ধামাধরা বুদ্ধিজীবীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অবশ্য অদ্ভুত একটি যুক্তি দিয়ে থাকেন।

ভারতীয়দের গণতান্ত্রিক অধিকার, ভোটাধিকার ইত্যাদি পাওয়ার সময় কি আসেনি ? ঠিক কখন এই অধিকারটি তাঁদের দেওয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন ?

১৯৪৫ সালে এক প্রখ্যাত ঐতিহাসিককে এই প্রশ্নটি করা হয়। তিনি উত্তরে বলেন –১৯৯৫ সালের আগে নয়।
উত্তরটি কৌতুকধর্মী হলেও বিখ্যাত এই ঐতিহাসিকটি যে ব্রিটিশ শাসনকে ভারতের পক্ষে মঙ্গলময় মনে করতেন, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই কারণেই কি তাঁকে স্বাধীনতার পর ব্রাত্য করে রাখা হল ? ১৯৪৭ এর পর ইরফান হাবিব, রোমিলা থাপার, বিপান চন্দ্রের মত ঐতিহাসিক যারা মূলত মার্ক্সবাদী, ব্রিটিশ শাসনের চরম বিপক্ষে এবং কোনো মানদণ্ডেই ইসলামী শাসনের কট্টর সমালোচক নন কেবল তাঁরাই কেন সমস্ত আলোক বৃত্তটি নিজেদের দখলে রাখলেন ? বঙ্কিমচন্দ্র, রামমোহন এমনকি বিদ্যাসাগর মহাশয়ও ব্রিটিশ শাসনের সুফল সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। আনন্দমঠ উপন্যাসে সাহিত্য সম্রাট সেটি গোপনও করেননি। রামমোহন বিদ্যাসাগর তো ইংরেজ প্রভুদের কাজে লাগিয়ে পচা গলা সমাজটিতে প্রাণ সঞ্চারে ব্রতী হয়েছিলেন যা পাঁচশ বছরের ইসলামী শাসনে অকল্পনীয় ছিল। তবে সমস্যা কোথায় ? ব্রিটিশদের প্রতি কোমল মনোভাবের কারণেই কি এই প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্বাধীন ভারতে উপযুক্ত সম্মান পেলেন না ? অথচ নাইট উপাধিপ্রাপ্ত এই ঐতিহাসিকটিই প্রথম ভারতীয় ঐতিহাসিক হিসেবে আমেরিকান হিস্টোরিকাল এসোসিয়েশনের সাম্মানিক সদস্য পদ লাভ করেছিলেন। তাঁর অনন্যসাধারণ ইতিহাস রচনা বিশেষ করে ঔরঙ্গজেব এবং শিবাজির উপর বিশ্লেষণী আলোকপাত আধুনিক সময়ের উল্লেখযোগ্য দলিল। না, নিছক ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবই নয়, চরম ইসলাম বিদ্বেষ তথা ইসলামী শাসনের প্রতি বিরূপ মনোভাব স্বাধীন ভারতে তাঁকে ব্রাত্য করে তুলেছে। দু একটি পর্যবেক্ষণ এবং পদক্ষেপ উল্লেখ করা যেতেই পারে।
*এই ঐতিহাসিকটি মনে করতেন প্রতিটি দেশেরই ঐতিহাসিক নিয়তি / গতিপথ হল নিজেকে ক্রমাগত আধুনিক করে তোলা, আরও বিজ্ঞানসম্মত হয়ে ওঠা, এবং একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। ঔরঙ্গজেব যদি চাইতেন তবে ভারতকে সেই অভিমুখে পরিচালিত করতে পারতেন, কারণ একটি কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার দৌলতে তিনি সেই সুযোগ পেয়েছিলেন।কিন্তু দুঃখের ব্যাপার এই যে মোগল দরবারে বেশ কিছু ইউরোপিয়ান বইপত্র এসে পৌঁছলেও তিনি একটিও মুদ্রণ যন্ত্র বা লিথোগ্রাফিক স্টোন আমদানী করেন নি। আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার প্রতি মোগলদের অনীহা তাঁকে খুব হতাশ করেছিল।
* The History of Aurangazeb – বইটিতে তিনি খোলাখুলিভাবে ইসলাম ধর্ম, জিহাদ, দাস প্রথা, কাফেরদের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি অত্যন্ত বাস্তবনিষ্ঠ কিন্তু নেতিবাচক আলোতে বিশ্লেষণ করেছিলেন।
*তিনিই প্রথম হিন্দু নিপীড়নকে [যা ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে পরিলক্ষিত হয়] ইহুদী গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেন।
* তিনিই প্রথম ভারতীয় ঐতিহাসিক যিনি হিন্দু মহাসভার সঙ্গে যুক্ত হন।
এত কিছুর পরও কি স্বাধীন ভারত এমন একজন ঐতিহাসিককে সম্মান করবে ? না করাই স্বাভাবিক। কিন্তু গণতন্ত্র তো বহুমতের কথাই বলে। জানার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার তার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবে কেন পরিকল্পনা মাফিক এই পণ্ডিত মানুষটিকে ব্রাত্য করে রাখা হল। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত তাঁরও একই পরিণতি হল কেন ?
ধামাধরা বুদ্ধিজীবীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অবশ্য অদ্ভুত একটি যুক্তি দিয়ে থাকেন। এই বরেণ্য ঐতিহাসিকটির পুত্র গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং [Great Calcutta Killing] অর্থাৎ ডাইরেক্ট একশন ডে-র সেই ভয়াবহ দাঙ্গায় জনৈক মুসলিম দাঙ্গাবাজের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। ধর্মতলায় একটি ট্রাম থেকে নামার পর তিনি এই আক্রমণের মুখে পড়েন। এই ব্যক্তিগত আঘাত নাকি তাঁর মতামতকে প্রভাবিত করেছিল। বড় হাস্যকর যুক্তি। ১৯৪৬-৪৭ এর এই দাঙ্গার অনেক আগেই তিনি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি সম্পন্ন করেন। গ্রন্থগুলির রচনাকাল দেখলেই সেটি পরিষ্কার হয়ে যায়। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে এই মহান মানুষটির মৃত্যুর পর স্বদেশ তাঁকে ভুলে গেছে। বলা ভাল ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ১৯৭২ সালেও Orient Longman এর মত বিখ্যাত প্রকাশনী তাঁর বই প্রকাশ করতে বাধ্য হয়।
হ্যাঁ আমি বরেণ্য ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের কথাই বলছি। আগামী প্রবন্ধ/ গদ্য সংকলনে তাঁর উপর একটি বিস্তারিত আলোচনা রাখতে পারব আশা করছি।