চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধানে।

চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধানে -৫

চৈতন্যের ও তাঁর আন্দোলনের দুটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হল, এক, এই আন্দোলন পূর্ব ও উত্তর  ভারতে বাঙালির চিরাচরিত প্রভাবাধীন ভূমিতে বাঙালির জীবনীশক্তিকে পুনরায় স্থাপিত করছিল। উত্তর ভারতে গয়া থেকে বারাণসী থেকে বৃন্দাবন, চৈতন্যের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বৈষ্ণব ঘাঁটিগুলোর এই সারকিটটা দেখুন। আর এদিকে দক্ষিণদিকে বালাসোর (যেখানে ঈশ্বরপুরীর ঘাঁটি ছিল) থেকে পুরী – এ দেখে মনে হয় না, রাজা শশাঙ্কের, বা ধর্মপাল-দেবপাল, বা বল্লালসেন-লক্ষ্মণসেনের রাজ্যের মানচিত্র আবার অঙ্কিত হচ্ছে? কি আশ্চর্য! ইতিহাস কি রক্তকণিকায় প্রবাহিত হয়? সে ইতিহাস তো বিলুপ্ত, ধ্বংস, চৈতন্যের সময়ে ভক্ত বৈষ্ণবে সে ইতিহাস, সে মানচিত্র পাঠ করেছে বলে মনেও হয় না। তা সত্ত্বেও আবার যে বাঙালি তার ঘর সাজাতে শুরু করল, সেই প্রাচীন গঙ্গারিডাই সভ্যতার দিনকাল থেকে সহস্র সহস্র বছর ধরে তার যে প্রভাববলয়, সেখানে আবার সে ডানা মেলতে শুরু করল, একে কি বলব, জাতিগত স্মৃতি? যাই হোক না কেন, চৈতন্য আন্দোলন ভারতভূমিতে বাঙালি মননের প্রাধান্যর পুনর্বিস্তারে আরেক পদক্ষেপ। চৈতন্যর পূর্বসূরী অদ্বৈত গোস্বামী দীক্ষা নিয়েছিলেন ঈশ্বরপুরীর কাছে, চৈতন্যের দীক্ষাও এই ঈশ্বরপুরীরই কাছে। এই ঈশ্বরপুরী বাঙালি বৈদ্যজাতে জন্ম নিয়েছিলেন, বাড়ি ছিল কুমারহট্টে (হালিশহরে)। চৈতন্য আন্দোলনের পেছনে বৈদ্যজাতের ভূমিকা নিয়ে একটা সম্পূর্ণ প্রবন্ধ হতে পারে, তবে সে অন্য কথা।

দ্বিতীয়ত, চৈতন্য-নিত্যানন্দের এই আন্দোলন সমসাময়িক ব্রাহ্মণ্যধর্মের গোঁড়ামির থেকে বেরিয়ে এসে সহজিয়া চেতনার পথে এ দেশ, এ সমাজের পুনরুজ্জীবনের পথে হাঁটছিল। যে মূর্খ পাণ্ডার দল কালাচাঁদ রায় সাতদিন ধরে পুরীর মন্দিরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকার পরে তাকে দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয় এবং সেই কালাচাঁদ পরে কালাপাহাড় হয়ে ফিরে আসে এই বিদ্বেষময়, গোঁড়া সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে নেমেসিস হয়ে, তাদের পক্ষে চৈতন্যের এই ভাব আন্দোলনের মর্ম বোঝা সম্ভব নয়। যে গৌড়ীয় ব্রাহ্মণরা সুবুদ্ধি রায়কে গরম ঘি খেয়ে কিংবা তুষানলে প্রবেশ করে আত্মহত্যা করতে বলেছিল (সুবুদ্ধিকে হুসেন শাহ মুসলমানের জল খাইয়ে তার ধর্মনষ্ট করেছিলেন, তারই পরিণতিতে সুবুদ্ধি হিন্দুসমাজ কর্তৃক পরিত্যক্ত হন, এবং সুবুদ্ধি যখন হিন্দুসমাজে ফেরার জন্য ব্রাহ্মণদের কাছে নিদান চান, তখন এই চমৎকার ব্যবস্থা করেন সেই ব্রাহ্মণেরা), সেই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বাংলার স্ব-ভাব নয়। সেই নির্মম, সঙ্কীর্ণ, নির্বোধ, ছুঁৎমার্গী, অমানবিক ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বাংলার নিজস্ব নয়। সুবুদ্ধি রায়কে চৈতন্য বাঁচিয়েছিলেন। যখন সুবুদ্ধি বারাণসীতে গমন করেন, নিদান চাইতে, সেখানে ভাগ্যবশতঃ চৈতন্যের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, এবং সুবুদ্ধি রায়কে চৈতন্য বৃন্দাবনে প্রেরণ করেন। শিশির ঘোষ তাঁর অমিয় নিমাই চরিতে এই ঘটনাটি দিয়ে উপক্রমণিকা শুরু করছেন। অর্থাৎ চৈতন্য ধর্মের স্বরূপ হল এর মানবিক অ্যাপ্রোচ, যা একান্তভাবেই বাংলার সহজিয়া সাধনার ঐতিহ্য। এবং বাংলার মুসলমান শাসকের আগ্রাসনের মুখোমুখি চৈতন্যের স্ট্র্যাটেজির যে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা আছে, সে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই ধরণের স্ট্র্যাটেজি যখন তিনি জগন্নাথ মন্দিরে বসে নেবেন, তখন তাঁকে যে ধাক্কাটা সামলাতে হবে, সেটা শুধু পাণ্ডা-হিন্দুত্বের গোঁড়ামির নয়, সেটা তাদের বাঙালি-বিদ্বেষেরও বটে, যারা এই প্রেমধর্মকে বুঝতে পারে না, আর নিজেদের নির্বোধ ঘৃণাকেই হিন্দুধর্মের আকর বানিয়ে ফেলে। যে নিত্যানন্দ ছিলেন অবধূত, যিনি সমস্ত সঙ্কীর্ণ আচার-ব্যবহারের উর্ধ্বে, যাকে কোনও ছুঁৎমার্গে ফেলা যায় না, আর যে চৈতন্য ছিলেন সর্বজীবে সমকরুণার আকর, তারা বাঙালিকে রিপ্রেজেন্ট করেন, বাঙালির প্রকৃত প্রেমধর্মের প্রতিনিধি তাঁরা। পাণ্ডাধর্মের সঙ্গে প্রেমধর্মের ঠুকোঠুকি লেগেছিল, লাগাটা অবশ্যম্ভভাবী ছিল।

চৈতন্যকে বা জয়দেবকে উড়ে বানানোর পেছনে যে বাঙালি-বিদ্বেষ কাজ করছে, তাকে চেনা ও জানা খুবই দরকার। হরিদাসকে যখন গৌড়ীয় বৈষ্ণব মঠ ব্রাহ্মণ বানাতে চায় (আসলে ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম কিন্তু মুসলমান-গৃহে পালিত – এই মিথ ও মিথ্যার প্রচার করে। দীনেশ সেন বলছেন, হরিদাস জন্মসূত্রে মুসলমান ছিলেন, ব্রাহ্মণ ছিলেন না মোটেই, সমস্ত প্রাচীন নথি সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে। এবং জন্মসূত্রে মুসলমান ছিলেন বলেই এমন চরম শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তাঁর হরিভক্তির। সে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, বাইশটি বাজারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেত্রাঘাত করে মেরে ফেলা হবে, এমন আদেশ দিয়েছিলেন গৌড়ের সুলতান। অসম্ভব বলশালী দীর্ঘদেহী স্বাস্থ্যবান পুরুষ ছিলেন হরিদাস, তাই কোনওমতে বেঁচে যান), তখনও একটা মুসলমান বিদ্বেষ কাজ করে। এগুলো অন্যায় তো বটেই, কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, এগুলো শেষ বিচারে হিন্দু ছুঁৎমার্গ, যা হিন্দুধর্মকেই যুগে যুগে দুর্বল করেছে। বাঙালির থেকে যদি উড়িষ্যাকে জয়দেবের অমর কাব্য নিতে হয়, হিন্দুকে যদি জন্মসূত্রে মুসলমান হরিদাসের কাছ হরিভক্তি শিখতে হয়, সে তো আনন্দের, সে তো আহ্লাদের কথা, এই প্রসারণের মধ্যে দিয়েই তো মানব-সভ্যতা প্রাচীন কাল থেকে এগিয়ে চলেছে, এভাবেই তো বাঙালির দেশজ ধর্ম সমস্ত বিজাতীয় আগ্রাসনকে হারিয়ে দেয়।

কিন্তু না, এগুলো এদের বোঝানো যাবে না, কাজেই হরিদাস মুসলমান হতেই পারেন না। তাকে ব্রাহ্মণ বানাতেই হবে। আর এভাবেই জয়দেব ও চৈতন্যকে না-বাঙালি প্রমাণ করে, আদতে উড়িষ্যাবাসী প্রমাণ করে মাধব পট্টনায়ক সেযুগের একটা শক্তিশালী উড়ে লবির বাঙালি-বিদ্বেষের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তাদের স্তোক দিতে চেয়েছিলেন। শেষ বিচারে, এটা হিন্দুত্ববাদের জঘন্যতম অংশগুলোর অন্যতম। অপর (আদার)কে এই নির্বোধ একবগগা বিদ্বেষ ও ঘৃণা থেকে হিন্দুধর্মের যত অপকার হয়েছে, এতটা কোনও বহিরাগত শক্তির আক্রমণেও হয়নি। সর্বোপরি, যে পাণ্ডাতন্ত্র যবন হরিদাসের সঙ্গে আগ্রাসী মুসলমানের ফারাক করতে পারে না, যে পাণ্ডাতন্ত্র কালাচাঁদ রায়কে কালাপাহাড় বানিয়ে দেয়, যারা সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ভক্তিধর্মে দীক্ষা দেওয়ার সামাজিক গুরুত্ব বোঝে না, সেই পাণ্ডাতন্ত্রের থেকে বড় শত্রু হিন্দুধর্মের আর নেই, এ কথা মুক্তকণ্ঠে বলা দরকার।

গণ-আন্দোলনের গুরুত্ব চৈতন্যরা জানতেন, পাণ্ডাতন্ত্র বুঝত না। হিন্দুসমাজের সংস্কারের পথিক চৈতন্য নিত্যানন্দ প্রমুখ, যাঁরা জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে এক প্রেমধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন, সেযুগের বদ্ধ হিন্দুসমাজে এক বিপ্লব এনেছিলেন, এবং এই মূর্খ, ক্ষমতালোভী পাণ্ডারা, যাদেরকে আজকের হিন্দুত্ববাদেরই পূর্বসূরী বলা যায়, সেই চৈতন্যকেই মেরে ফেলল, সেই চৈতন্যকেই মুসলমান শাসকের গুপ্তচর ভাবল। এ অত্যন্ত স্বাভাবিক ট্র্যাজেডি, এরকমই হওয়ার ছিল। হিন্দুসমাজের ভেতরে যে পচন ধরেছিল, সেই পচন, সেই পুঁজরক্তময় ঘা একদিন চৈতন্যস্বরূপ ঔষধিকেই বিষ বলে প্রচার করতে শুরু করল। 

চৈতন্যপন্থা ছিল বাঙালির সহজাত সহজিয়া প্রেমসাধনা। এর সঙ্গে কনট্র্যাস্ট করুন উড়ে অ্যাপ্রোচের, যার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সেই পংক্তির ভালো মিল আছেঃ দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি। এদের মনের দরজা বন্ধ, এরা অপরের ভালোটা বরং পারলে চুরি করে হাতিয়ে নেবেন, তবুও কদাপি অপরকে ভালো বলে স্বীকার করবেন না।

আলোচনা চলবে।

সঙ্গের ছবিটি বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ যবন হরিদাসকে বাইশ বাজারে বেত্রাঘাতের বর্ণনা করছে। পুরীতে যবন হরিদাসের সমাধি মঠে এই ছবিটি রাখা আছে।