"রাজত্ব_গিয়েছে_তবু_জেগে_আছে_নাটমন্দির" লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

“রাজত্ব_গিয়েছে_তবু_জেগে_আছে_নাটমন্দির”
লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

প্রচার বা সস্তার চটকদারি কিংবা শহুরে প্যাকেজিং, কিছুই নেই। সম্পদ বলতে ঐতিহ্য এবং আভিজাত্য। আর এ দু’য়ের মিশেলে সে সব পুজোয় আজও মেলে অতীতের সৌরভ। নামে রাজবাড়ির পুজো। যেহেতু এখন সেই রাজত্ব আর নেই, কাজেই রাজা থাকারও প্রশ্ন নেই। সে না থাক! অস্তমিত রাজমহিমার রেশটুকু থাকলেই কাফি! আর সেটুকু আছে বলে পুরনো নহবৎখানা, নাটমন্দির, দালান কিংবা তোরণ আজও ফিসফিস করে বলে ওঠে সে সব পুজোর কাহিনি।

কৃষ্ণনগর_রাজবাড়ি
ইতিহাস অনুযায়ী নদিয়া রাজবংশের আদি পুরুষ ভবানন্দ মজুমদার মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের দেওয়া ফরমানে রাজা হয়েছিলেন। জনশ্রুতি, তিনি অন্নপূর্ণার পুজো করতেন। পরবর্তী কালে এই পরিবারে দুর্গোৎসবের প্রচলন হয়। ভবানন্দের উত্তরপুরুষ রাঘব রায় মাটিয়ারি থেকে রেউই গ্রামে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। পরে মহারাজ রুদ্র রায়ের আমলে এই জায়গার নতুন নামকরণ হয় কৃষ্ণনগর। তিনি ঢাকা থেকে আলাল বক্স নামে এক স্থপতিকে আনিয়ে তৈরি করান চকবাড়ি, কাছারিবাড়ি, হাতিশালা, আস্তাবল, নহবৎখানা এবং পঙ্খ অলঙ্কৃত দুর্গাদালান। রুদ্র রায়ের উত্তরপুরুষ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় মহা সমারোহে এই পারিবারিক পুজো করতেন। তিনিই প্রথম সর্বসাধারণের মধ্যে দুর্গোৎসবের প্রচলন করেন যা পরবর্তী কালে সর্বজনীন পরিচিতি পায়।
রাজবাড়ির পঙ্খ অলঙ্কৃত দুর্গাদালানে অধিষ্ঠান রাজরাজেশ্বরীর। এটাই রাজবাড়ির দুর্গার প্রচলিত নাম। উল্টোরথের পরের দিন পাটপুজোর মাধ্যমে শুরু হয় প্রতিমা নির্মাণের কাজ। প্রচলিত দুর্গা প্রতিমার চেয়ে আলাদা এই মূর্তি। দেবী দুর্গার সামনের দু’টি হাত বড়, পিছনের আটটি হাত আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট। দেবীর গায়ে থাকে বর্ম, এখানে তিনি যুদ্ধের বেশে সজ্জিত। পিছনে অর্ধগোলাকৃতি সাবেক বাংলা চালির এক দিকে আঁকা থাকে দশাবতার, অন্য দিকে দশমহাবিদ্যা। মাঝে থাকেন পঞ্চানন শিব। দেবীর বাহন পৌরাণিক সিংহ। সামনে থাকে ঝুলন্ত অভ্রধারা। প্রতিমার সাজেরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। প্রচলিত ডাকের সাজের চেয়ে আলাদা। একে বলা হয় ‘বেদেনি ডাক’। আগে সোনার গয়না পরানো হত।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের উত্তরপুরুষ সৌমীশচন্দ্র রায় ও অমৃতা রায় জানালেন, আজও পুজোর জন্য গঙ্গা জল আনা হয় নবদ্বীপ থেকে। হোম শুরু হয় শুক্লা প্রতিপদ থেকে, চলে দশমী পুজোর শেষ পর্যন্ত। পুজোয় ভোগেরও বৈচিত্র রয়েছে। তিন দিনই থাকে খিচুড়ি, ভাজা, তরকারি, চাটনি এবং সুজির পায়েস। এ ছাড়া সপ্তমীতে সাত রকম ভাজা। অষ্টমীতে পোলাও, ছানার ডালনা, ভাত, আট রকম ভাজা, ক্ষীর। নবমীতে ভাত, নয় রকম ভাজা, তিন রকম মাছ, ইত্যাদি। আর শীতল ভোগে থাকে লুচি, ভাজা, তরকারি ও সুজি।
আজও রাজবাড়ির সন্ধিপুজো দেখতে ভিড় করেন অসংখ্য মানুষ। প্রথা মতোই থাকে ১০৮টি পদ্মফুল ও ১০৮টি প্রজ্বলিত প্রদীপ। দশমীর দিন হয় যাত্রামঙ্গল অনুষ্ঠান, তাতে রাজ পরিবারের সদস্যদের দর্শন করতে হয় বিশেষ কিছু জিনিস। যেমন ‘সবৎস্য ধেনু’, ‘বৃষ’, ‘গজ’, ‘ঘোড়া’, ‘নৃপ’, ‘গণিকা’ ইত্যাদি। এ ছাড়া দশমীর অন্য আকর্ষণ সিঁদুর খেলা। দূরদূরান্ত থেকে বহু সধবা আসেন রাজরাজেশ্বরীকে সিন্দুর দিতে। তার পরই হয় সিঁদুর খেলা। প্রতিমা নিরঞ্জনের পরে পুরনো প্রথা অনুসারে গৃহকর্তা বোধনের বেলতলায় কাঁচা মাটির তৈরি শত্রুর প্রতীকী মূর্তি তীর-ধনুক দিয়ে বধ করেন। অতীতে রাজা যেমন শত্রু বধ করে দেশের সকলকে রক্ষা করতেন, এই প্রথার মধ্যে দিয়ে সেই তাৎপর্যটি তুলে ধরা হয়।

শোভাবাজার_রাজবাড়ি
পলাশির যুদ্ধের পর ১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে পুজো শুরু করেন মহারাজ নবকৃষ্ণ দেব। শোনা যায় বাড়িটি আগে ছিল শোভারাম বসাকের। পরবর্তী কালে বাড়িটির মালিক হন রাজা নবকৃষ্ণ। সে বছর পুজোর আগেই তিনি বাড়িটির আমূল পরিবর্তন করেন। দিল্লি থেকে স্থপতি এনে তৈরি করান এ বাড়ির নাচঘর, ডিনার রুম, দেওয়ানখানা ইত্যাদি। কেননা সে বছর তাঁর পুজোয় বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বয়ং লর্ড ক্লাইভ। তিনি তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি। হাতির পিঠে চেপে এ বাড়ির পুজো দেখতে এসেছিলেন তিনি। পরের বছরই ক্লাইভ বাংলার গভর্নর হয়েছিলেন। শোনা যায় সে সময় সপ্তমীর সকালে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে পাঠানো ‘স্কচ হাইল্যান্ড ব্যান্ডের’ সঙ্গে গঙ্গাস্নানে গিয়েছিল নবপত্রিকা। শুধু পুজো দেখিয়ে যে ক্লাইভ এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের তুষ্ট করা যাবে না সে কথা নবকৃষ্ণ জানতেন। তাই সাহেবদের তুষ্ট করতে তিনি খানাপিনা, আমোদ-প্রমোদের এলাহি আয়োজন করেছিলেন। পুজোর তিন দিন গভীর রাত পর্যন্ত চলেছিল সে খানাপিনা এবং ভোজ। আর বাঙালিদের জন্য ছিল যাত্রাপালা, তর্জা আর কবিগান। সে কালে এই পুজোয় আমন্ত্রিত পাদ্রী ওয়ার্ড সাহেব লিখেছিলেন “চক্মিলান প্রাসাদের মাঝখানে উৎসব প্রাঙ্গণ। সামনে পূজা মন্ডপ। পূর্বদিকের একটি ঘরে সাহেবিখানার বিপুল আয়োজন। হিন্দু নর্তকীদের নাচ গান চলছে। চারদিক ঘিরে কোম্পানির বাঘাবাঘা সাহেব-মেম অতিথিরা কৌচে বসে মৌজ করে তা দেখছেন।”
পুরনো প্রথা অনুসারে আজও সাবেক একচালার মূর্তি। বোধন হয় কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে। পৌরাণিক ঘোটক আকৃতির সিংহ। এই পরিবারের আরতি দেব জানালেন, রথের দিন হয় কাঠামো পুজো। তার পরে শুরু হয় মূর্তি তৈরি। পুজোয় অন্ন ভোগ হয় না। তবে তৈরি হয় নানা রকমের মিষ্টি। যেমন খাজা, গজা, নারকেল ছাপা ইত্যাদি। আর থাকে নারকেল ও ক্ষীর দিয়ে তৈরি বিশেষ এক ধরনের মিষ্টি যার নাম ‘আদা’। তা ছাড়া চাল ও ফলের নৈবেদ্য থাকে। আগে বাড়ির মহিলারা পর্দার আড়ালে বসে দেবী দর্শন করতেন। তবে সাবেক আচার অনুষ্ঠান আজও অটুট। ভোরে হয় মঙ্গল আরতি। সন্ধেবেলা দেওয়া হয় মাখন মিছরি ভোগ। দশমীর দিন হয় কনকাঞ্জলি।
রাজা নবকৃষ্ণের সাত রানির সন্তানাদি না হওয়ায় তিনি দাদার ছেলে গোপীমোহনকে দত্তক নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৭৮২ সালে তাঁর সপ্তম স্ত্রীর গর্ভে রাজকৃষ্ণের জন্ম হয়। আর সে কারণেই নবকৃষ্ণের সম্পত্তি দু’ভাগ হয়েছিল। নবকৃষ্ণের আদি বাড়ির বিপরীতে রাজকৃষ্ণের জন্য তৈরি হয়েছিল নতুন এক প্রাসাদ। সেখানে ১৭৯২ থেকে আদি বাড়ির রীতি রেওয়াজ মেনেই শুরু হয় দুর্গাপুজো। রাজা রাজকৃষ্ণের পরিবারের প্রতিমাও একচালার, সাবেক রীতির। আজও এই দুই পরিবার পুজোর সাবেক ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।

ভূ_কৈলাস_রাজবাড়ি (খিদিরপুর)
‘পতিতপাবনী পরা, পরামৃত ফলদায়িনী স্বয়ম্ভূশিরসি সদা সুখদায়িনী’। পতিতপাবনীকে দেখে এই গানটি গেয়ে উঠেছিলেন সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন। এমনটাই কিংবদন্তি। তিনিই এই স্থানটির নামকরণ করেন ভূ-কৈলাস। খিদিরপুর ট্রামডিপোর কাছে ভূ-কৈলাস রাজবাড়ির মধ্যে রয়েছে পতিতপাবনী দুর্গা মন্দির। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে রাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল তাঁর প্রাসাদের মধ্যেই পতিতপাবনীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগে তিনি শিবগঙ্গা নামে এক দিঘি খনন করান এবং তার উত্তর ও পূর্ব ভাগে দু’টি শিবমন্দির নির্মাণের পরে সেখানে রক্তকমলেশ্বর ও কৃষ্ণচন্দ্রেশ্বর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন ১৭৮১ সালে। দেবীর বিগ্রহ অষ্টধাতুর, পৌরাণিক সিংহের উপর তাঁর অধিষ্ঠান। দুর্গোৎসবের সময় বিশেষ পুজো করা হয়। বিভিন্ন পুজোয় দেবীকে নানা রূপে সাজানো হয়। যেমন ঝুলন ও জন্মাষ্টমীতে কৃষ্ণ রূপে, কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মী রূপে এবং অমাবস্যায় কালী রূপে। এই মন্দিরটি বাংলার দালান রীতিতে বানানো হয়েছিল।

# আন্দুল_রাজবাড়ি (হাওড়া)
১৭৭০ সালে এ বাড়ির পুজোর প্রচলন করেন রাজা রামলোচন রায়। ইতিহাস অনুযায়ী, লর্ড ক্লাইভের দেওয়ান রামলোচন রায় আটটি মৌজার জমিদারি পান। এ ছাড়াও তৎকালীন মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন ‘রাজা’ উপাধি। সে কালে মহা সমারোহে পুজো এবং অতিথিদের আপ্যায়ন করা হত। পুরনো প্রথা মেনে আজও ডাকের সাজের সাবেক প্রতিমা হয়। আগে পুজোয় মোট আট বার তোপধ্বনি করা হত। বর্তমানে তা বন্ধ। পুজো হয় শাক্ত মতে। তাই আগে মহিষ ও পাঁঠা বলি হত পুজোয়। বর্তমানে পশুবলি বন্ধ। তবু সাবেক ঐতিহ্য আজও চলছে।

# বিষ্ণুপুর_রাজবাড়ি
কিংবদন্তি অনুযায়ী, মল্লরাজ জগৎমল্ল তৎকালীন রাজধানী প্রদ্যুম্নপুর থেকে শিকার করতে গিয়ে গভীর অরণ্যে পথ হারিয়ে দেবী দুর্গার দর্শন লাভ করেছিলেন। যে জায়গায় তিনি দেবীর দর্শন পেয়েছিলেন, সেখানেই দেবী মৃন্ময়ীর মূর্তি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে। এই অঞ্চলেরই নাম বন বিষ্ণুপুর। পরে এই মন্দির সংলগ্ন এলাকাতেই তিনি রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
প্রচলিত সাবেক মূর্তির চেয়ে আলাদা এই প্রতিমা। দেবীর পাশে, উপরে থাকে কার্তিক ও গণেশ। নীচে লক্ষ্মী ও সরস্বতী। কাঠামোর উপরে থাকেন মহাদেব। তার পাশে নন্দী, ভৃঙ্গী এবং ভূত-প্রেত। তার ঠিক নীচে আঁকা থাকে দশমহাবিদ্যার দশটি রূপ।
এই পুজোর কিছু ব্যতিক্রমী আচার অনুষ্ঠান রয়েছে। মৃন্ময়ী দেবীর পুজো ছাড়াও দুর্গোৎসবে পূজিত হয় একাধিক দুর্গাপট। যেমন বড় ঠাকরুণ, মেজ ঠাকরুণ, ছোট ঠাকরুণ এবং অন্যান্য ধাতু নির্মিত দুর্গাপট। জীতাষ্টমীর সন্ধ্যায় হয় বড় ঠাকুরানির বিল্ববরণ অনুষ্ঠান। পরের দিন নবমী তিথিতে গোপালসায়রের ঘাটে বড় ঠাকুরানির পট, রাজবাড়ির রৌপ্য পট এবং নবপত্রিকার বিশেষ পুজোর পরে মৃণ্ময়ী মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। সেই দিন থেকেই ১৯ দিনের দুর্গোৎসবের সূচনা। এর পরে চতুর্থী তিথিতে গোপালসায়র থেকে জল ভর্তি করে এনে প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি ঘট। এ দিন মেজঠাকুরানি পটের পুজো করা হয়।
ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় ছোট ঠাকুরানির পট বেলতলায় রেখে পুজো করা হয়। বড় ঠাকুরানি ও ছোট ঠাকুরানির দুর্গাপট বংশানুক্রমে আঁকেন শাঁখারিপাড়ার ফৌজদার পরিবারের শিল্পীরা। সপ্তমীর দিন সকালে রাজবাড়ি থেকে মন্দিরে আনা হয় একটি সোনার পাতে আঁকা দুর্গা পট। তার প্রচলিত নাম ‘পটেশ্বরী’। শুরু হয় বিশেষ স্নান পর্ব ও সপ্তমী পুজো। অষ্টমীর পুজো বিশেষ জাঁকজমকপূর্ণ। এখানে সন্ধিপুজো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সে দিন রাজবাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয় অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডার বিগ্রহ। প্রথা অনুসারে আসেন রাজপরিবারের সদস্যেরা। পুষ্পাঞ্জলির পরে হয় তোপধ্বনি। নবমীর মধ্য রাতে মহামারীর দেবী খচ্চরবাহিনী-র বিশেষ পুজো হয়। পুরোহিত ঘটের দিকে পিছন ফিরে বসে এই পুজো করে থাকেন। এই সময় মন্দিরে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ।
জনশ্রুতি, এক সময় মৃন্ময়ীদেবীর সামনে নরবলি হত। তবে মল্লরাজ বীর হাম্বির বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করার পরে নরবলি তথা সর্ব প্রকার বলিদান নিষিদ্ধ হয় এখানে। মৃন্ময়ীদেবীর বিসর্জন হয় না। দশমীর দিন প্রথা অনুসারে নবপত্রিকা এবং অন্যান্য আঁকা পট বিসর্জন দেওয়া হয়।

বৈকুণ্ঠপুর_রাজবাড়ি (রায়কতপাড়া, জলপাইগুড়ি)
দুর্গার পাশেই থাকেন কার্তিক ও গণেশ। আর তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মী-সরস্বতী এবং জয়া-বিজয়া। এমনই বিচিত্র এই রাজবাড়ির দুর্গাপ্রতিমা। দুর্গার গায়ের রং লালচে। এই পুজোকে বলা হত দুর্গাধিপতিদের দুর্গোৎসব।
রাজা ধর্মদেব জলপাইগুড়ি জেলার করলা নদীর তীরে স্থাপন করেছিলেন বৈকুণ্ঠপুর-রায়কত রাজবংশের রাজধানী। রায়কতরা ছিলেন শাক্ত। পরবর্তী কালে সাড়ম্বরে প্রচলিত হয় এই দুর্গোৎসব। নানা ভাবে এই উৎসব ব্যতিক্রমী। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত ‘জলপাইগুড়ি জেলা শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ’-এ চারুচন্দ্র সান্যাল এই দুর্গোৎসব প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “রাজবাড়ির দুর্গা প্রতিমা ছিল বিরাট আকারের, ঘোর লাল রং। বাঘের উপর দাঁড়িয়ে একটি মাত্র মূর্তি। প্রায়, ষাট বছর আগে লক্ষ্মী-সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ বাহন-সহ জুটে গেল এই বিরাট মূর্তির পাশে। দুর্গার রং-ও একটু ফিঁকে হয়ে গেল। বাঘটি ধীরে ধীরে হয়ে গেল সিংহ।…শুনতে পাওয়া যায় প্রায় পঁচাত্তর বছর আগেও নবমীর গভীর রাতে কি যেন একটা অতি গোপনে বলি দিয়ে তখনই করলার ধারে জঙ্গলে পুঁতে ফেলা হতো। দশমীর রাত শেষে সূর্য দেখা দেবার আগেই প্রতিমা বিসর্জন দেবার নিয়ম আছে বৈকুণ্ঠপুরের রাজাদের। …পুজোর তিনদিন তিন রাত চলত নাচ ও গান। …বুড়ো রায়কত সাহেব ছিলেন সঙ্গীতবিলাসী।”
অতীতের মতো আজও মেলা বসে রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে। পুজোয় আজও পশুবলি হয়। গবেষকদের মতে প্রাচীন এই পুজোয় নানা আচার অনুষ্ঠান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

কোচবিহার_রাজবাড়ি
আজও পুজোয় লাগে নররক্ত। এখানে দুর্গা প্রতিমার প্রচলিত নাম বড়দেবী। তাঁর গায়ের রং গাঢ় লাল। দু’পাশে জয়া-বিজয়া। অন্যান্য দেব-দেবীর মূর্তি এখানে অনুপস্থিত। জনশ্রুতি, রাজা নরনারায়ণের আমল থেকেই মাটির মূর্তি গড়িয়ে এই পুজোর প্রচলন। প্রচলিত দুর্গামূর্তির চেয়ে আলাদা বড় দেবীর রূপ ও সাজসজ্জা। দেবীর বাহন বাঘ এবং সিংহ দুই-ই এখানে উপস্থিত। এই পুজোয় আজও দেখা যায় বিচিত্র সব লৌকিক আচার অনুষ্ঠান। ময়না গাছ কেটে এনে তৈরি হয় যূপকাষ্ঠ বা হাঁড়িকাঠ।
অষ্টমীর দিন রাজা ও তাঁর পরিবারের সদস্যেরা অঞ্জলি দেন। পুজোয় গভীর রাতে অনুষ্ঠিত হয় দেবীর নিশিপুজো। দরজা বন্ধ করে হয় দেবীর এই গুপ্ত পুজো। জনশ্রুতি, আগে এই পুজোতেই নরবলি হত। শোনা যায় এখনও নিয়ম রক্ষার্থে বিশেষ এক ব্যক্তি বংশ পরম্পরায় হাত কেটে বড়দেবীকে রক্ত দেন। তবে আজও এই পুজোয় চাল বাটা দিয়ে তৈরি মানুষের মূর্তি বলি দেওয়া হয়। বড়দেবীর বিভিন্ন পুজোয় আজও পশুবলি হয়। পুজোয় হালুয়া সম্প্রদায়ের মানুষরা বিশেষ পুজো করেন। এতে শুয়োর বলি দেওয়া হয়। নবমীতে দেওয়া হয় বিশেষ ভোগ। দশমীর দিন হয় বিসর্জনের বিশেষ শোভাযাত্রা। বিসজর্র্নের আগে হয় ঘাটপুজো। পরে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয় তোর্সা নদীতে।