সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আজীবন লড়াই, তারই কন্যাকে সেই মৌলবাদীরা কওমি জননী হিসেবে ঘোষণা করেন।

এই দেশে একদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল। নির্মলেন্দু গুণ তার বইয়ে উল্লেখ করেছিলেন, যেদিন রেডিওতে খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে বলে ঘোষণা করে, সেই ঘোষণা শুনে তাঁর গ্রামের এক লোক দৌড়াতে দৌড়াতে গায়ের জামা খুলে বাতাসে উড়াতে উড়াতে চিৎকার করে বলতে থাকে

‘হিন্দুগো বাপ মরছে রে.. হিন্দুগো বাপ মরছে।’

এমন চিত্র বাংলাদেশের অনেক স্থানেই দেখা গেছে। এই ঘটনাগুলো থেকেই প্রমাণিত হয়, একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধুর যে প্রতিশ্রুতি  ছিল তাঁর যথাযথ বাস্তবায়নের পথেই তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন। দেশের চরম মৌলবাদী অংশটি বঙ্গবন্ধুর  অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি। মেনে নিতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর নিজ দলের কিছু লোকও। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পিছনে সেই লোকগুলোকেই পরবর্তীতে দেখা যায়। এবং হত্যার পর পরই প্রথম দিকে তাঁরা বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে।

OIC সদস্যপদের জন্য বাংলাদেশ আবেদন করার পর মুরুব্বি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর শর্ত ছিল, বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্রকে বাদ দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে তাদের না করে দিলেন, সংবিধান থেকে এর কিছুই তিনি বাদ দেবেন না। প্রয়োজনে OIC সদস্যপদ তাঁর প্রয়োজন নাই।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার মাত্র ১০ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান রচিত হল। ৭২ এর মূল সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হল,

‘ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, কোনো বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর  নিপিড়ন বিলোপ করা হইবে।’ 

এ প্রসঙ্গে আবুল বারকাত তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু-সমতা-সম্রাজ্যবাদ’ বইটিতে বলেন,

‘এ সবের সোজাসুজি অর্থ রাষ্ট্র কোন ধর্মকে পরিতুষ্ট-পোষণ করতে পারবে না। কোন বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যাক্তির বা গোষ্ঠীর প্রতি কোন ধরনের বৈষম্য বরদাশত করবে না। কোন ধর্ম সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিলে ঐ ধর্মকে অথবা ঐ ধর্মের নামে যে বা যারা তা করেছেন তাদের প্রতি রাষ্ট্র কঠোর অবস্থান নেবে।’

আমরা দেখি বঙ্গবন্ধু এর ভিত্তিতেই সকল ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠন গুলোকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। তাঁর প্রায় চার বছর শাসনামলে তিনি দেশের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। আর এ কারণেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ‘হিন্দুদের বাপ মরেছে’ বলে উল্লাস করা হয়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমরা কি দেখি? প্রথমেই রেডিওতে বাংলাদেশকে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হল। তখন ভারতের চাপে সেখান থেকে তাঁরা পিছিয়ে আসে। সেই গল্প অন্য একদিন বলবো।

১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ‘প্রস্তাবনার’ উপর ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ লেখা হল। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তীতে রাজাকার পুনর্বাসনকারী খুনী জিয়া এই কুকর্মটি করেন। ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ বঙ্গবন্ধুর এই চেতনাকে জিয়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই খুন করলেন। স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতায় এসে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করলেন।

যে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আজীবন লড়াই, তারই কন্যাকে সেই মৌলবাদীরা কওমি জননী হিসেবে ঘোষণা করেন। এটা কি পরিতাপের বিষয় নয়? লজ্জা নয়?

আজ আওয়ামী লীগ থেকেই প্রচার করা হয় ইসলামের প্রচার প্রসারের বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা। এমন মিথ্যাচারে বঙ্গবন্ধু নিজে কি লজ্জিত হতেন না? খুনি রশিদ, ডালিম, মোশতাক, জিয়া বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছিলেন এক ভাবে, আর বঙ্গবন্ধুর নিজ দলের লোকেরাই এখন বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে খুন করে চলেছেন ভিন্ন ভাবে।

এই লজ্জা তবে কার?