বাঙালির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবেঃ (চতুর্থ অংশ) (তৃতীয় অংশের পর …)

বাঙালির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবেঃ (চতুর্থ অংশ)
(তৃতীয় অংশের পর …)

আর একটা কথাও খুবই স্পষ্ট নয় কি ? ১৭৫৭ সালে মুসলমানের হাত থেকে ইংরেজের হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর না হলে বাংলার হিন্দুদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে যেত না কি? ভাগ্যিস দুঃশ্চরিত্র, লম্পট সিরাজদ্দৌলা জগৎশেঠের বিধবা সুন্দরী কন্যার দিকে লালসার হাত বাড়িয়েছিল, তাই তো বাংলার হিন্দুর মুক্তিদাতা হিসেবে মিরজাফরের আবির্ভাব হল! তাই তো হল পলাশী! তাই তো হল ক্ষমতার হস্তান্তর! বঙ্কিমচন্দ্ৰ ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে যে সন্ন্যাসী বিদ্রোহীর উল্লেখ করেছেন, যে ‘সন্তান’দের কল্পনা করেছেন, তা বাস্তবে কতটা ছিল এবং তা আদৌ বাংলাকে যবন শাসন থেকে মুক্ত করতে পারত কিনা, — এরকম কোন ঐতিহাসিক তথ্য বা ইঙ্গিত তো পাওয়া যায় না। তাই মিরজাফর ও ইংরেজই বাংলার হিন্দুর মুক্তিদাতা হিসাবে এসেছিল। আর মীরমদন ও মোহনলালের মত সিরাজের বিশ্বস্ত সেনাপতিরা বাংলায় যবন শাসন স্থায়ী করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। এগুলি সব অপ্রিয় ঐতিহাসিক সত্য।

চলে আসি অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ১৭৫৭-এর পর বাঙালি হিন্দুর বোধহয় পুর্নজন্ম হল। তারপরে প্রায় একশো ষাট বছর যে বাঙালী গোটা ভারতকে নেতৃত্ব দিল, কোন মূলধন নিয়ে সেই নেতৃত্ব দিয়েছিল? সেই মূলধন কি ইংরাজী শিক্ষা, আধুনিক শিক্ষা এবং ইউরোপের সান্নিধ্য নয়? যে জাতীয়তাবাদ বা হিন্দু জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এখানে হল, তার পেছনে কি ইউরোপের ম্যাজিনি ও গ্যারিবল্ডির প্রেরণা কাজ করেনি? রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে সেদিন সেই উন্মেষের অগ্রদূতের অনেকেই কি ইউরোপ থেকে নতুন আলো ও স্বাভিমানের নতুন concept নিয়ে আসেন নি ? এমনকি পশ্চিমী প্রভাব ছাড়া আমরা কি বিবেকানন্দ, অরবিন্দ বা সুভাষকে পেতাম ?

কিন্তু রামমোহন থেকে শুরু করে শ্যামাপ্রসাদ পর্যন্ত যে উন্নত বাঙালিরা সারা ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা বাংলার কথা কম চিন্তা করেছেন। খুবই কম চিন্তা করেছেন। বোধ হয় কেউই এর ব্যতিক্রম নন। স্বামী বিবেকানন্দের মত একটা চৌম্বক ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে একটাও বাঙালি আলাসিঙ্গা-পেরুমল তৈরী হল না কেন ? রাসবিহারী বোসও পাঞ্জাব ও দিল্লীতে বিপ্লবীদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলায় তাঁর কয়জন অনুগামী ছিল ? শ্ৰী অরবিন্দের জীবনের শুরু আর শেষ দুটোই বাংলার বাইরের। মাত্ৰ সাত-আট বছর বাংলায় তাঁর কর্মভূমি। এমনকি আমাদের প্রিয় শ্যামাপ্রসাদও কাশ্মীরের জন্য মরতে গেলেন, বাংলাকে দেশদ্রোহী কমিউনিস্টদের হাতে ছেড়ে দিয়ে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাঙালি (বাঙালি মানেই হিন্দু)। সারা ভারতকে উপকৃত করছে, আলোকিত করেছে, প্রেরণা দিয়েছে, নেতৃত্ব দিয়েছে, দিয়েছে দুটি রাষ্ট্রগান, দিয়েছে দুটি স্লোগান-বন্দে মাতরম ও জয় হিন্দ। এমনকি বর্তমানে জনপ্রিয় স্লোগান “ভারতমাতা কি জয়”, তার মধ্যেও ভারতমাতা বঙ্গমাতা কনসেপ্টেরই বর্ধিত রূপ। মহারাষ্ট্র দেশমাতৃকা বা ভারতমাতা-র কনসেপট আমরা দেখতে পাইনি। ভারতমাতা-র প্রথম চিত্র এঁকেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। সুতরাং “ভারতমাতা কি জয়” এর পিছনেও রয়েছে বাংলা ও বাঙালি। অর্থাৎ আমরা ভারতকে সব দিয়েছি, নিজেরটা দেখিনি, তাই আজ নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি।

(ক্রমশঃ)
সৌজন্যেঃ স্বদেশ সংহতি সংবাদ। পূজা সংখ্যা; ২০১৭, পৃষ্ঠা – ৬
লেখকঃ শ্রী তপন ঘোষ….