কে সি নাগের অঙ্ক বই তো জানেন, এবার জেনে নিন কে সি নাগের আসল পরিচয়।।

কেশবচন্দ্র নিছক গণিতজ্ঞ ছিলেন না। পাশাপাশি তিনি ছিলেন এক জন সাহিত্যমোদী
মানুষ। কবিশেখরের বাড়িতেই ‘রসচক্র সাহিত্য সংসদ’ নামে এক সাহিত্যসংগঠনের
আড্ডা বসত নিয়মিত। সাহিত্যপ্রিয় কেশবচন্দ্রও ছিলেন সেই আড্ডার অন্যতম
সদস্য।
বিগত প্রায় পাঁচ দশক ধরে অঙ্ক
শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের অপরিহার্য সঙ্গী কে সি নাগের অঙ্ক বই।

অঙ্কভীতি রয়েছে যে সমস্ত ছাত্রছাত্রীর, তাদের কাছে সে বই সাক্ষাৎ আতঙ্ক। আর
অঙ্ক-পাগল ছেলেদের মন মজে যায় কেশবচন্দ্র নাগের পাটীগণিত, বীজগণিতের
সমস্যার জট ছাড়ানোর কাজে। কিন্তু কে ছিলেন এই কে সি নাগ? বাংলায় সবচেয়ে
জনপ্রিয় অঙ্ক বইয়ের প্রণেতা এই মানুষটির ব্যক্তিপরিচয় কী?

কেশবচন্দ্রের জন্ম ১৮৯৩ সালের ১০ জুলাই রথযাত্রার দিন হুগলির গুড়াপের
নাগপাড়ায়। শৈশবেই পিতা রঘুনাথের মৃ্ত্যু হয়। মা ক্ষীরোদাসুন্দরী মানুষ
করেন সন্তানদের। স্থানীয় স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার পরে সপ্তম
শ্রেণিতে ভর্তি হন ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেই স্কুল কেশবের
বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। রোজ তিন মাইল অতিক্রম করেই স্কুলে
যেত বালক কেশব। কিন্তু তার জন্য পড়াশোনাকে কখনও অবহেলা করেনি সে। ১৯১২
সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে কেশবচন্দ্র ভর্তি হন কলকাতার রিপন কলেজে।
১৯১৪-এ আইএসসি পাশ করেন। প্রবেশিকা এবং আইএসসি— দুই পরীক্ষাতেই প্রথম
বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

কে সি নাগ। 

কলেজ জীবনেই রোজগারের জন্য টিউশনি শুরু করেছিলেন। পরবর্তী কালে শিক্ষক
হিসেবে যোগ দেন ভাস্তাড়া স্কুলেই। সেই স্কুলে কেশবচন্দ্র ছিলেন অঙ্কের
থার্ড মাস্টার। কিছু দিন পরে চলে আসেন কিষেণগঞ্জ হাই স্কুলে। আরও পরে
বহরুমপুরের ঐতিহ্যবাহী কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলে অঙ্ক শিক্ষার দায়িত্ব তুলে
নেন। তাঁর অঙ্ক ক্লাসে মুগ্ধ হয়ে যেত ছাত্ররা। অঙ্কের মতো কঠিন
সাবজেক্টকেও দিব্যি প্রাঞ্জল ভাষায় ছাত্রদের সামনে তুলে ধরতে পারতেন তিনি।
স্বভাবতই অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ও সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে।
প্রবাদপ্রতিম শিক্ষাবিদ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কানেও পৌঁছে যায়
কেশবচন্দের নাম। স্যার আশুতোষের উদ্যোগেই কেশবচন্দ্র কলকাতার মিত্র
ইনস্টিটিউশনে অঙ্ক শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কালে কালে সেই স্কুলের হেড
মাস্টার হয়েছিলেন তিনি। হেড মাস্টার পদে থাকাকালীনই তিনি চাকরি থেকে অবসর
নেন।
 

নিয়েই পিএইচডি। কেন জানেন?

ইতিমধ্যে পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় থাকাও শুরু করে দেন কেশবচন্দ্র।
প্রাথমিক ভাবে তাঁর বাস ছিল রসা রোডের একটি মেস বাড়িতে। পরে ১৯৬৪ সালে
দক্ষিণ কলকাতার গোবিন্দ ঘোষাল লেনে নিজের বাড়ি করে থাকতে শুরু করেন।

কেশবচন্দ্র নিছক গণিতজ্ঞ ছিলেন না। পাশাপাশি তিনি ছিলেন এক জন
সাহিত্যমোদী মানুষ। মিত্র ইনস্টিটিউশনে তাঁর সহকর্মী ছিলেন কবিশেখর কালিদাস
রায়। কবিশেখরের বাড়িতেই ‘রসচক্র সাহিত্য সংসদ’ নামে এক সাহিত্যসংগঠনের
আড্ডা বসত নিয়মিত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় কিংবা
জলধর সেনের মতো প্রথিতযশা সাহিত্যিকের যাতায়াত ছিল সেই আড্ডায়।
সাহিত্যপ্রিয় কেশবচন্দ্রও ছিলেন সেই আড্ডার নিয়মিত সদস্য। সুহৃদ কালিদাস
রায় লক্ষ্য করেছিলেন, গণিতে কেশবচন্দ্রের গভীর বুৎপত্তি। তিনি বন্ধু তথা
সহকর্মীকে উৎসাহ দিতে থাকেন একটি অঙ্ক বই লেখার ব্যাপারে। কেশবচন্দ্রও ভেবে
দেখেন, বই লিখলে বৃহত্তর ছাত্রসমাজের সাহায্যে লাগা সম্ভব। ইউ এন ধর
অ্যান্ড সনস প্রকাশনা সংস্থার তরফে ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি প্রকাশ পায়
কেশবচন্দ্রের লেখা প্রথম অঙ্ক বই ‘নব পাটীগণিত’। পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণির
ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেই বই অল্পকালের মধ্যেই বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
পাঠ্যপুস্তকের মর্যাদা পায় বইটি। ১৯৪২ সালে ক্যালকাটা বুক হাউজের
পরেশচন্দ্র ভাওয়াল কেশবচন্দ্রের অঙ্কের খাতাটিই বইয়ের আকারে প্রকাশের ইচ্ছে
ব্যক্ত করেন। অঙ্ক-সহায়িকা ‘ম্যাট্রিক ম্যাথেমেটিক্স’ নামে প্রকাশ পায় সেই
খাতা। প্রকাশের অল্পকালের মধ্যেই সেই বইও গগনচুম্বী সাফল্য পায়। তার পর
একে একে বিভিন্ন শ্রেণির বহু বই লেখেন কেশবচন্দ্র। হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি
সহ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয় তাঁর বই। গণিত বইয়ের রচয়িতা হিসেবে ক্রমশ
কিংবদন্তির স্তরে উন্নীত হন তিনি। ১৯৫৫ সালে নাগ পাবলিশিং হাউজ প্রতিষ্ঠা
করে নিজের বই প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।

কেশবচন্দ্র ছিলেন বহুমুখী মানুষ। তিনি ছিলেন সারদা মায়ের প্রত্যক্ষ
শিষ্য। সাহিত্যিক-প্রতিভাও ছিল তাঁর। ‘রত্ন-বেদী’ নামে নিজের দিনলিপিতে
টুকরো কবিতা ও ভক্তিমূলক গান লিখেছেন অজস্র। অনুবাদক হিসেবে স্বামী
অভেদানন্দের ইংরেজি বক্তৃতা এবং ভগিনী নিবেদিতার বেশ কিছু লেখা অনুবাদ
করেছিলেন তিনি। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণও করেছেন। খেলাধূলাতেও
প্রবল উৎসাহ ছিল কেশবচন্দ্রের। মোহনবাগান ক্লাবের সদস্য ছিলেন সারা জীবন।
এমনকী তাঁর শেষ জীবনের অসুস্থতা ও মৃত্যুর সঙ্গেও খেলার যোগ রয়েছে। ১৯৮৫
সালের ১ ফেব্রুয়ারি কানপুরে অনুষ্ঠিত ভারত-ইংল্যান্ড টেস্টের ধারাবিবরণী
শুনছিলেন রেডিওতে। সেই সময়েই খেলার উত্তেজনায় সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়
কেশবচন্দ্রের। তার বছর দু’য়েক পরে ১৯৮৭-র ৬ ফেব্রুয়ারি কেশবচন্দ্র শেষ
নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই মহান গণিতজ্ঞের নশ্বর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে
গিয়েছে, কিন্তু তাঁর লেখা অঙ্ক বই এখনও বহু ছাত্রছাত্রীর নিত্যসঙ্গী।