নিজভূমে পরবাসী হওয়াটা মোটেও সুখের না……….

লজ্জ্বিত :
—————-
তসলিমা নাসরিনের “লজ্জা” সম্মন্ধে কবি শামসুর রহমান বলেছিলেন : ‘লজ্জায়’ তথ্যের কোন বিকৃতি নেই। তসলিমা একজন মুক্তমতি অসাম্প্রদায়িক লেখিকা, তিনি সত্য প্রকাশ করেছেন মাত্র। “লজ্জা” তে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের কিছু তথ্য পরিবেশন করায় সেখানকার মৌলবাদীরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে তসলিমাকে শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ এবং প্রাণ নাশের হুমকি দেয়।  অবশেষে, মিলিটারির সুপারিশে “লজ্জা” নিষিদ্ধ ঘােষণা করে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী ব্যাপক তল্লাশি চালিয়ে সমস্ত “লজ্জা”—বাজেয়াপ্ত করে। বাংলাদেশের এহেন সরকারী কর্মকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে, প্রাক্তন বিচারপতি কে.এম.সােবহান লিখেছিলেন : ‘বাজার থেকে “লজ্জা” তুলে নেওয়ায় পুলিশের যে তৎপরতা সেটা, যদি ডিসেম্বরের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রয়ােগ হতাে তাহলে “লজ্জা” বইটি লেখার দরকারই হতাে না !’ অবাক হওয়ার কিছু নেই।  এটাই সাংবিধানিক খৎনা করা বাংলাদেশের স্বাভাবিক রাষ্ট্র চরিত্র আর তাই বাংলাদেশ সরকার স্বাভাবিকভাবেই তসলিমার নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাকে দেশ থেকে  তাড়িয়েছিল। গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে ভারতে আশ্রয় মিলেছিল তসলিমার। কোন স্বাধীন সার্বভৌম সরকারের কাছে কোন বিদেশি আশ্রয় চাইলে আন্তর্জাতিক নিয়মে তাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাই তসলিমাকে আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। তসলিমার দূর্ভাগ্য যে, সে বাঙালি বলে পশ্চিমবঙ্গকে আত্মিক ভেবে ঠাইঁ নিল কলকাতায়।

খৎনা করা বাংলাদেশে তসলিমার দূরাবস্থার কথা নাহয় বুঝলাম, কিন্তু এ কোন কলকাতায় ঠাইঁ নিলো তসলিমা ? প্রগতিশীল বামফ্রন্ট সরকারের পশ্চিমবাংলায়।  সেকুলার, আপাত ধর্মনিরপেক্ষ, সাম্যবাদী সরকারের পশ্চিমবাংলায়। তসলিমা বোঝেনি সেকুলার আর সেকুলাঙ্গারের মধ্যে একটা লাইন থাকে যা অনেকেই ধরতে পারেনা।  মাশুলটা তসলিমা হাড়ে হাড়ে গুনেছিল। পশ্চিমবঙ্গের সেকুলাঙ্গার, চুতিয়া বামফ্রন্ট সরকার “লজ্জা”-কে নিষিদ্ধ ঘােষণা করলাে। তসলিমার “দ্বিখণ্ডিত” প্রকাশের পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাও নিষিদ্ধ করলাে। মুসলিম ভোটব্যাংক অক্ষত রাখতে হবে তো ? ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর থেকে ভারতের সবকটা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের বৈতরণী পার করার জন্য এই খেলাটাই তো খেলে এসেছে ! তাহলে বামফ্রন্টই বা বাদ যায় কেন ? না, না, বাদ যাওয়া অনেক দূরের ব্যাপার।  তারা এক কদম এগিয়ে খেলেছে।  হজরত মহম্মদ নিজের পুত্রবধু জয়নাবকে ধর্ষণ করে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে যে সে আল্লাহর ইচ্ছেয় এটা করেছে কিন্তু তসলিমা নাসরিন সেই সত্য নিজের ইচ্ছায় তার বই “দ্বিখণ্ডিত” তে লিখলেই ইসলামের বিশাল অবমাননা হয়ে যায়। শরিয়তে বিধান হলাে ধর্ষিতা ধর্ষকের স্ত্রী বলেই গণ্য হবে, আর তাই ২৮ বছর বয়সী ৫ সন্তানের জননী ইমরানাকে তার শ্বশুর ধর্ষণ করলে, সাচ্চা ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেস, কমিউনিস্টদের মুখে কুলুপ এঁটে যায়, মােল্লারা শরিয়তি আইনে বিচার করে ইমরানাকে তার শ্বশুরের বিছানায় শুতে বাধ্য করে। সেই সময়ের সেকুলাঙ্গার বামফ্রন্টের সমর্থকরা এক বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে, তসলিমা গেলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবার হুমকি দিয়েছিলো আর সেটা দেখেও সেকুলাঙ্গার বামফ্রন্ট নেতৃত্ব মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার অন্ডকোষ পুরে চুপ করেছিল। ১৭.৮.২০০৭, কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম সৈয়দ মহম্মদ বরকতি কলকাতায় পুলিশ প্রধানের সামনে এক জনসভায় তসলিমা নাসরিনকে খুনের হুমকি দিল। ঘােষণা করলাে যে তসলিমাকে খুন করতে পারবে, তাকে অঢেল পুরস্কার দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে হুঁশিয়ারী দিল, তসলিমাকে দেশ থেকে না তাড়ালে ভারতের সব মুসলমানকে তাড়িয়ে দাও। সেদিন বরকতির মুখের উপর বলা উচিত ছিল যে, ‘তােরা তাে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ হিন্দুর জীবনের বিনিময়ে ভারতকে তিন টুকরাে করে দু-দুটো ইসলামিক রাষ্ট্র পেয়েছিস। এখানে আর এসব বাঁদরামি চলবে না। তােরা পাকিস্তানে চলে যা।’ কিন্তু কে বলবে? সবাই তাে মেরুদণ্ডহীন বিবেক বর্জিত মুসলিম ভােটের কাঙাল, তথাকথিত সেকুলার, থুড়ি সেকুলাঙ্গার রাজনৈতিক। ২১.১১.২০০৭ কলকাতায় মুসলিম জেহাদি কুলাঙ্গাররা তাণ্ডব করলো । কলকাতা দেখলো আগুন, সেনা, কাফু। জ্বালিয়ে দেওয়া হলাে একের পর এক গাড়ি। (প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল আরও একটি প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মহড়া) হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ সরকারি কলকাঠি নাড়াতে নেওয়া হয়নি । উল্টে তাদের কাছে আবেদন করা হয়েছিল : আসুন সকলে মিলে শান্তি বৈঠক করি। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান, ‘অজন্তা সার্কাস’ এর জোকার বিমান বসু বলেছিলো : ‘তসলিমার জন্য শান্তি নষ্ট হলে তার চলে যাওয়াই উচিত।’ ২২.১১.২০০৭ সংবাদ : লালবাজারে শান্তি বৈঠকে তসলিমাকে দেশছাড়া করার দাবী জানিয়েছিল কলকাতার ইমামরা আর সেকুলাঙ্গার রাজনৈতিক নেতৃত্ববৃন্দ মুখে সেকুলারিসিমের অন্ডকোষ পুরে চুপ ছিল।

একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে কোনো বিদেশি থাকবে কিনা সেটা ঠিক করবে কে? সরকার, না কয়েকজন মৌলবাদী ঈমাম ? তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বামফ্রন্ট সরকার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তসলিমাকে চুপিসাড়ে রাজস্থান পাঠিয়ে দিয়েছিল। এতক্ষন পড়ে অনেকেই ভাবছেন, এতদিন পরে তসলিমার সেই ঘটনা নিয়ে ক্ষেপলাম কেন ? না, লেখাটা তসলিমাকে নিয়ে নয়, তসলিমার সাথে ঘটা এই নির্লজ্জ্বতা উদাহরণ মাত্র।  লেখাটা এই বিভক্ত ভারতের, বিশেষ করে এই নৃপুংসক, মেরুদন্ডহীন বাংলার রাজনীতি নিয়ে।  সংখ্যালঘু তাস খেলতে খেলতে রাজনীতিবীদরা কোনদিন আপনাকে বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করে দেবে, আপনি জানেন না বা বুঝতে পারছেন না। ওদের লজ্জ্বা নেই, আপনাদের আছে তো ?

নিজভূমে পরবাসী হওয়াটা মোটেও সুখের না……….