প্রসঙ্গ বাঙালির বামপন্থী অতীত।

প্রসঙ্গ বাঙালির বামপন্থী অতীত।

এর আগেও লিখেছিলাম একবার, যে পুরোনো সোভিয়েত জাতীয় সঙ্গীতই পুটিন জমানায় রুশ জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হয়েছে, সুরটা হুবহু এক, গানের লিরিক কিছুটা পরিবর্তিত। মাঝে ইয়েলতসিনের সময়টা, অর্থাৎ যেসময় রাশিয়া ভেঙে পড়েছে এবং অ্যামেরিকান উপনিবেশ প্রায়, তখন আরেকটি একদম নতুন গান হয়েছিল জাতীয় সঙ্গীত, তবে জনপ্রিয় হয়নি। পুটিনের সময় পরিবর্তন করা হল, এবং  যিনি সোভিয়েত অ্যান্থেম লিখেছিলেন, তিনিই পুটিনের রুশ অ্যান্থেমটিও লিখেছেন। যেখানে সোভিয়েত আমলে ছিল পার্তিয়া লেনিনা, সিলা নারোদনায়া, অর্থাৎ লেনিনের পার্টি, জনগণের শক্তি সেটা পুটিনের সময়ের লিরিকে হয়েছে প্রেদকামি দাননায়া, মুদরাস্ত নারোদনায়া, অর্থাৎ পূর্বসূরীদের প্রদত্ত, জনগণের প্রজ্ঞা। পূর্বসূরীদের মধ্যে কিন্তু লেনিনও আছেন।

কদিন আগে একটা খবর এসেছিল, ইউক্রেনে লেনিনের স্ট্যাচু সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতদিন থাকাটাই আশ্চর্যের, কিন্তু বিষয়টা হল, লেনিন হচ্ছেন রুশ আধিপত্যের প্রতীক, এবং ইউক্রেনের বর্তমান অ্যামেরিকা-ঘেঁষা সরকারের সঙ্গে পুটিনের সরকারের মারাত্মক ঝামেলা চলছে। ক্রিমিয়া তো দখল হল, কিন্তু রুশরা এতেই থামছেন না। রুশবিরোধী ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই চলছে, এবং ফলে ইউক্রেনও স্ট্যাচু সরিয়ে দিচ্ছে।

বাঙালির বামপন্থী অতীতকে মুছে না ফেলে বাঙালিকে জাতীয়তাবাদী ফ্রেম অভ রেফারেন্সে বসানো যাবে না, কেউ যদি বলেন, গেরুয়ারা অনেকেই বলেন, তো সেটা খুব ভুল বলেন। বাঙালির কতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে। প্রকৃতি উপাসনা একটা বিপ্লব ছিল। তন্ত্র একটা বিপ্লব ছিল। সহজিয়া একটা বিপ্লব ছিল। চৈতন্য আন্দোলন একটা বিপ্লব ছিল। বাঙালির অগ্নিযুগ একটা বিপ্লব ছিল। সুভাষ বিপ্লবী ছিলেন, এবং নিজেকে লেফট ন্যাশনালিস্ট বলতেন।

বাঙালির বামপন্থা মানেই যারা ধরে নেয় কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি, আর মা দুর্গাকে বেশ্যা বলা (কেন বলা যায় না, তার ওপরে একটা বড় লেখা দেব, বন্ধুদের ও শত্রুদের কয়েকদিন ধৈর্য ধরতে হবে), তারা স্ট্র ম্যান ফ্যালাসিতে ভুগছেন। বঙ্কিম নিজে সাম্য প্রবন্ধ লিখেছেন, ইন্টারন্যাশনালের উল্লেখ আছে বঙ্কিমের লেখায় এবং বঙ্গদেশের কৃষক প্রবন্ধটি অবশ্যই বামপন্থী ওরিয়েন্টেশনের। বামপন্থা মানেই কমিউনিস্ট নয়। যে কোনও রকমের পরিস্থিতিতেই ভেস্টেড ইন্টারেস্টকে চ্যালেঞ্জ করা হল বামপন্থার প্রধান পরিচয়। ফরাসী পার্লামেন্টে যাঁরা ancien regime এর সমর্থক, তাঁরা স্পিকারের ডানদিকে বসতেন, এবং যাঁরা সেই ভেস্টেড ইন্টারেস্টকে চ্যালেঞ্জ করতেন, তারা বাঁদিকে বসতেন, এই থেকে বামপন্থী। তপন ঘোষ যখন বারবার বাগদী আর দুলেদের কথা বলেন, প্রান্তিক হিন্দুর ক্ষমতায়নের কথা বলেন, আমি জানি না উনি খেয়াল করেছেন কি না, অত্যন্ত বামপন্থী সেই বক্তব্য। অরবিন্দর রচনায় দেখবেন বামপন্থী ঝোঁক আছে,  প্রলেতারিয়েতের কথা বলছেন।  বিবেকানন্দও প্রলেতারিয়েত কথাটা একাধিকবার ব্যবহার করেছেন, এবং বামপন্থী ঝোঁক ছিল, ভূপেন দত্তের লেখা থেকেও দেখা যায় যে বামপন্থার সঙ্গে হিন্দুধর্মের সংমিশ্রণের কতগুলি সলিড গ্রাউন্ড রয়েছে। বামপন্থী জাতীয়তাবাদ কেন বাংলায় শক্তিশালী হতে পারেনি, তার প্রধান কারণ সেরকম শক্তিশালী তাত্বিক আর কেউ আসেন নি। উৎপল দত্ত আর নবারুণ তো বাংলার বামপন্থার কোপার্নিকাস, আমি একাধিকবার বলেছি। এরা দুজনেই সত্যটা জানতেন, যে বাংলার তথাকথিত প্রগতিশীল মহল হিন্দুফোবিক, কিন্তু খুব খোলাখুলি বলতে সাহস করেন নি। হার্বার্টকে যে যুক্তিবাদী শাসিয়ে যায়, স্তালিনের দাওয়াই দেব, ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠাব, সেই যুক্তিবাদ আসলে বাংলার বিশেষ বামপন্থারই সৃষ্টি। ধর্মকে বাদ দিয়েই যে আইডিয়াল অস্তিত্ব ভেবেছেন যুক্তিবাদী প্রগতিবাদী কমিউনিস্ট, সে ইউটোপিয়া যত দিন যাবে তাসের প্রাসাদের মত ভেঙে পড়বে।

পুটিন অনেকগুলি জরুরি জিনিস রেখে দিয়েছেন। আমি অন্য একটা কথা বলব। সেন আমল, বা সেন আমলের নামে চালানো, কিন্তু আসলে গণেশের শাসনে বা তারও পরে ঘটা অনেকগুলো সমাজসংস্কারে সমাজের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশকে অপাংক্তেয় করে রাখা হয়েছিল। তার বিষময় ফল আমরা বাংলায় দেখেছি। আজকের বিচারেও, কমিউনিস্ট বিরোধী উইচ হান্ট শুরু করলে, শুধু এই যুক্তিতে যে এদের অনেকেই বাঙালির শত্রুদের দালাল, আমরা পুনরায় সেই প্রমাদে পতিত হব, যে ভুলের ফলে একদিন সুবর্ণবণিককে দূর করে দেওয়া হল, সেনসাম্রাজ্যের শত্রু মগধের পালরাজাদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার ফলে। এবং বৌদ্ধ ব্রাহ্মণদের চণ্ডাল বা নমশূদ্র আখ্যা দিয়ে সমাজের নামিয়ে দেওয়া হল। হিন্দু সমাজের কয়েকটা অংশকে অচ্ছুৎ করে রাখার বিষময় ফল ঘটেছে। অস্বীকার করা যায় না, বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন মূলত বাংলার হিন্দুরই আন্দোলন। তাকে অচ্ছুৎ করে রাখলে পুনরায় সেন আমলের ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে।

পুটিনের জাতীয়তাবাদ এই ভুল করেনি, এবং স্লাভ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে রুশের সাম্যবাদী অতীতকে যথাসাধ্য মিশিয়েছেন এই এক্স কেজিবি অফিসার।

বাঙালি স্বভাবত বিপ্লবী এবং বামপন্থী। বাংলার জাতীয়তাবাদ, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ডিসকোর্স বর্তমান যুগে আমিই তৈরি করেছি, এবং একজন হিন্দু লেফট হিসেবে নিজের পরিচয় দিই আমি। আমার বক্তব্য, বাঙালির যা কিছু নিজস্ব গৌরব, তার মধ্যে বামপন্থীদেরও স্থান আছে। বামপন্থা মানেই জেহাদের দালালি নয়, কথাটা স্পষ্ট করে বলা দরকার। জেহাদীদের শক্তিশালী লবি সব দলেই আছে (বিজেপিতে নেই?), কিন্তু সেজন্য বামপন্থাকে মুছে ফেলাটা তো কোনও সমাধান নয়ই, বরং তা নানা সামাজিক বিকৃতির জন্ম দেবে। বামপন্থীরা পৃথিবী জুড়েই চিন্তার বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন, তাদের শ্রেষ্ঠ অবদানগুলিকে আত্তীকরণ করতেই হবে। এবং, যা কিছু বাঙালির দেশজ, নিজস্ব, তার কোনওটাই এলিয়েন নয়। বাংলার কমিউনিস্টদের যেটুকু মূল্যবান, যেটুকু দেশজ, তা পরম যত্নে রক্ষা করা হবে।

বাকিটা, মানে হ্যান্ড  ইন হ্যান্ড গোর্খাল্যান্ড, সীমান্তে গরুপাচারের অধিকার চাই, জেহাদীদের বিভিন্নপ্রকার দালালিকে বিপ্লবের মোড়কে পেশ করা, এগুলো যারা করেন, তাদের বাংলা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতেই হবে। পুটিনের সৌভাগ্য, এভাবে বিজাতীয় শক্তির দালালি করা কমিউনিস্ট, এমন আজব জন্তু রাশিয়ায় ছিল না। কি করা যাবে, ইংরেজ আমল থেকেই এখানকার কমিউনিস্ট আন্দোলনের কমপ্রাদরদের ভিড়। যাই হোক, কমিউনিস্টদের সবাই এমন নয়, এবং নির্বিচারে কমিউনিস্টদের শেষ করার চেষ্টা করবেন না, করলে বহিঃশত্রুরই সুবিধে হবে। ওদের মধ্যে যারা নিজেকে হিন্দু বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন না, এবং ইসলামের সমালোচনা করেন, এমন অংশগুলিকে তুলে ধরতে হবে, প্রোমোট করতে হবে, ঠিক যেভাবে জেহাদীরা তাদের অনুগত বামদের সর্বত্র প্রোমোট করে চলে।