বাংলা সনের প্রবর্তক কে ? সম্রাট আকবর, না রাজা শশাঙ্ক ?

মুসলমান প্রভাবিত এবং মুসলমানদের দ্বারা লিখিত ইতিহাসের কুশিক্ষা
অনুযায়ী আমরা এটাই জানি
যে, সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তক। এর কারণ
হিসেবে বলা হয়, ফসল উঠার সময় জানতে, কর আদায়ের সুবিধার জন্য সে এই সনের
প্রবর্তন করে । আর অনুচ্চারিত কারণ, ইসলামের নবী, বিজ্ঞানীর বিজ্ঞানী
মুহম্মদ এবং তার অনুসারী খলিফা কর্তৃক প্রবর্তিত হিজড়া মাসের কোনো জন্ম
পরিচয়ের ঠিক-ঠিকানা নেই, এই হিজড়া ক্যালেণ্ডার মুসলমানদের রমজান মাস এবং
ঈদের দিন নির্ধারণ করা ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো কাজে লাগে না; তাই সম্রাট আকবর
বাধ্য হয়ে ঐ হিজড়া সালের অবাস্তবতা বুঝতে পেরে, হিজড়া ৯৬৩ সালের সাথে মিল
রেখে, ঐ সালকেই বাংলা ৯৬৩ হিসেবে ঘোষণা ক‌’রে বাংলা সনের চালু করে, কৃষকদের
ফসল তোলার সময় সম্পর্কে জানার সুবিধার জন্য এই সাল চালু হয় বলে একে বলে
ফসলী সন।
যে তিনটি প্রশ্ন করলে এই পুরো থিয়োরি ধ্বসে পড়বে, সেই
প্রশ্ন তিনটি আপনাদেরকে জানিয়ে দেবো এই লেখার শেষে। তার আগে ইতিহাসের
অন্যান্য

আলোচনাগুলো সেরে নেওয়া যাক।
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ এবং সপ্তম
শতকের কিছু সময় বাংলা তথা গৌড়ের রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। ইনি প্রথমে গুপ্ত
সাম্রাজ্যের অধীনস্থ পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা অর্থাৎ বর্তমানের ভারত বাংলাদেশের
বাংলা এলাকার সামন্ত শাসক ছিলেন। ষষ্ঠ শতকের শেষ দশকে, শেষ গুপ্ত সম্রাট,
হীনবল হয়ে পড়লে, শশাঙ্ক, গুপ্ত অধীনতা মুক্ত হয়ে নিজেকে বাংলা তথা গৌড়
রাজ্যের রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। এই ঘটনা ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের এবং সেই বছর
থেকেই বাংলা সনের চালু হয়। এই ব্যাপারে শ্রীসুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়,
‍”বঙ্গাব্দের উৎস কথা‍” শীর্ষক একটি পুস্তিকায় বলেছেন, ‍”সৌর বিজ্ঞান
ভিত্তিক গানিতিক হিসাবে ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল, সোমবার, সূর্যোদয়
কালই বঙ্গাব্দের আদি বিন্দু।‍”
বহুভাষাবিদ রহমতুল্লাহ বাঙ্গালী তাঁর
‍”বঙ্গাব্দের জন্মকথা‍” গ্রন্থেও ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গাব্দের সূচনা এবং
রাজা শশাঙ্কই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক বলে মত প্রকাশ করেছেন।
এখন দেখা যাক, বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে সম্রাট আকবরকে, তারই আমলের রচিত ইতিহাস, তাকে কতটুকু স্বীকৃতি দেয় ?

‍”আইন-ই-আকব” নামে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালের সময়ের একটি বিখ্যাত গ্রন্থ
আছে, কিন্তু এই গ্রন্থে বাংলা সন বা ফসলী সন চালুর ব্যাপারে কোনো কথার
উল্লেখ নেই। কিন্তু আকবর, ১০৭৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ইরানে প্রচলিত ‍”জেলালি
সৌর পঞ্জিকা‍” অনুসরণে ভারতে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ‍”তারিখ-ই-ইলাহী‍” নামে
একটি সৌর পঞ্জিকা চালু করে, কিন্তু কয়েক দশক পর এই ‍”তারিখ-ই- ইলাহী‍”
পঞ্জিকার ব্যবহার সম্পূর্ণরুপে মুখ থুবড়ে পড়ে।
এবার একটু তুলনামূলক
আলোচনায় যাওয়া যাক। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি আকবরের রাজ্যভিষেক
হয়, সেই সময় থেকে বাংলা সন চালু হলে পহেলা বৈশাখ ১৫ এপ্রিল না হয়ে তো ১৪
ফেব্রুয়ারি হতো। তাহলে বর্তমানে পহেলা বৈশাখ ১৪ বা ১৫ এপ্রিল হয় কেনো ?
রাজ্যভিষেকের সময় আকবরের বয়স ছিলো মাত্র ১৩ বছর, সেই সময় কি তার পক্ষে
খাজনা আদায়ের সুবিধার কথা ভেবে, ফসল তোলার সাথে সঙ্গতি রেখে এত
গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্যালেণ্ডার চালু করার আদেশ দেওয়া
সম্ভব ? এর বিপরীতে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে আকবরের ‍”তারিখ-ই-ইলাহী‍”র মতো সৌর
পঞ্জিকা প্রচলন বেশি যুক্তিসঙ্গত; কারণ, ইতোমধ্যে তাকে বেশ কিছুদিন রাজ্য
পরিচালনা করতে হয়েছে এবং আরবী হিজড়া সালের অবাস্তবতা তাকে একটি সৌর পঞ্জিকা
প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছে। তাছাড়া এই সময়ের পূর্বেই, ইরান থেকে নূরজাহানের
পিতা, আকবরের সভায় এসে পড়েছিলো, সুতরাং তার কাছ থেকে ইরানি সৌর পঞ্জিকা এবং
তার কার্যকারিতার বিষয়ে আকবেরর জেনে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
রাজা
শশাঙ্ক প্রবর্তিত বাংলা সনের আদি বিন্দু ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল। পরে
বেশ কয়েকবার পঞ্জিকা সংস্কারের কারণেই মনে হয় এই ১২ এপ্রিল, বর্তমানের ১৪
বা ১৫ এপ্রিলে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু সম্রাট আকবরের নামে চালানো বাংলা সনের
আদিবিন্দু ১৫৫৬ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি তো কিছুতেই ১৫ এপ্রিলে এসে পৌঁছতে পারে
না। যদি বলা হয় যে, পঞ্জিকা সংষ্কারের কারণে ১৪ ফেব্রুয়ারি, বর্তমানের
১৪/১৫ এপ্রিলে পৌঁছেছে, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এই পঞ্জিকা কে, কবে সংস্কার
করলো ?
কোনো ঘটনা ঘটার আগে, সেই বিষয়ে কোনো কথাবার্তা ইতিহাসে থাকা
একেবারে অসম্ভব। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে যদি বাংলা সন চালু হয়, তাহলে তার আগে
বাংলা সন তারিখ ইতিহাসে থাকতে পারে না। কিন্তু আকবরের বহু পূর্বে
প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক, পুঁথি বা বইপুস্তকে বাংলা সন ও তারিখের
উল্লেখ পাওয়া গেছে, এগুলো এলো কোথা থেকে ?
পৃথিবীর সকল সাল শুরু
হয়েছে ১ থেকে এবং এটাই যুক্তিসঙ্গত। তাহলে ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ অনুযায়ী ৯৬৩
হিজরি সালকে ভিত্তি ধরে বাংলা সন চালু করতে হবে কেনো এবং বাংলা সন ১ থেকে
শুরু না হয়ে ৯৬৩ থেকে শুরু হবে কেনো ? আকবর যদি বাংলা সন চালু করেই থাকে,
তাহলে ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দকেই বাংলা ১ সন হিসেবে ধরে হিসেব করতে অসুবিধের কী
ছিলো ?
বাংলা বার ও মাসের নামগুলো এসেছে, ভারতীয় জ্যোতিষ বিজ্ঞানের
দেওয়া বিভিন্ন গ্রহ ও নক্ষত্রের নাম থেকে। রবি, সোম বা বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ-এই
নামগুলো কি আকবরের সময় থেকে ভারতে প্রচলিত হয়েছে, না অনেক আগে থেকেই
প্রচলিত আছে ? যদি আকবরের সময় থেকেই এগুলো প্রচলিত হয়ে থাকে, তাহলে
মহাভারতে উল্লিখিত মহর্ষি জৈমিনী এবং পরে- বরাহ, মিহির, খনার মতো বিখ্যাত
জ্যোতিষীগণ কিভাবে এবং কোন ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী তাদের হিসেবে নিকেশ করতো ?

উপরে অনেকগুলো প্রশ্ন অলরেডি করে ফেলেছি, এবার সংক্ষেপে যে তিনটি প্রশ্ন
করলে আকবরের বাংলা সন চালু করার এই মুসলমানি ইতিহাস সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়বে,
সেই তিনটি প্রশ্ন এবার আপনাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে লেখাটা শেষ করবো। প্রথম
প্রশ্ন, আকবর সমগ্র ভারতের সম্রাট ছিলো, নাকি শুধু বাংলার সম্রাট ছিলো ?
উত্তর হলো, আকবর ছিলো সমগ্র ভারতের সম্রাট। দ্বিতীয় প্রশ্ন, ফসল কি শুধু
বাংলাতেই হতো, না সমগ্র ভারতে হতো ? উত্তর- সমগ্র ভারতেই হতো, এখনও হয়।
তাহলে এখন তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে – সমগ্র ভারতে ফসল হওয়া সত্ত্বেও এবং আকবর,
সমগ্র ভারতের সম্রাট হওয়ার পরেও কেনো শুধু বাংলা এলাকার জন্য সে বাংলা সন
চালু করতে যাবে ? বাংলা ছাড়া অন্যান্য রাজ্যের খাজনা বা কর কি তার প্রয়োজন
ছিলো না ?
প্রথম দুটির দরকার নেই, শেষ প্রশ্নটার উত্তর দিয়ে যাবেন।
মুসলমানদের সঙ্গে বাস করার ফলে আমরাও এই মিথ্যাগুলোকে খেতে এবং তা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি এবং কেউ কেউ এখনও হচ্ছে।

সৌজন্যেঃ চতরঙ্গ
লেকক- Uttam Kumar Das