ভারতের লোকসভা নির্বাচনঃ একটি পর্যালোচনা ।

আমি আমার পূর্ববর্তী বলেছি পোস্টে ভারতের প্রধান রাজনৈতিক জোটগুলো মূলত ধর্ম নির্ভর জোট। আপনি হয়তো ভাববেন কোন জোট হিন্দুত্ববাদ নির্ভর এবং কোন কোন জোট ইসলামপন্থা নির্ভর। হ্যা, আপনার ভাবনা পুরোপুরি ভুল নয়, আবার সম্পূর্ণ সঠিকও নয়। আবার আপনি যদি বাংলাদেশের ইসলামপন্থী এবং ইন্ডিয়ান অজ্ঞতাপূর্ণ বুদ্ধিজীবীদের কথা শোনেন তবে মনে হবে বিজেপি বুঝি মুসলিম বিদ্বেষী দল। আদতে তা নয়। বিজেপিতে যে সকল মুসলিম আছে তারা সবাই দেওবন্দী ও সালাফীদের কাছ থেকে কাফের ফতোয়া পাওয়ার ভয়ে বিজেপিতে ঢুকেছে। এখানকার রাজনৈতিক বড় জোটগুলোর কেউ দেওবন্দী এবং সালাফি কট্টর ইসলামকে প্রমোট করে, আবার কেউ শঠতাপূর্ণ সুফীবাদকে প্রমোট করে। বিজেপি হচ্ছে শতভাগ শঠতাপূর্ণ মতবাদ সুফীবাদের প্রমোটর। কংগ্রেস সরাসরি দেওবন্দী, জাকিরী, তাবলীগী মতাদর্শকে প্রমোট করে। আর তৃণমূল এক্ষেত্রে কমপক্ষে তিন ধাপ এগিয়ে! বিজেপি যতটা না ইসলামবিরোধী তারচে অনেক বেশি সালাফি (সালাফি মতবাদকে ওহাবী মতবাদও বলা হয়) বিরোধী। এ বিষয়টাকে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে দেখলে আপনি আরো সহজে বুঝবেন। পৃথিবীতে ইসলাম নামক রাজনৈতিক নির্মূলতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদের মূলত তিনটি শাখা – একটি হচ্ছে ওহাবী মতবাদ, অপরটি শিয়া মতবাদ, আর তৃতীয়টি হচ্ছে হানাফী মতবাদ। আমেরিকা ওহাবী মতাদর্শের তীর্থস্থান সৌদি আরবের মদদদাতা, রাশিয়া মদদ দিচ্ছে শিয়া মতাদর্শী একমাত্র দেশ ইরানকে, আর ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি পেলেপুষে রাখে হানাফী মতাদর্শের দেওবন্দী ও তাবলীগীদেরকে। ওহাবী বা সালাফি মতাদর্শীরা, দেওবন্দীরা ইসলামি শরীয়া আইন বাস্তবায়নে জিহাদের পক্ষে, আর সুফীবাদীরা জিহাদের বিপক্ষে। আবার মোহাম্মদের প্রতি ভক্তির ক্ষেত্রে সুফীবাদীরা ওহাবীদের চেয়ে অনেক বেশি গোঁড়া। দেওবন্দীরা এতদূভয়ের মাঝামাঝি, তবে জিহাদে তারা ওহাবীদের মতোই কট্টর। মোহাম্মদের সমালোচককে হত্যা করা ফরজ – ইসলামের এ আইনের প্রতি অগাধ বিশ্বাস সব ইসলামি দলের, তবে এর প্রায়োগিক পর্যায়ে মতপার্থক্য আছে। ওহাবী এবং দেওবন্দীরা ইসলাম এবং মোহাম্মদের সমালোচক (যেই হোকনা কেন) সরাসরি হত্যা করার পক্ষে, আর সুফীবাদীরা আইন নিজের হাতে না নিয়ে আল্লাহর কাছে নালিশ করার পক্ষপাতী। কিন্তু মুরতাদ খুন হলে তাতে খুশি হওয়া ওহাবী দেওবন্দীদের তো বটেই, সুফীদেরও অনিবার্য সুন্নত!
বৃটিশ আমলে রঙ্গিলা রসুল বইয়ের প্রকাশককে হত্যার পর খুনি ইলমুদ্দীনের পক্ষে আইনি লড়াইকারীদের একজন ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ সুফী ঘরানার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান সহ পৃথিবীর সব সুফীরা নাস্তিকদের সমালোচনা করে, আবার জঙ্গিবাদেরও সমালোচনা করে; কিন্তু তারা কোনোদিন কোন মুক্তমনার খুনের প্রতিবাদ করেনি।
ভারতীয় সুফীদের বেশিরভাগই গরুর মাংস খায় না, আর এতেই হিন্দুত্ববাদীরা খুশি। পক্ষান্তরে দেওবন্দী, সালাফি, তাবলীগী নেতারা হিন্দুদের অনুভূতিকে সম্মান করে গরুর মাংস না খাওয়াকে মনে করে কুফুরি কাজ ((ইসলামত্যাগের কাজ!) সুতরাং গেরুয়ার রাজনীতির দৌড় যে কেবলমাত্র গরু পর্যন্তই তা সহজে অনুমেয়!

ইন্ডিয়ান রাজনীতিতে ইসলামি সন্ত্রাস এবং হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাস মোটামুটি সমান সুযোগ পায়। রাজ্যভেদে ও রাজনৈতিক দলভেদে এ দুটি ধর্মের সন্ত্রাসকে কমবেশি ডানা মেলার সুযোগ দেয়া হয়।
এ দুটি ধর্মের (ইসলাম অবশ্য ধর্ম নয়) অংশগ্রহণ দৌরাত্ম্য, ও সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে অনেকটাই পার্থক্য আছে৷ হিন্দুত্ববাদ শুধুমাত্র ভারত নির্ভর একটি জাতপাত-ভেদ-পূর্ণ মতবাদ। আর ইসলাম গ্লোবালাইজড রাজনৈতিক নির্মূলতন্ত্র। ইসলাম কি আসলেই রাজনৈতিক নির্মূলতন্ত্র তথা ভিন্নমতকে নির্মূলের কথা বলে কিনা সেটা জানতে হলে পড়ুন কোরআনের ৬১ নং সূরার ০৯-১৩ আয়াত, নয় নম্বর সূরার ২৯ নং আয়াত, সূরা বাকারার ১৯০-১৯৩ নং আয়াত। সহীহ আল বোখারির ২৫ ও ৩৯২ নং হাদিসও পড়ে দেখতে পারেন।

পৃথিবীতে এ মুহূর্তে সাংবিধানিকভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন হিন্দু দেশ নেই। অর্গানাইজেশন অব হিন্দু কো-অপারেশন বা OHC নামে কোন  অরগানাইজেশন নেই। অথচ ৫৭ টি মুসলিম দেশের সাম্প্রদায়িক সংগঠন OIC অাছে যথেষ্ট শক্ত অবস্থান নিয়ে। অধিকাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সংবিধানে চেপে আছে ইসলামি অনুভূতির জগদ্দল পাথর। পাকিস্তানি ইসলামি জঙ্গিরা ভারতে শতাধিকবার জিহাদি সন্ত্রাস চালালেও ভারতীয় হিন্দু জিহাদিরা পাকিস্তানে একটি জঙ্গি হামলাও করেনি। এর কারণও আছে – কোরআনের সূরা আত তাওবার ২২৩ নং আয়াত পড়লে বুঝবেন কোরআনের কোন নির্দেশ পালন করতে গিয়ে পাক জঙ্গিরা ভারতে সন্ত্রাস করে। হাজার হাজার হিন্দুত্ববাদী অর্গানাইজেশন সারা পৃথিবী জুড়ে মনুসংহিতার বর্বর আইন ছড়িয়ে দেয়ার কাজে নিয়োজিত নেই। অথচ হাজার হাজার ইসলামি সংস্থা বিশ্বব্যাপী শরীয়া অাইন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে যার মদদ দিচ্ছে ৫৭ টি মুসলিম দেশ, কখনো কখনো তো অমুসলিম দেশও ইসলামি সন্ত্রাসী মতাদর্শ বা জিহাদে অর্থ ও ক্ষমতা লগ্নি করে। এর উৎকৃষ্ট নজির হচ্ছে চীনের সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানি জিহাদিদের মদদদান। হিন্দু উম্মাহ বলে আলাদা কোনো বিশ্বব্যাপী জাতির কথা কল্পনা করা হয় না, কিন্তু ইসলামের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরঅান সরাসরি ইসলামি পৃথিবীর কথা বলে, মুসলিম উম্মাহর কথা বলে। শুধু হিন্দু কেন, পৃথিবীর কোন ধর্মই ইসলামের মতো সরাসরি ভিন্নধর্মীদেরকে নিধন করে একমাত্র ধর্মের কথা বলে না। কারণ পৃথিবীর মালিকানা কেবলমাত্র মুসলিমদের ঈশ্বর আল্লাহর (কোরআন ০৭/১২৮।) মুসলিম ছাড়া এ পৃথিবীতে যে কারো বসবাসের অধিকার নেই তাও স্পষ্ট করেই বলে কোরআন। ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শুধুমাত্র ভারতের মাটিতে হিন্দুত্ববাদ দিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার স্বপ্নে বিভোর রয়েছে এদেশের হিন্দুত্ববাদীরা। পক্ষান্তরে ইসলাম হচ্ছে ধর্মের ছদ্মাবরণে একটি গ্লোবালাইজড অাগ্রাসী নির্মূলতান্ত্রিক রাজনৈতিক দর্শন। ইসলামি ব্যাংক, ইসলামি শিক্ষা, ইসলামি পোশাক, সর্বোপরি ইসলামি সমাজ, ইসলামি রাষ্ট্র ও ইসলামি বিশ্বের ধারণা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে ইসলামি দেশগুলো। এবং এটি কোরআন হাদিস তথা ইসলামের নির্দেশ। বিশ্বজুড়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার এই কাজে ইসলামপন্থী দেশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান অস্ত্রের নাম হচ্ছে জিহাদ, আর এটি মুসলিম নেতাদের মনগড়া আবিষ্কারও নয়, এটি তাদের ধর্মগ্রন্থেরই নির্দেশ। বিশ্বাস না হলে পড়ুন বোখারির ২৬ ও ৫২৭ নং হাদিস। আরো পড়ুন তিরমিযীর ২৬১৬ ও ইবনে মাজাহ’র ৩৯৭৩ নং হাদিস। আপনি হয়তো জানেন, ইসলাম ধর্মের প্রধান এবাদত বা উপাসনার নাম হচ্ছে নামাজ। অথচ নামাজের নির্দেশ কোরআনে ৮২ বার দেয়া হলেও জিহাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে নামাজের চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, কোরঅানে নামাজ পড়তে বলা হয়েছে খুবই কম, বরং অধিকাংশ আয়াতেই বা প্রায় সবগুলোতেই দেয়া হয়েছে নামাজ প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ। নিজে নামাজ পড়া বা নিজে ধর্ম পালন করা বনাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা এ দুটোর পার্থক্য নিশ্চয়ই আপনি বোঝেন? পৃথিবীতে ইসলামই একমাত্র রাজনৈতিক ধর্ম যেটা তার সকল ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ করতে না বলে বরং বাস্তবায়ন করতে বলে! এজন্যই আমরা দেখি অন্যান্য ধর্মের লোকেরা তাদের ধর্মের অসহিষ্ণুতা কিংবা ধর্মের বর্বরতা যতটা অনুশীলন করে ইসলাম তারচেয়ে অনেক বেশি অনুশীলন করে এবং সেই অনুশীলনকে ছড়িয়ে দিতে অন্যান্য সকল ধর্মের চেয়ে শত শত আলোকবর্ষ এগিয়ে রয়েছে। মুসলিমরা নিজেরা রোজা রেখে ধর্মপালনের চেয়ে হোটেল রেস্তোঁরা ভাঙচুরের মাধ্যমে ধর্ম বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগী! মুসলিমরা নিজেরা শরীয়া আইন ব্যক্তিজীবনে অনুশীলনের চেয়ে (অবশ্য শরীয়া আইন মানা এ যুগে কারো পক্ষে সম্ভব না) শরীয়া বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগী।

সুতরাং ইমাম বরকতী, বদরুদ্দীন আজমল, মুফতি মাহমুদ, দিল্লীর শাহি ইমাম, আসাদুদ্দীন ওয়াইসী, সিদ্দিকুল্লাহদের মতো ইসলামপন্থীদের হুংকারে ভারতের সাধারণ মানুষের ভয় পাওয়ার কারণ কি যৌক্তিক নয়? এ সকল রাজনৈতিক নেতারা যতটা ক্ষমতা পায় ততটাই ধর্ম বাস্তবায়নে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশের মোল্লা আব্দুর রাজ্জাক যখন ভারতে ওয়াজ করতে এসে মূর্তি ভাঙ্গার ফজীলতের হাদিস শুনিয়ে যায় প্রকাশ্যে, তখন সাধারণ হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে? এসব হিন্দুরা যদি আব্দুর রাজ্জাককে রাজনৈতিক সুরক্ষা দানকারী ইসলামঘেঁষা দলের বদলে উগ্র হিন্দুত্ববাদী দলকে সমর্থন করে তবে আপনি এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদী সংখ্যাগুরুদেরকে আপনি যতটা ঘৃণা করেন ততটা ঘৃণা কি সংখ্যালঘু সেজে বেনিফিশিয়ারি হতে চাওয়া ইসলামি জিহাদীদের ক্ষেত্রেও নয়? আবার আপনি যদি এক্ষেত্রে মাসুদ আজহারের প্রতি মানবতার হাত বাড়িয়ে দেয়া শি জিনপিংয়ের পদ্ধতি ফলো করে সৌদির পোষ্য ওহাবী ও দেওবন্দীদের প্রতি মায়া দেখান তবে তা কি আত্মপ্রবণ্চনা নয়?