বাংলাদেশের কোনো এক ফেবু সেলিব্রিটি একবার সদম্ভে আমায় বললেন, ”সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় ভারতে, বাংলাদেশে শেষবার দাঙ্গা হয়েছে বহুকাল আগে। এ থেকেই বোঝা যায় কোন দেশের সংখ্যালঘুরা বেশি ভালো আছে।” আমি তাকে নোয়াখালীর দাঙ্গা, নাসিরনগর, রামু, কুমিল্লা ইত্যাদি জায়গায় হওয়া হামলাগুলোর রেফারেন্স দিলাম। তিনি ততোধিক অহমিকায় বললেন, ”আগে দাঙ্গা আর সাম্প্রদায়িক হামলার তফাৎ শিখে আসুন।” এর উত্তরে সেদিন ভদ্রলোককে আর কিছু বলিনি কারণ আমি নিজেও যথেষ্ট নাক উঁচু মানুষ। এ ধরণের গর্বিত অশিক্ষিতদের সঙ্গে প্রবল বাকবিতণ্ডায় যাবো এতটা অবসর কখনোই পাই না। কিন্তু আজ এখানে সে প্রশ্নের উত্তর দেবো। দাঙ্গা তখন হয়, যখন হামলার উত্তরে হামলা করা হয়। এক পক্ষের আঘাতের প্রতিদান অন্য পক্ষ শুধু চোখের জলে দিলে তা আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়ে ওঠে না; হামলা হয়েই থেকে যায়। গুজরাতের সেই ভয়াবহ দাঙ্গায় হিন্দু মুসলিম দু পক্ষই অংশ নিয়েছিলো, তাই সেটা দাঙ্গা ছিল। বাংলাদেশে যতবার হিন্দু, বৌদ্ধদের ওপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হয়েছে তারা মার খেয়েছে, ধর্ষিত হয়েছে। পাল্টা মারেনি বা ধর্ষণের জবাব ধর্ষণ করে দেয়নি। যদি বাংলাদেশে ”দাঙ্গা হয় না কেনো” নিয়ে সত্যি এত গৌরব হয়, তবে বিন্দুমাত্র লজ্জা না পেয়ে সেই গৌরবের ষোল আনাই নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের দিন যারা সর্বোচ্চ সহিষ্ণুতা দেখিয়ে চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। প্রতিবাদ না করে, নিজেদের ত্যাগ দিয়ে। অন্যদিকে নিজেদের অস্তিত্বকে প্রশ্নাধীণ করে চলেছে নিঃশব্দে।
রঙপুরের ঠাকুরপারা হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল। ওদিকটায় প্রচুর হিন্দু থাকে, সঙ্গে আছে বেশ কিছু মন্দির। যারা দাঙ্গা বাধাতে চায়, তারা কি সুকৌশলেই না এমন এক জায়গার লোককে বেছে নিয়েছে তাদের মহড়া হিসেবে! এবারের শিকার ছিলেন টিটু রায়। দরিদ্র, গ্রাম্য, প্রায় নিরক্ষর এক লোক যে কিনা ঋণদায়গ্রস্থ হয়ে বেশ অনেক বছর আগেই পরিবার সমেত পৈতৃক অঞ্চল ঠাকুরপাড়া ছেড়ে নারায়ণগঞ্জে চলে গিয়েছিলো। এখনো সে সেখানটাতেই থাকে। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে টিটু রায় যাদের কাছ থেকে টাকা ধার করে ফেরত দিতে পারেনি, তাদেরই কেউ তার ক্লাস সিক্স পড়ুয়া বাচ্চা মেয়েকে জোর করে তুলে নিয়ে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করে। অর্থাৎ টিটু বাবুকেই কেনো মহড়া বানানো হলো তার একটা স্পষ্ট মোটিভ আমরা দেখতে পাই। তো হামলাকারীদের বক্তব্য হলো, টিটু রায় ফেসবুকে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে স্টেটস দিয়েছে। তাই মুসলিম হিসেবে এটা তাদের নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে পড়ে যে ধর্ম অবমাননাকারীর চৌদ্দ পুুুরুষ, পাড়া প্রতিবেশী, তার পুরো গ্রাম, তার বাড়ির আশেপাশের সবাইকার বাড়িঘর, মন্দির, সম্পত্তি সব ছাড়খাড় করে দিতে হবে। তাই পাগলাপীর, মমিনপুর, হাড়িয়াল কুঠিসহ ঠাকুরপাড়া গ্রামের আশেপাশের আরো অনেক কটা গ্রাম থেকে প্রায় কুড়ি হাজার বিক্ষুব্ধ ধর্মপ্রাণ মুসলিম ঠাকুরপাড়া গ্রামে আক্রমণ করে। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। মুশকিল হলো এখানে যে টিটু রায় বহু কষ্টে নিজের নামটুকু লিখতে পারে কেবল। আর্থিক অবস্থাও প্রচণ্ড খারাপ। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা যার। সে তাহলে ফেসবুক স্টেটস কি করে দিয়ে ফেললো? তাও আবার এমন স্টেটস যা পড়ে হাজার হাজার লোক আগুণ হাতে ছুটে এলো মালাউন শেষ করবে বলে? পরে রংপুর পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এলো এই আক্রমণের খানিক আগেই বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে শলেয়াশাহ এলাকায় এই স্টেটস নিয়ে প্রথমে মানববন্ধন করেন ও পরে উশকানিমূলক বক্তব্য দেন জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও রংপুর জেলা সভাপতি ইনামুল হক মাজেদি, সদর উপজেলা বিএনপির সদস্য মাসুদ রানা, সদরের খলেয়া ইউনিয়ন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি ও শলেয়াশাহ জামে মসজিদের ইমাম সিরাজুল ইসলাম এবং খলেয়া ইউনিয়ন জামায়াতের সদস্য মোস্তাইন বিল্লাহ। তারা তাদের বক্তৃতায় বারবার ইন্ধন দিতে থাকেন অশিক্ষিত ধর্মান্ধ গ্রাম্য লোকগুলোকে। যেনো তারা ইসলাম কে অবমাননা করা এই কাফেরের জাতকে নিজেদের জায়গা বুঝিয়ে দেয়। ওমনি শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর কুড়ি হাজার লোক ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠাকুরপাড়া গ্রামের ওপর। আর এবার লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট! ফেসবুক আসার গত এক যুগে ঘটতে থাকা আর সব ঘটনার মতোই এবারোও তদন্ত করে জানা যায় স্টেটসটি আদৌ টিটু রায় দেনইনি। দেয়া হয়েছে খুলনা থেকে। মাওলানা হামিদী নামক এক বহিরাঙ্গে ধর্ম পরে থাকা ব্যক্তি সেই স্টেটসের প্রসবদাতা। নাহ নাহ, আমি এখনো এত নিষ্ঠুর হয়ে যাইনি যে মাওলানা সাহেবটিকে ধর্ম অবমাননাকারী বলবো। নিশ্চয়ই তিনি ধর্ম অবমাননা করার উদ্দেশ্যে স্টেটসটি দেননি। তার উদ্দেশ্য ছিল অত্যন্ত সাধু! ”ধর্মীয় অনুভূতিতে ভীষণ আঘাত এসেছে” এই যুক্তিতে আরেক দফা হিন্দু সাফ অভিযান করা গেলে মন্দ কি? এই এখন যেমন প্রচুর লোকই বিশ্বাস করছে যে স্টেটস টিটু রায়ই দিয়েছে, হিন্দুদের বাড়িতে আগুণ হিন্দুরাই লাগিয়েছে, যে ছেলেটি পুলিশের গুলিতে মারা গেলো সে নিশ্চয়ই কুচুপুচু নিরপরাধ নিষ্পাপ বালক ছিল(তার জন্যে ফেবুতে বাংলাদেশীদের রক্তকান্না দেখে চলেছি, তাকে অনেকে ‘শহীদ’ আখ্যাও দিয়েছে) ইত্যাদি ইত্যাদি। বাংলাদেশ বোধ হয় বুদ্ধিজীবি হত্যার সেই রাতে সত্যি এতটাই মেধাশূন্য হয়ে গিয়েছে যে এটা বোঝার সামর্থ্য আজ তাদের নেই যে সরকার কখন কি না কি কাঁচকলা ক্ষতিপূরণ দেবে বা প্রতিবেশী দেশ ভারত ‘উদ্বেগ প্রকাশ করে’ করুণাভরে কি না কি সাহায্য পাঠাবে তার ওপর ভরসা করে কতগুলো সহায় সম্বলহীন লোক নিজেদের বাড়িঘর, গবাদি পশু সবটায় আগুণ ঢেলে কপর্দকশূন্য হতে যাবে না। নিজের একটা দশ টাকার নোটের ওপরেও লোকের মায়া থাকে, আজীবনের সামান্য জমা পুঁজি ওরকম নিজ হাতে শেষ কেউ করে না। আর ‘অ’ তে অজগর লিখতে না জানা টিটু রায়ের পক্ষে তো ফেসবুক চালানো রীতিমতো পরাবাস্তব ব্যাপার স্যাপার। কিছু উন্মাদ গাধা মানব আমাকে কি এক ভিডিও লিংক দিয়ে বলছে ”দেখুন নিজেরাই নিজেদের বাড়িতে আগুণ লাগাচ্ছে”- দেখলাম তাতে পুলিশের আগুণ নেভানোর দৃশ্য ছাড়া আর কিছু নেই। আমি অবাক শুধু এটাতে হলাম যে এত কিছুর পর, এত সাত কাণ্ড রামায়ণের পর সরকার টিটু রায়কেই রিমান্ডে নিলো!!? বাংলাদেশের হিন্দুরা যে অজ্ঞাত কারণে বহুকাল ধরে এই ”স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির” মানসিক দাসত্ব করে চলেছে সে তো পুরনো কথা। তারা ভুলে গেছে যে নোয়াখালীর দাঙ্গায় যারা তাদের রক্তাক্ত করেছিলো, তাদের একাংশই পরে এই ”স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি” হয়েছে; নিজ প্রয়োজনে। রাজনৈতিক স্বার্থে। তারই ফলশ্রুতি এটা। ক্রমাগত একটা ধর্মান্ধ, মধ্যযুগীয় শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে দেশের ‘সর্বস্তরের মানুষের’ সমর্থন পাওয়ার যে ভুল প্রয়াস এ সরকার করছে, তাতে কেবল এটাই হচ্ছে যে প্রগতিশীল নিরপেক্ষ যে অংশটা এত বছর আওয়ামীলিগকে একটা নৈঃশব্দের সমর্থন জানিয়ে এসেছে তারাও আজ আস্থা হারাচ্ছে। আওয়ামীলীগ যদি ভাবছে যে এসব করে তারা কয়েক প্রজন্ম ধরে আওয়ামীলীগকে ”হিন্দু তোষণকারী” রাজনৈতিক দল হিসেবে মেনে আসা মানুষগুলোরও ভোট পাবে তবে তারা ভুল ভাবছে। নির্বাচন শেষ হলেই বুদ্ধি ঘটে ফিরে আসবে। কথায় আছে না, বিনাশ কালে বিপরীত বুদ্ধি!
আর রঙপুরের এ ঘটনায় অবাক হয়ে বিস্ফোরিত হওয়ারও তো কিছু নেই। এ অন্ধকার সময়ের ভেতর তো আমরা বহুদিন ধরেই চলেছি। এর আগে কুমিল্লার হাবিবুর রহমান যখন পবিত্র কোরানের ওপর মনুষ্যবর্জ্য রেখে ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছিল, তখনোও তো আক্রমণ হিন্দুদের ওপরই হয়েছিল। যে রসরাজ দাসকে অন্যায়ভাবে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের দায়ে জেলে থাকতে হয়েছিল, যে ফোটোশপটি নিয়ে নাসিরনগরে ভয়ানক হামলাটি হয়েছিল সেটাও করেছিলো জাহাঙ্গীর আলম, কিন্তু হামলা শুধু হিন্দুদের ওপরেই হয়েছিল। ৭% হিন্দুর দেশ বাংলাদেশে হিন্দুরা এই প্রবল সহিষ্ণুতা না দেখিয়ে আর কি ই বা করার সাহস দেখাবে? প্রতিরোধ করার জন্য যে সামান্যতম শক্তিটুকু প্রয়োজন তাও তো তাদের আর নেই! তাছাড়া দাঙ্গা কোনো সমাধান নয়। দু পক্ষ দু পক্ষকে ছিঁড়েকুড়ে খাবে, রক্তারক্তি হবে… যারা সংখ্যায় শক্তিতে কম তাদের ক্ষতি বেশি হবে…হয়তো অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে… সবটাই তো জানা হিসেব। তাই প্রতিবাদের ভাষা যে এখন কি হওয়া উচিত সেটাই বড় চিন্তার জায়গা।
আমার এখানকার এক বন্ধু আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ”যদি টিটু রায় সত্যি ধর্মের অবমাননা করেও থাকতো, তাতেই বা কি? মানুষের অবমাননা করা গেলে ধর্মের অবমাননা করা যাবে না কেনো?” আমি শুধু বললাম, ”আস্তে বলো! দেয়ালেরও কান আছে। একবার ‘তাঁদের’ কানে গেলেই হলো, গর্দান নিয়ে বাড়ি ফেরা হবে না।” বাংলাদেশের মানুষের কয়েক প্রজন্মের অশিক্ষার অন্ধকার আর ধর্মীয় গোঁড়ামি কতটা গভীর আর সময়ের সঙ্গে তা কেমন নিশ্ছিদ্র হয়ে উঠছে সে তো কেবল ভুল করে আলোর মুখ দেখা হাতে গোনা মানুষরাই বলতে পারবে।