শুরুতে এক প্রজন্মকে কিছু সন্ত্রাসকে বৈধ ও আল্লাহর ইচ্ছা বলে বিশ্বাস করানো হয়েছে।

“জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ১৮০০ জন পাকিস্তানি আলেম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত বই-তে আত্মঘাতী বোমা হামলাকে ‘অনৈসলামিক’ অ্যাখ্যা দিয়ে ফতোয়া জারি করেছেন।” ভালো, দেরিতে হলেও চোখ খোলা ভালো। বাংলাদেশেও মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ-এর নেতৃত্বে একলক্ষ আলেম একই ফতোয়া জারী করেছেন, তাঁদেরকে ধন্যবাদ। পাকিস্তান বহু বছর ধরে ‘ইসলামী’ হিংস্রতায় ক্ষতবিক্ষত। অহরহ সর্বত্র এমনকি মসজিদেও মুসলিম খুন করে চলেছে মুসলিমকে, পরে সেটা আত্মঘাতী বোমা হামলায় ‘উত্তীর্ণ’ হয়েছে। ১৮০০ মাওলানার ওই ফতোয়া সে হিংস্রতা বন্ধ করতে পারবে কিনা সে অঙ্কটা আমাদের করতে হবে কারণ আমাদের  উগ্রপন্থীরা ওদের উগ্রপন্থীদের সাথে শুধু সম্পর্কিতই নয় বরং ওদের সাহিত্য ও দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত। দেশে যা কিছু হচ্ছে তা ওখানে আগে হয়েছে। দেখে না শিখলে প্রাকৃতিক নিয়মেই আমাদেরকে ঠেকে শিখতে হবে।
ইসলামি হিংস্রতার ডোজ মাদকের মত ক্রমাগত বাড়তে থাকে। আত্মঘাতী বোমা হামলা শূন্য থেকে হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি, ওটার জন্ম হয়েছে ধাপে ধাপে বহু বছর ধরে ইসলামের নামে অন্যান্য অজস্র সন্ত্রাসকে ক্রমাগত বৈধ ও প্রতিষ্ঠিত করার পরেই, আগে নয়। এর একটা পরিকল্পিত পদ্ধতি আছে। শুরুতে এক প্রজন্মকে কিছু সন্ত্রাসকে বৈধ ও আল্লাহর ইচ্ছা বলে বিশ্বাস করানো হয়েছে। পরের প্রজন্মকে আরো একধাপ এগিয়ে অন্য কিছু মারাত্মক সন্ত্রাসকে বৈধ ও আল্লাহর ইচ্ছা বলে বিশ্বাস করানো হয়েছে। এইভাবে পুরো জাতটার মন-মগজ সন্ত্রাসের প্রতি শুধু ডি-সেন্সিটাইজড-ই হয়নি, সেগুলোকে বৈধ ও আল্লাহর ইচ্ছা বলে বিশ্বাস করিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আরো এবং আরো হিংস্র হতে হতে আত্মঘাতী বোমাবাজে পরিণত করানো হয়েছে যা কিনা চূড়ান্ত ‘ইসলামী সন্ত্রাস’।
সেই ধাপগুলো চিহ্নিত করলে আমরা আত্মঘাতী বোমা হামলার যে ভিত্তি, তার শাখা প্রশাখা ও বীজ  (জঙ্গী ইসলামী সাহিত্য ও স্কুল কলেজের সিলেবাস সন্ত্রাসের বীজ সম্পর্কে) জানতে পারব।
১. ইসলামে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাস যা থেকে আত্মঘাতী বোমা হামলার জন্ম তার কিছু উদাহরণ। অনেক শারিয়া-দেশে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শারিয়াবাজদের বর্ণনাতীত সন্ত্রাস প্রকাশ পাচ্ছে অহরহ।
(ক) ২০০৩ সালে মুত্তাহিদা মজলিস-এ আমল নামে শারিয়াপন্থী দল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে নির্বাচনে জয়ী হয়, পরে সে দল বেলুচিস্তানের কোয়ালিশন সরকারেও ছিল। সংসদে এরা প্রথমেই বন্ধ করে জুয়া, মদ, বাস-ট্রেনে সঙ্গীত, বিজ্ঞাপন-পোস্টারে নারীর ছবি, বিচিত্রানুষ্ঠানে-রেডিও-টিভিতে নারীর খবর পাঠ, গান ও নাটক, সাথে বন্ধ করা হয় সব সিনেমা হল। বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা ও সঙ্গীত-শিল্পীদের মারপিট করা হয়, ‘প্রাইড অফ পারফরম্যান্স’ খ্যাত গায়ক গুলজার আলমের বাসায় পুলিশ হানা দিয়ে তার হার্মোনিয়াম ভেঙে ফেলে এবং তার তিন ছেলে ও ভাইকে ধরে নিয়ে যায় (পাকিস্তান ডিফেন্স নিউজ – ১০-১২ – ২০০৭)। বাংলাদেশে এঁরা ক্ষমতায় গেলে আমাদের দেখতে হবে- ‘গায়ক নাচকেরা ভাগো সব ভাগোরে, সবাইকে ফেলে দেব বঙ্গোপসাগরে।’
(খ) তার পরেই মুত্তাহিদা মজলিস-এ আমল সংসদ ঘোষণা করে, “ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষার জন্য” আল্ট্রাসাউণ্ড ও ইসিজি পরীক্ষায় রোগিণীরা পুরুষ টেকনিশিয়ানের কাছে যেতে পারবে না। অথচ সারা প্রদেশে ই-সি-জি’র নারী-টেকনিশিয়ান আছে মাত্র একজন, আল্ট্রাসাউণ্ডের একজনও নারী-টেকনিশিয়ান নেই ! সেখানে মা-বোনদের কি অবস্থা তা অনুমান করে নিন। এই তথাকথিত ইসলামী দলগুলো আফগানিস্তানে, ইরাক-সিরিয়া-সোমালিয়া-নাইজিরিয়াতে মানবাধিকারের কি সর্বনাশ করেছে তা তো দুনিয়া দেখছে। ইসলামের ওপর সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত করেছে আর কেউ নয়, এরাই।
(গ) শারিয়া-পুলিশ দেশে দেশে কি বর্বরভাবে মানুষের জান লবেজান করেছে তা বর্ণনাতীত। মক্কার বালিকা-স্কুলে আগুন লাগায় ছাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে আসার সময় তাদের মাথার স্কার্ফ হারিয়ে যায়। বাইরে দাঁড়ানো শারিয়া পুলিশ তাদেরকে পেটাতে পেটাতে আবার স্কুলে ঢুকিয়ে দেয়, বাইরে জনগণ ছুটে এসে সাহায্য করতে গেলে শারিয়া পুলিশ তাদেরকেও পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়। ফলাফল? নিষ্পাপ ফুলের মত যারা ফুটেছিল সেই ১৫ জন বালিকা পুড়ে কয়লা হয়ে যায়, অন্তত: ৫০ জন বালিকা আংশিক পুড়ে যায় (বিবিসি নিউজ ১৫ মার্চ ২০০২)। আহারে! অনেক শারিয়া-দেশে ডাণ্ডা হাতে ঘুরছে ‘ইসলামী’ পুলিশ (হিসবাহ), খুঁটিয়ে দেখছে হেড-স্কার্ফ থেকে কোন মেয়ের চুল বেরিয়ে আছে, কোন মেয়ে কোন ছেলের সাথে বাজারে গেল, পার্কে বসে থাকা স্বামী-স্ত্রীর কাছে নিকাহনামা আছে কিনা – ধরে পেটাচ্ছে বা টেনে হিঁচড়ে বন্দী করছে থানায়, ভয়াবহ দৃশ্য!
(ঘ) ২০০৫ সালে বিবিসির খবরে দুনিয়া শিউরে উঠেছিল যখন ইরানের সরকারী শারিয়া কোর্টে স্ত্রী আবেদন করেছিল তার স্বামীকে আদেশ দিতে, যেন সে তাকে প্রতিদিন না মেরে সপ্তাহে একদিন মারে।