কি বাহিনীকে এতটাই বিস্মিত করে দিয়েছিল যে তার ফলে তুগান খানকে নিজের যুদ্ধ জীবনে এই প্রথম এতবড় শোচনীয় পরাজয় আর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তুর্কি বাহিনীর কল্পনার বাইরে ছিল কোন সনাতন ধর্মাবলম্বী নরপতির এই অভূতপূর্ব যুদ্ধনীতি। এর পূর্বে মামুদ গজনী থেকে শুরু করে মহম্মদ ঘুরি আর বক্তিয়ার খিলজি তৎকালীন হিন্দু সম্রাটদের বিরুদ্ধে যে ছল চাতুরীময় যুদ্ধ নীতি গ্রহন করতো, রাজা নরসিংহদেব ওদের বিরুদ্ধে পাল্টা সেই যুদ্ধনীতি গ্রহন করে তুর্কি বাহিনীকে যোগ্য জবাব দিতে সক্ষম হয়েছিলেন আর সেইসাথে সফল হয়েছিলেন হিন্দুদের পবিত্র শহর পুরী আর সুপ্রাচীন জগন্নাথদেবের মন্দিরকে রক্ষা করতে। এরপরও নরসিংহদেব পুনরায় ১২৪৩ সালে কাথির যুদ্ধে, ১২৪৪ সালে লখনউতির যুদ্ধে আর ১২৪৭-১২৫৬ সালের সুদীর্ঘ উমুরদানের যুদ্ধে পুনরায় পরাজিত করেছিলেন তুগান খানের তুর্কি বাহিনীকে।

তুর্কিদের বিরুদ্ধে তাঁর এই মহা সাফল্যের বিজয় স্মারকচিহ্ন হিসাবে নির্মাণ করেছিলেন কনারকের বিখ্যাত সূর্য মন্দির আর ক্ষীরচোরার গোপীনাথের মন্দির। পরবর্তীকালে বিখ্যাত মারাঠা বীর ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ রাজা নরসিংহদেবের এই যুদ্ধ নীতি থেকেই অনুপ্রানিত হয়ে সফলভাবে গ্রহন করেছিলেন তাঁর নিজস্ব অপ্রচলিত গেরিলা যুদ্ধ নীতি। আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয় যে আজ ভারতের কম্যুনিস্ট আর মুসলিম ঐতিহাসিকরা পরম যত্ন সহকারে এই মহান বীর যোদ্ধা ভারতবাসীর নাম মুছে দিয়েছেন আমাদের ইতিহাসের পাঠ্য পুস্তক থেকে।

কৃতজ্ঞতাঃ শ্রী শুভজিৎ রায়…।।