বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের কথা লিখতে গেলে একটি মহাভারত হয়ে যাবে
শিতাংশু গুহ, ১৮ জুন ২০১৯, নিউইয়র্ক।। চট্টগ্রাম জেলে খুন হয়েছেন অমিত মুহুরী। তাঁকে ইট দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনা বুধবার ২৯ মে ২০১৯’র। তার পরিবার বলেছে, এটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। মৃত্যু’র কিছুদিন আগে অমিত তাঁর পিতাকে অনুরোধ করেছিলো, তাকে যেন অন্য জেলে স্থানান্তরিতের চেষ্টা করা হয়? নিহতের পিতা অরুন মুহুরী বলেছেন, অমিত ভীত ছিলো যে জেলের ভেতরে কেউ হয়তো তাকে মেরে ফেলবে। টাকা-পয়সা লেনদেনের কথাও বলেছিলো। পিতার ভাষ্যমতে, তাঁরা অমিতের কথায় কান দেননি। কারণ জেল তো নিরাপদ? জেল কর্তৃপক্ষ ঘটনা স্বীকার করে বলেছে, অন্য এক বন্দি অমিতকে খুন করেছে। অমিতকে যখন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে, তখন তিনি মৃত। প্রশ্ন ওঠেছে, অমিতের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েই কি তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে? অমিতের বিরুদ্ধে বেশ ক’টি মামলা ছিলো, কিন্তু তিনি দণ্ডিত অপরাধী ছিলেন না। খুন হবার সময়কার ভিডিও ক্লিপিং নেই, কারণ যাই হোক, এই না থাকাটা সন্দেহজনক।
এপ্রিল মাসের ত্রিশ তারিখ পঞ্চগড় জেলের ভেতরে এডভোকেট পলাশ কুমার রায়-কে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। পলাশ আইনজীবী, ক্রিমিনাল ছিলেন না? তার বিরুদ্ধে, অর্থ আত্মসাৎ এবং মানহানির মামলা ছিলো। তিনি নিজেই ওগুলোকে ‘ভুয়া’ বলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিলেন। বলা হচ্ছে, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে গালাগালি করেছিলেন। পলাশের শরীরে আগুন দেয়া হয় ২৬ এপ্রিল, তিনি মারা যান ৪দিন পর? মৃত্যু শয্যায় অমিত তার মা-কে বলেছেন, তিনি বাথরুমে গেলে দু’জন লোক তার গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই দু’জন কারা? তাঁরা পেট্রল পেলো কোথা থেকে? তারা কি বাইরে থেকে এসেছিলো? অমিতের অপরাধ কি, কেনই বা তাকে এভাবে মরতে হলো? কেউ কি জবাব দেবে না? জেল তো নিরাপদ জায়গা। জেলের ভেতরে দু’টি হত্যা, কারোই কি কোন দায় নেই? কেউ কি দায়িত্ব নেবে না? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তদন্তের দোহাই দিয়েছেন। এসব হত্যা কি মেনে নেয়া উচিত? এ গুলো কি হিন্দু নির্যাতন?
১১ জুন ২০১৯ মঙ্গলবার দিনদুপুরে নেত্রকোনার সাখুয়া বাজার সংলগ্ন গন্ধর্বপুর গ্রামের বিষ্ণু বর্মনকে আইসিস ষ্টাইলে খুন করেছে জনৈক তাসকিন ইবনে আহাদ। দা দিয়ে কুপিয়ে বিষ্ণু বর্মনের গলা থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে নৃশংস এ হত্যাকান্ড ঘটানো হয়। বীভৎস ছবিতে দেখা যায়, তার দেহ চৌকির ওপর আর মাথাটা মাটিতে? পৈশাচিক ও অমানবিক ঘটনা। পুলিশ আহাদকে ধরেছে, এবং বলেছে, আহাদ মানসিক ভারসাম্যহীন। বাংলাদেশে অনবরত মুর্ক্তি ভাঙ্গছে? আইসিস ষ্টাইলে খুন হচ্ছে। পুলিশ যদি কাউকে ধরতে পারে, ডাক্তারের পরামর্শ বাদেই বলে দিতে পারে, অভিযুক্ত ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’। পাগলের তো আর বিচার হয়না? বিষ্ণু বর্মন হত্যার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে নাটোরে এক ব্রাহ্মণ গুলীতে নিহত হয়েছেন। ১২ জুন বুধবার দুপুরে তাঁকে গুলী করে হত্যা করা হয়। নিহতের নাম অলোক কুমার বাগচী। নাটোর জেলার লালপুর থানার গোপালপুরের ঠাকুরবাড়িতে এ হত্যাকান্ড ঘটে। ব্যবসায়ী অলোক বাগচীকে দুর্বৃত্তরা কাজের ছুতায় ডেকে নিয়ে হত্যা করে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর লাশের মিছিলে সর্বশেষ যুক্ত হলেন নাটোরের পুরোহিত। বিষ্ণু বর্মন ও অলোক বাগচী হত্যা কি সংখ্যালঘু নির্যাতনের মধ্যে পড়ে? এদিকে বৃহস্পতিবার ১৩জুন সন্ধ্যায় নরসিংদীতে যুবতী ফুলন রানী বর্মনের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। ভাগ্য ভালো, তিনি মারা যাননি, ঢাকায় চিকিৎসাধীন আছেন। দেশের একটি বড় কাগজে ৪ঠা এপ্রিল গলাচিপা, পটুয়াখালীর একজন শেফালী রানীর হৃদয় বিদারক ছবি ছাপা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ১৩দিনেও তিনি তাঁর সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া কন্যা পূর্ণিমাকে ফিরে না পেয়ে বাকরুদ্ধ। ঢাকার কেরানীগঞ্জের নাবালিকা সুস্মিতা মজুমদার অপহৃত হন জানুয়ারিতে, এখনো তাঁর কোন হদিস নেই? উভয় কেসে আসামীর নাম দিয়ে মামলা হয়েছে। পুলিশ এদের ধরতে পারেনা! দু’টোই নাবালিকা অপহরণ ও ধর্মান্তরণের ঘটনা, বাংলাদেশে এটি মহামারী আকার ধারণ করেছে।
১০ই জুন ঢাকার একটি বড় মিডিয়া হেডিং করেছে, আদমদীঘিতে একদিনের ব্যবধানে ফের মুর্ক্তি ভাংচুর। বগুড়ার আদমদীঘিতে প্রথমদিন কালী মণ্ডপের প্রতিমা ভাংচুর হয়, একদিন পর সন্যাসতলায় আবার ভাঙ্গে দু’টি মুর্ক্তি। চাঁদপুরে ১৩জুন পুরাণবাজারের দাসপাড়ায় দুর্গামন্দির এবং প্রতিমা ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। ৮ এপ্রিলের খবর, যশোরের মনিরামপুরে ৮টি প্রতিমা ভাংচুর হয়েছে। ওয়াজে প্রায়শ: মুর্ক্তিভাঙার ফতোয়া দেয়া হয়? বাংলাদেশের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত এ অপরাধে একজনের বিচার হয়নি। ইসলাম ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার দায়ে ১০জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব শাখার কর্মকর্তা নিবারণ বড়ুয়াকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শিক্ষার্থীদের কাছে মহানবী সম্পর্কে অবমাননাকর বক্তব্য দেয়ায় শিক্ষক প্রভাত চন্দ্র ২রা এপ্রিল মঙ্গলবার আটক হয়েছেন। নড়াইলে সামাজিক মাধ্যমে ইসলাম ও মহানবীকে নিয়ে কটুক্তি করায় পুলিশ রাজকুমার সেনকে গ্রেফতার করেছে রোববার, ৩১মার্চ। বাংলাদেশে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি অত্যন্ত প্রখর; কিন্তু হিন্দুধর্মকে প্রতিনিয়ত অবমাননা করা হলেও ওঁদের কোন অনুভূতি থাকতে নেই?
৫ই এপ্রিল বাকেরগঞ্জের কোষাবড় গ্রামের পলাশ ও প্রশান্ত দাসের সম্পত্তি জোরদখল করে প্রভাবশালী জনৈক মুসলমান পাকা বাড়ী নির্মাণ শুরু করে দেন? ৩১শে মে ঢাকার একটি দৈনিক জানাচ্ছে, সিলেটে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় ২০ কোটি টাকার ভূমিতে জোরপূর্বক নির্মাণ কাজ শুরু করেছে এসটিএস গ্রুপ। ২৭শে মে অপর একটি মিডিয়া জানিয়েছে, লক্ষীছড়িতে সাঁওতালদের শশ্মানসহ কুড়ি একর সম্পত্তি দখল করেছেন ওয়ার্ড মেম্বার রিয়াজুল করিম। একইদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ৫টি হিন্দু পরিবারকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের সম্পত্তি দখল নিয়েছেন চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা হাজী ওয়াস আলী। হিন্দু সম্পত্তি বাংলাদেশে আসলেই গনিমতের মাল? সরকার এনিমি প্রপার্টি বিক্রী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ জমিগুলো হিন্দুর। কার জমি কে বিক্রী করে?
বাসন্তী পূজাকে কেন্দ্র করে ১৮ এপ্রিল সাতক্ষীরার খড়িয়াডাঙ্গায় একদল মুসুল্লীর হামলায় ২০জন হিন্দু জখম হয়েছে। ১১ জুন পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে একজন এমপি বলেছেন, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’, এ বক্তব্য ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। তার বক্তব্য এক্সপাঞ্জ হয়েছে, তবে মন থেকে কি মুছে গেছে? ওপরের ঘটনাগুলো সমসাময়িক, হিন্দু নির্যাতনের বিচিত্র ধারা। সাতচল্লিশের ধারাবাহিকতা। স্বাধীন বাংলাদেশে তা থামেনি, বরং বেড়েছে। বাংলাদেশের হিন্দুদের ইতিহাস, রক্তাক্ত ইতিহাস। এ ঘটনাগুলো ‘টিপস অন আইসবার্গ’, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের কথা লিখতে গেলে একটি মহাভারত হয়ে যাবে। কে লিখবে সেই মহাকাব্য? কে করবে এই অত্যাচারের বিচার? একজন নাগরিক হিসাবে দেশের হিন্দুরা বিচার চাইতেই পারেন, তাঁরা বিচার চানও বটে, মামলা হয়, মাঝে-মধ্যে সন্ধ্যায় গ্রেফতার, সকালে মুক্তি নাটক হয়, কিন্তু ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। হিন্দু বিচার পায়না। এজন্যে অনেকে বলেন, ‘বিচার চাহিয়া সরকারকে লজ্জা দেবেনা না’। [email protected];